Wednesday, January 30, 2008

কোন মরদে সাদিয়া লবে তোর বিলাতের কড়ি

গোপীচন্দ্রে আছে — ‘কোন মরদে সাদিয়া লবে তোর বিলাতের কড়ি।’ মনসামঙ্গলে আছে — ‘আমি তোমার হুকুমে সকল বিলাতে ভ্রমি।’ কিংবা, ‘গণনা করিবার গেছিলাম বিলাতক নাগিয়া,’ আবারও গোপীচন্দ্র। অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায়শ্চিত্তে — ‘এমন সময়ে বিলাত হইতে সদ্যপ্রত্যাগতা আরক্তকপোলা আতাম্রকুন্তলা আনীললোচনা দুগ্ধফেনশুভ্রা হরিণলঘুগামিনী ইংরাজমহিলা স্বয়ং সভাস্থলে আসিয়া দাঁড়াইয়া প্রত্যেকের মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।’

প্রথম বাক্যে বিলাত অর্থ দেশ, দ্বিতীয় বাক্যে শাসনাধীন দেশ, রাজার দেশ বা রাজপাট, তৃতীয় বাক্যে বিদেশ, যেমন বিলেতি বেগুন অর্থাৎ টমেটো, কিংবা বিলেতি দ্রব্য, আর শেষ বাক্যে ইংল্যান্ড বা পুরনো বানানে ইংলণ্ড। এর অর্থ কখনও কখনও ইউরোপ বা য়ুরোপও বটে। আদতে শব্দটি আরবি, ব়িলায়াহ্‌ (ولاية — নিষ্পন্ন যে ধাতু, ولي, থেকে তার অর্থ শাসন করা)। ফারসি বা তুর্কিতে ব়িলায়াত‌্‌। অর্থ, (কাজির) শাসনাধীন দেশ, অনেকটা প্রদেশের মত, যা পরে রাজ্যের রূপ নেয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন আর হরিচরণ মিলিয়ে তাই দাঁড়ায়।

বলা হয় মোঘল শাসকরা ফারসিতে ভারতবর্ষীয়দের বলত তাদের ‘বিলায়ত’ বা দেশেও এরকমটি ঘটে। এভাবে বিলায়ত অর্থ দেশ থেকে শাসকদের দেশ হয়ে যায়। একারণে বিলায়ত বলতে এসময় পারস্যকে বোঝানো হত। পরে ইংরেজরা এলে শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ইংল্যান্ড, ভারতের ইংরেজ শাসকরা মাঝে মাঝে বিলায়ত (স্বদেশ) যেত, হয়ত ছুটি কাটাতে বা কোনও কাজে। ১৮৫১ সালে কলকাতায় ছাপানো জন মেন্ডিসের বাংলা-ইংরেজি অভিধানে বিলাৎ বা ব়িলাৎ (অভিধানে অবশ্য অন্তঃস্থ ব-এর ক্ষেত্রে আসামি ৰ-এর মত সে সময়ে প্রচলিত হরফ দেওয়া আছে, এই পেট-কাটা হরফটি আসামিতে র, অন্তঃস্থ ব আসামিতে ৱ, বাংলা র-এরমত নিচের বিন্দু পরিবর্তে লম্বা টান) অর্থ দেশ, ইউরোপ। ফ্রান্সিস জোসেফ স্টেইনগ্লাসের ফারসি অভিধান মতে ভারতে শব্দটির অর্থ সাধারণত ইউরোপ, ইংল্যান্ড বা পারস্য। বাংলার অভিধানে বিলাতি অর্থ ইংল্যান্ডের বা ইউরোপের। জন শেক্সপিয়ারের উর্দু অভিধানেও বিদেশি বা ইউরোপীয়।

আরবি ব়িলায়াহ্‌ এখন হিন্দি এবং উর্দুতে ব়িলায়ত (विलायत এবং ولاية)। বাংলার মত হিন্দিতে ব়িলায়ত (जिस समय गाँधीजी विलायत पढ़ने के लिए गए थे... জিস সময় গাঁধীজী ব়িলায়ত পঢ়নে কে লিএ গএ থে... যখন গান্ধীজী বিলাতে পড়তে গিয়েছিলেন...) বলতে ইংল্যান্ড বোঝালেও, বিদেশ অর্থও বিদ্যমান। উর্দুতে ব়িলায়ত অর্থ দেশ, প্রদেশ, বিদেশ, রাজত্ব বা ঈশ্বরের নৈকট্য। ফারসি অভিধানে শব্দটির অর্থ দেশ, প্রদেশ বা রাজত্ব। হবসন-জবসনের মতে আফগানিরা তাদের দেশকে বিলায়ত বলত। শেক্সপিয়ারের উর্দু অভিধানে বিলায়েতি শব্দের একটা অর্থ হল আফগানি। দাগেস্তানে জেলাকে বলা হয় ভ়িলাইয়াত (вилайат)। আর আরবিতে ব়িলায়াহ্‌ বললে যুক্তরাষ্ট্র বোঝায়। পুরো শব্দবন্ধটি হল আল-ব়িলায়াত আল-মুত্তাহ়িদাহ্‌ (الولايات المتحدة), বা একীভূত রাষ্টসমূহ।

Sunday, January 20, 2008

অপদস্থ কর্মকর্তা আর অপদস্থ কর্মচারী

অপদস্থ অর্থ অপমানিত, অবমানিত, লাঞ্ছিত, বা অসম্মানিত; পরাভূত অর্থেও ব্যবহৃত হয়, তবে একটু অপ্রচলিত। এই অর্থে শব্দটি বাংলা ভাষার প্রায় সব অভিধানে পাওয়া যায়। শব্দটির আরেক অর্থে ব্যবহার হয় — পদস্থ নয়, পদাধিষ্ঠিত নয় বা উচ্চপদস্থ নয়। তবে আগের অর্থের তুলনায় পরের অর্থের ব্যবহার বেশ কম। ব্যবহার যাই হোক, শব্দটির, বা দুই অর্থে শব্দদু'টির, উচ্চারণ নিয়ে অমত বা দ্বিমতের অভাব নেই। সাহিত্য সংসদের প্রকাশিত সুভাষ ভট্টাচার্যের বাংলা উচ্চারণ অভিধান মতে অপদস্থ যদি অপমানিত হয় তবে উচ্চারণ অপোদস্‌থো (/ɔpod̪ɔst̪ʰo/) আর পদাধিষ্ঠিত নয় হলে অপদোস্‌থো (/ɔpɔd̪ost̪ʰo/); তবে প্রথম অর্থেও দ্বিতীয় উচ্চারণের চল আছে। সুভাষ ভট্টাচার্যেরই বাংলা প্রয়োগ অভিধান মতেও তাই, তবে লেখা থেকে বোঝার সুবিধার জন্য পরের অর্থে অ-পদস্থ লেখবার প্রস্তাব রয়েছে সেখানে।

জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটির সবচেয়ে বেশি অর্থে পাওয়া যায়। এবং অভিধানটির উচ্চারণ কুঞ্চিকা মতে শব্দটির উচ্চারণ হওয়া উচিত অপদস্‌থো (/ɔpɔd̪ɔst̪ʰo/)। উচ্চারণ পাল্টায়। বিলাতে শিক্ষিতদের গৃহীত উচ্চারণ (Received Pronunciation) এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। খোদ বিলাতেই মিস্‌চিভ়াস (MISchievous, জোর প্রথম অক্ষরে) কে মিস্‌চিভ়াস (misCHIEVous, জোর দ্বিতীয় অক্ষরে) এবং চান্স্‌ (chance) কে খানিকটা চ্যান্স্‌-এর মত উচ্চারণ করা হচ্ছে, অবশ্য নতুন প্রজন্মের দ্বারা, জে, সি, ওয়েল্‌স্-এর জরিপ মতে। যদিও এখন কেউ হয়ত এখনও পদস্থ নয় অর্থে অপদস্‌থো (/ɔpɔd̪ɔst̪ʰo/) উচ্চারণ করে, প্রথম অর্থে কেউই হয়ত নয়। বাংলা একাডেমির প্রকাশিত নরেন বিশ্বাসের বাঙলা উচ্চারণ অভিধানে, যেখানে কেবল অপমানিত অর্থ বিদ্যমান, শব্দটির উচ্চারণ জ্ঞানেন্দ্রমোহনে যা আছে তাই — অপদস্‌থো (/ɔpɔd̪ɔst̪ʰo/)। বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যম ইন্‌স্টিটিউটের প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান এবং আফসার ব্রাদার্সের প্রকাশিত প্রমিত উচ্চারণ অভিধান মতে অপমানিত অর্থে শব্দটির উচ্চারণ অপোদস্‌থো (/ɔpod̪ɔst̪ʰo/)। পদাধিষ্ঠিত নয় অর্থে শব্দটি বাংলা একাডেমি, গণমাধ্যম ইন্‌স্টিটিউট বা আফসার ব্রাদার্সের অভিধানে পাওয়া যায় না।

পদস্থ শব্দটির বাংলায় উচ্চারণ পদোস্‌থো (/pɔd̪ost̪ʰo/); বাংলায় স্বভাবতই দ্বিতীয় অ-অক্ষর ও হয়ে যায় আর শেষের যুক্ত অবশ্যই ও। গানে বা কবিতায় পদস্‌থো (/pɔd̪ɔst̪ʰo/) হতে পারে। পদাধিষ্ঠিত নয় অর্থে অপদোস্‌থো (/ɔpɔd̪ost̪ʰo/), কারণ উপসর্গের সাধারণত কোনও ক্ষমতা নেই উচ্চারণ পাল্টানোর। আর অপমানিত অর্থে শব্দটির উচ্চারণ অপোদস্‌থো (/ɔpod̪ɔst̪ʰo/) হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারণটি হল নতুন অর্থ, পদস্থ-র বিপরীত নয়, বা পদের বিপরীতার্থক অপদ থেকেও আসেনি।। শব্দটি অপমানিত অর্থে বাংলা। মনিয়ের মানিয়ের-উইলিয়াম্‌স্‌-এ কেবল পদাধিষ্ঠিত নয় অর্থটি পাওয়া যায়।

Monday, January 14, 2008

ধরণির ধূলি আর ধরণীর ধূলী

বাংলা বানানের আধুনিক নিয়মে অ-সংস্কৃত সব শব্দে হ্রস্ব-ই ব্যবহারের রীতি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি বা পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির তাই মত। রানী, কাহিনী এবং ভিখারিনি শব্দগুলোও এখন রানি, কাহিনি এবং ভিখারিনি হিসেবে লেখা হচ্ছে, যদিও অনেকের, বিশেষকরে প্রাচীনপন্থীদের, একটু চোখে লাগছেও। কিন্তু এমন অনেক শব্দ আছে যা খোদ সংস্কৃত ভাষাতেই বিকল্পে হ্রস্ব-ই বা দীর্ঘ-ঈ দিয়ে সিদ্ধ; এদের বেশিরভাগ শব্দই বাংলায় দীর্ঘ-ঈ দিয়ে প্রচলিত। তবে অনেকগুলোর ক্ষেত্রেই এখন হ্রস্ব-ই জায়গা করে নিচ্ছে। তরী, সূচী, সূরী, অন্তরীক্ষ, শ্রেণী, অবনী, নালী, কিংবদন্তী, কুটীর, কুম্ভীলক, গণ্ডী, চীৎকার, ধরণী, ধূলী, বীথী, ভঙ্গী, মঞ্জরী, মসী, শ্রোণী, গাণ্ডীব, পেশী, বল্লরী, বেণী, ব্রততী, মালতী, যুবতী, লহরী, মূষীক, সরণী এবং স্বাতী শব্দগুলোর সংস্কৃত ব্যাকরণ মতে তরি, সূচি, সূরি, অন্তরিক্ষ, শ্রেণি, অবনি, নালি, কিংবদন্তি, কুটির, কুম্ভিলক, গণ্ডি, চিৎকার, ধরণি, ধূলি, বীথি, ভঙ্গি, মঞ্জরি, মসি, শ্রোণি, গাণ্ডিব, পেশি, বল্লরি, বেণি, ব্রততি, মালতি, যুবতি, লহরি, মুষিক, সরণি এবং স্বাতি হিসেবে লেখা সিদ্ধ। একতা বা সমতা বিধানের জন্য হ্রস্ব-ই দিয়েই শব্দগুলো লেখা উচিত।

রবীন্দ্রনাথের লেখার ক্ষেত্রে হয়ত অনেকের জন্য সমস্যা দেখা দেবে কি লেখা হবে তা নিয়ে। গান গেয়ে তরি (না তরী) বেয়ে কে আসে পারে। শব্দ না পাল্টে, বানান পাল্টানো অনেকটাই দস্তুর। শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের নাম The Tragedie of Hamlet থেকে The Tragedy of Hamlet হতে খুব বেশি সময় লাগে নি। প্রথম ফোলিও থেকে দ্বিতীয় ফোলিও, ১৬২৩ থেকে ১৬৩২; মাত্র ক'টা বছর। কোয়ার্টোতে অবশ্য নাম ছিল The Tragicall Historie of Hamlet। সেই হ্যামলেটেই প্রায় শুরুর দিকে ছিল Doth make the night ioynt labourer with the day; আমরা এখন পড়ি Doth make the night joint labourer with the day; আর মার্কিনি ছাপায় Doth make the night joint laborer with the day। কে বলে বানান পাল্টানো যায় না বা পাল্টায় না? আর স্যামুয়েল টেলর কোলারিজের ১৭৮৯-এর The Rime of Ancyent Marinere ১৮১৭-তে এসে The Rime of the Ancient Mariner, তার জীবদ্দশাতেই।

Saturday, January 12, 2008

জশন-এ-জুলুস

জশন-এ-জুলুস বা জশনে জুলুস (جشن جلوس)। অনেক সময় আবার বানানভেদে জুলুছ। চোখে পড়ে একটি বড় শব্দবন্ধ হিসেবে — জশনে জুলুসে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (প্রচলিত বানানে), নবীর (পৃথিবীতে) আগমন উপলক্ষ্যে সমাবেশে আনন্দোৎসব। বাংলায় আরবি-ফারসি শব্দের অভিধানে শব্দ দুটি আলাদা ভাবে পাওয়া যায় — জশন (جشن) এবং জুলুস (جلوس)। জশন শব্দের অর্থ বাংলায় দাঁড়ায় আনন্দোৎসব; জুলুস অর্থ উপবেশন, একত্র হওয়া বা সামাজিক সমাবেশ। হিন্দিতে লেখা হয় জশ্ন (जश्न) বা জশন (जशन)। যারা এই অনুষ্ঠান পালন করে তাদের মতে জুলুস রূপকঅর্থে মিছিল বা শোভাযাত্রাকেও বোঝায়। জশনে জুলুস শব্দবন্ধটি কখনও আবার উর্দু বা ফারসিতে অভিষেক উৎসবকেও বোঝায়।

দুই শব্দের মাঝে এ বা ই ফারসির ইজ়াফাত (اضافه), যার আরবির ইজ়াফা থেকে আসা। উর্দুতেও বহুলব্যবহৃত। শব্দটির অর্থ যোগ, আর ব্যবহৃত হয় দুই বা তার বেশি বিশেষ্যের শব্দবন্ধে যার প্রথম শব্দের অর্থ প্রাধান্য পেয়ে পরের শব্দের সাথে সম্বন্ধিত হয়, যেমন চোখের পানি, আব্‌-এ-চশ্‌ম্‌ (آب چشم), উর্দুতে, বা মা'উল আইন (ماء العين), আরবিতে,বাংলায় যদিও ক্রমটি পাল্টে যায়। তবে উর্দুতে সাধারণত অশ্রুকে বলা হয় আঁসু (آنسو) আর আরবিতে দাম'উ (دمع)।

জুলুস শব্দটি আরবি ক্রিয়া জালাসা (جلس) বা বসা থেকে এসেছে, ফারসিতে। আর জশন শব্দটি পুরনো ফারসি: পহলবিতে yaśn, আবেস্তায় yaśna, ব্যুৎপন্ন yaz থেকে, যা কিনা সংস্কৃত যজ্‌ (यज्‌) এর সমগোত্রীয়। এই যজ্‌ থেকেই সংস্কৃত যজ্ঞ (यज्ञ) শব্দটি এসেছে; এসেছে সংস্কৃত যজমান (यजमान), যা হিন্দিতে জজমান (जजमान)।

Thursday, January 10, 2008

রাজাই, ভোরাই, সাঁঝাই

প্রত্যয় হিসেবে -আই শুনতে বেশ লাগে, কিছু শব্দের ক্ষেত্রে তো বটেই। বাংলা অভিধানে পাওয়া যাবে রাজাই (রাজত্ব্), ভোরাই (ভোর বেলা), সাঁঝাই (সাঁঝ বেলা), ইত্যাদি; এর কিছু কিছু হয়ত কবিতাতেও মেলে। যদিও লোকের বুলিতে এই প্রত্যয় তেমন একটা পাওয়া যায় না, সেলাই, কামাই, ধোলাই আর বাঁধাই ছাড়া। দৈনিক পত্রিকার ছাপাখানায় বিভিন্ন ভাগের কাগজ একসাথে করে গুছিয়ে রাখার কাজ হল ঝাড়াই এবং বাছাই। দর্জির কাছে পোশাক বানানোর হল বানাই। এরকম আরও অনেকই আছে, অভিধানের পাতায়।

Sunday, January 06, 2008

সোচ্চার, উচ্চার এবং অনুচ্চার

রাজশেখর, জ্ঞানেন্দ্রমোহন, হরিচরণ, যোগেশচন্দ্র, বা কাজী আব্দুল ওদুদ কোথাওই সোচ্চার শব্দটি নেই। বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে প্রকাশিত উচ্চারণ অভিধানগুলোতে অবশ্য শব্দটি বিদ্যমান, (অত্যন্ত) মুখর বা সরব অর্থে। বাংলা একাডেমির বাংলা-ইংরেজি অভিধানেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে। শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের সংসদ বাংলা অভিধানেও পাওয়া যায়: ‘সোচ্চার বিণ. ১। প্রবলভাবে উচ্চারিত বা উচ্চরবে ব্যক্ত (বেতনবৃদ্ধির দাবি সর্বত্র সোচ্চার); ২। অত্যন্ত মুখর (শ্রমিকগণ এ বিষয়ে সোচ্চার)। [বাং. স < সং. সহ + উচ্চার (=উচ্চারণ, কথন)]। (তু. অনুচ্চার)।’ বাংলা একাডেমি অভিধানে: ‘সোচ্চার - বিণ. তীব্র বা প্রবলভাবে উচ্চারিত হয় এমন; অত্যন্ত মুখর; তর্জন-গর্জন; চিৎকার; হৈ চৈ। [স. স + উৎ + চারি, বহু]।’ শব্দটি বাংলা; সংস্কৃতে, অন্তত মনিয়ের মনিয়ের-উইলিয়াম্‌স্‌-এ নেই, যদিও অনুচ্চার, উচ্চারণ না করা অর্থে, আছে। একটি ব্লগ থেকে জানা গেল প্রমথনাথ বিশীর হাতে নাকি চার দশক আগে বাংলায় শব্দের ভুল ব্যবহারের বিরোধিতা হয়েছিল। সোচ্চার তেমনই একটি শব্দ। কারণ জ্ঞানেন্দ্রমোহন-এ উচ্চার অর্থ মল এবং মলত্যাগ। স + উচ্চার অর্থ প্রতিবাদী না হয়ে উচ্চার (মলত্যাগ) অভিলাষীকেও বোঝাতে পারে। হরিচরণে উচ্চারের একমাত্র অর্থ উচ্চারণ। মনিয়ের মনিয়ের-উইলিয়াম্‌স্‌-এর সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান মতে মল, মলত্যাগ এবং উচ্চারণ। ক্রমটি লক্ষ্যণীয়। তারপরেও ইংরজি clamorous অর্থে সোচ্চার যতটা ভাল খেলে, মুখর তার চেয়ে কম, সরব আরও কম। বাংলার সম্পদ হিসেবেই অভিধানে শব্দটির থাকা উচিত ছিল।

Friday, January 04, 2008

ভ-এ ল-ফলা

ভ্লাদিমির নবোকভ (Владимир Набоков) বা ভ্লাদ্যিম্যির নবোকফ, রুশ উচ্চারণ মতে হয়ত এরকমই কিছু একটা হবে, এই য-ফলাটা তালব্যীভবনের (palatalisation) সূত্র। গেল ডিসেম্বরে দেশ-এর এক সঙ্খ্যায় ভ্লাদিমির পুতিন লিখতে গিয়ে একটি নতুন যুক্তাক্ষরের ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলায় সাধারণত এসব ক্ষেত্রে ভ-এ হস্‌ চিহ্ন দিয়ে ল, ভ এর নিচে ল-ফলা বা লাইনোটাইপের যুগে (রাশিয়া থেকে প্রকাশিত পুরনো বইগুলোয় যেমনটি দেখতে পাওয়া যায়) ভ এর পাশে লম্বা দণ্ডযুক্ত নিচে ঝুলে পড়া ল-ফলা দিয়ে লেখা হত; এখনও তাই হয়। আনন্দবাজার ছাপানোর জন্য কম্পিউটারে নিজের তৈরি হরফ ব্যবহার করে। একাজে আনন্দবাজার প্রায় তিনটি আলাদা আলাদা ফন্ট ফাইল ব্যবহার করে, অন্তত দৈনিক পত্রিকাটির ওয়েব সাইট থেকে তাই মনে হয়। এর তিন নম্বর ফাইলে এই ভ এবং ল-এর যুক্তাক্ষরটি বেশ আগেই রাখা ছিল, ব্যবহার এতদিন তেমন একটা চোখে পড়ে নি। এই যুক্তাক্ষরটি বানানো হয়েছে ভ্র-এর আদলে। সাধারণভাবে প্রচলিত যক্তাক্ষরের বাইরে সাধারণত নতুন যুক্তাক্ষর প্রচলনের প্রয়োজন আছে কি?

Thursday, January 03, 2008

রেজামন্দি, ওয়াফা-বরদার

ঈদের (বানানটা কি ইদ হওয়া উচিত বিদেশি শব্দ হিসেবে, আরবিতে দীর্ঘ ঈ, عيد; ইংরেজিতে অল্প হলেও Id প্রচলিত আছে; হিন্দিতে ईद, ঈদ) জামাত বা প্রার্থনা সমাবেশে ইমামের ভাষণে শোনা গেল রেজামন্দি বা -মন্দী এবং ওয়াফা-বরদার, হয়ত ব়ফা-বরদার (প্রথমটিতে ব-এর নিচে বিন্দু, র নয়, আরবি و বোঝাতে)। ইমামের উপদেশ আমাদের খোদার রেজামন্দির জন্য কাজ করতে হবে এবং ওয়াফা-বরদার হতে হবে। রেজামন্দি (ফারসি رجامندى) শব্দের অর্থ খুশি, শব্দটি অন্যভাবে বাংলাদেশে, হয়ত অন্য কোনও জায়গায়ও, নাম হিসেবে প্রচলিত আছে, আরজুমন্দ (آرزو مند)। উইলিয়াম গোল্ডস্যাকের মুসলমানি বাংলা-ইংরেজি অভিধান এবং শেখ গুলাম মাকসুদ হিলালির বাংলায় আরবি-ফারসি উপাদানে শব্দটি দু'টি বানানে পাওয়া যায় — রেজামন্দী এবং রিজামন্দী। আরবি ও ফারসির ই-এর এ হওয়াটা বাংলায় হরহামেশাই ঘটে। শুদ্ধ বাংলা অভিধানে শব্দটির দেখা পাওয়া ভার। আর ওয়াফা-বরদার (وفابردار) শব্দটির অর্থ বিশ্বাসরক্ষাকারী। একটি শব্দবন্ধ হিসেবে না পাওয়া গেলেও ওয়াফা বা ওফা এবং বরদার হিসেবে প্রায় সব অভিধানেই বর্তমান। ইসলাম ধর্মীয় অনুশাসন আলোচনায় অনেক স্বল্পশিক্ষার এলাকায়ও এরকম আরও কিছু শব্দের ব্যবহার দেখা যায় যা সাধারণত মান্য বাংলায় ব্যবহৃত হয় না। ক্ষেত্রভেদে ভাষায় শব্দের এই ব্যবহার ভাষাপ্রকার, ইংরেজিতে register, নামে পরিচিত।