Friday, February 29, 2008

বাংলায় বহুবচনের আরবি-ফারসি প্রত্যয়

বাংলায় আইনের ভাষায় আরবির -আত প্রয়োগে বহুবচনের প্রচলন দেখা যায়, দুয়েকটি হলেও, বহুবচন হিসেবে হয়ত নয়, পুরো নতুন শব্দ হিসেবেই। অভিধানে দেখা মেলে কাগজাত, বা কাগজাদ-এর, অর্থ দলিলপত্র, বা কাগজপত্র। আরবি স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দের শেষে -আত যোগে গঠিত বহুবচনের রূপ, যা ফারসিতেও প্রচলিত: কাগজ (ফারসি كاغذ) + আত (আরবি/ফারসি ات), অর্থাৎ কাগজের বহুবচন, অনেকগুলো কাগজ। বাংলায় কাগজ বলতে তেমন জোরালোভাবে দলিল না বোঝালেও ফারসিতে একটি অর্থ দলিল। আবার খবরের কাগজ সংজ্ঞার্থটি ফারসিতেও আছে, বাংলাতেও। এই ফারসি কাগজ শব্দটি এসেছে পুরনো আরবি শব্দ কাগ়দ (كاغد) থেকে। আরবির কাগজ অর্থে আর একটি পুরনো শব্দ হল ক়ির্‌ত়াস্ (قرطاس), যা গ্রিক খ়ারতেস (χαρτές প্যাপিরাসের পাতা অর্থে) থেকে আগত। আরবির কাগজ অর্থে বর্তমানে প্রচলিত শব্দটি হল ব়ারাক়্‌ (ورق), অর্থ পর্ণরাজি বা পত্র, ব়ারাক়ু ক়ির্‌ত়াস্‌ (ورق قرطاس) এর সঙ্ক্ষেপ। ব়ারাক়া (ورقة) অর্থ কাগজের তা। পুরনো আরবিতে পাওয়া যায় আস়হাব আল-কাগ়দ (কাগজ বিক্রেতা) বা ত়ায়্য আল-কাগ়দ (কাগজের পাতার ভাঁজ)। যাই হোক, এই আরবি কাগ়দ শব্দটি সোগদীয় ভাষা থেকে আসা, যার মূল চিনা শব্দ গু-জি (榖紙, gǔ-zhǐ, গু অর্থ কাগজ-তুঁত আর জি অর্থ কাগজ), কাগজ-তুঁত গাছের বাকলের তৈরি কাগজ। হিন্দিতে কাগজ় (कागज़) ও মরাঠিতে কাগদ (कागद)। বর্তমান তুর্কিতে শব্দটি কায়িত (kağıt)। এরকম আরও বেশ কিছু শব্দের দেখা মেলে: বাগাত/ৎ (বাগানগুলো), দলিলাত/ৎ (দলিলগুলো), ইত্যাদি।

আরও দু'টি ফারসি বহুবচন প্রত্যয়ের দেখা মেলে বাংলায়, আদালতের ভাষাতেই: -হা (ها), যা খানিকটা বঙ্গীকরণের মাধ্যমে বাংলায় আমলাহায় (আমলারা) বা প্রজাহায় (প্রজারা); এবং -আন (ان), সাহেবান (সাহেবরা), বাবুয়ান (বাবুরা), বোজর্গান (বোজর্গেরা), ইত্যাদি।

Friday, February 22, 2008

বাংলায় আরবির আসর

বাংলার তিন আসর — গল্পের আসর, জিনের আসর আর আসরের নামাজ। শেষের দুটোকে (বাংলা একাডেমির) ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে আছর বানানে দ্বিতীয় ভুক্তি হিসেবে পাওয়া গেলেও, সেগুলো নিতান্তই আঞ্চলিক উচ্চারণ-সংবাদী বানান, কারণ সেই অভিধানেই এগুলোর আলাদা উচ্চারণ দেওয়া নেই: আঞ্চলিক বাংলায় অনেকেই স-কে, যদি উচ্চারণ ইংরেজি s-এর মত হয়, ছ হিসেবে লেখে। তিনটি শব্দই আরবি থেকে আগত। আরও একটি আসর বাংলায় পাওয়া যায়, অন্তত (জ্ঞানেন্দ্রমোহনের) বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে, সংস্কৃত, রাক্ষস অর্থে; পুরনো শব্দ, বর্তমানে অপ্রচলিত।

১৮২৭ সালে ছাপানো উইলিয়াম কেরি বা ১৮৫১-তে ছাপানো জন মেন্ডিসের বাংলা অভিধানে কেবল একটি আসর (বৈঠক) পাওয়া যায়; ১৮০২ সালে ছাপানো হেনরি পিট্‌স্‌ ফর্স্টারের অভিধানে শব্দটি নেই। আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রণীত ওগ্যুস্ত্যাঁ ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দকোষ বা তারও পরে প্রনীত হ্যালহেডের পূর্ববঙ্গীয় মুনশি বাংলা-ফারসি শব্দকোষে আসর শব্দটি অনুপস্থিত। তিনটির মধ্যে বৈঠক অর্থে আসর শব্দটি বাংলার বোধ করি প্রথম মেহমান এবং বাংলায় তার প্রবেশ হয়ত আঠার শতকের একেবারে শেষের দিকে। বাংলা একাডেমির অভিধান ছাড়া আর মাত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহনেই নামাজের সময় অর্থটি মেলে। বাকি সব অভিধানেই বৈঠক বা সভা।

প্রথম আসরটি আদতে আরবির আশর (عشر, অর্থ দশ, যা থেকে আশুরা, আরবি মাস মুহররমের দশ তারিখ)। দশ জনের সভা; গৌরবার্থক দশ, তার বেশিও হতে পারে। হরফ পাল্টেও উচ্চারণ একই থেকে গেছে, আশোর্‌ /ɑʃor/, বাংলার প্রায় সব উচ্চারণ অভিধান মতে। এবং এই অর্থেই শব্দটি প্রায় সব অভিধানে পাওয়া যায়। প্রথম দিকের বাংলা গদ্যে বানান দেখা যায়, আসোর: (ঘোড়া) ‘বাতকর্ম্ম করে আসোর জমকিয়ে দিলে,’ হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে উচ্চারণ দেওয়া আছে আশর্‌ /ɑʃɔr/, হয়ত পুরনো বা সচেষ্ট উচ্চারণ।

দ্বিতীয় আসরটি (প্রভাব অর্থে) আরবির আস়র্‌ (اثر, আরবিতে অন্যান্য অর্থ পদচিহ্ন, চিহ্ন, ফলাফল, ক্রিয়া, ইত্যাদি) থেকে, কেবল ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে পাওয়া যায়, বিকল্প বানানে আছর, উচ্চারণ দেওয়া আছে আসোর /ɑsor/। বোধ করি আছর বানান এবং আছোর্‌ /ɑtʃʰor/ উচ্চারণটি অনেক বেশি প্রচলিত এক্ষেত্রে। প্রথম আলো পত্রিকার ঈদ সঙ্খ্যায় ছাপানো মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি লেখা থেকে উদাহরণ: ‘আজকালকার দিনে লোকজনের ওপর জিন-ভুতের সেই রকম আছর হয় না।’ (বাংলা একাডেমির) বাংলা ভাষায় আরবী ফার্‌সী তুর্কী হিন্দী উর্দু শব্দের অভিধানেও এর দেখা মেলে।

তৃতীয় আসরটি আরবির আ়স়র্‌ (عصر, অর্থ সময়, কাল, অপরাহ্ণ, অপরাহ্ণের নামাজ বিশেষ)। ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ছাড়া কেবল জ্ঞানেন্দ্রমোহনে এই অর্থ মেলে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে উদাহরণ: ‘আসরের সময় বিবাহ হইয়াছিল।’ বাংলা একাডেমির অভিধানে উচ্চারণ আসর্‌ /ɑsɔr/, যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহনে আশর্‌, /ɑʃɔr/। অনেকর মুখেই আদতে শব্দটি আশোর্‌ /ɑʃor/, আরবির উচ্চারণ না জানা গ্রামবাংলায় তো বটেই। বানানেও আছর, উচ্চারণে নয়, বেশ চোখে পড়ে: বাদ আছর জানাজার অনুষ্ঠান হয়, অর্থাৎ আসরের নামাজের পর জানাজার নামাজ পড়া হয।

Sunday, February 17, 2008

গোধুলি, গবাক্ষ এবং গবেষণা

জীবনানন্দ দাশের ‘বেদিয়া’য় — তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা,/তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা! গোধূলিতে দীর্ঘ ঊ। হ্রস্ব উ দিলেও অশুদ্ধ হবে না। জ্ঞানেন্দ্রমোহনেও -ঊ-, -উ-। মনিয়ের মনিয়ের-উইলিয়াম্‌সের সংস্কৃত অভিধান মতেও দুটি বানানই শুদ্ধ। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দের ব্যুৎপত্তিতে বলা আছে ‘গোর (গোরুর) ধূলি (ক্ষুরাঘাতে উত্থিত রজঃ) হয় যে সময়ে,’ যেমনটি ছোটবেলায় ইশকুলে পড়ানো হত। তবুও অনেকেরই ধারণা ব্যুৎপত্তিটি ঠিক নয়। কারণ জ্ঞানেন্দ্রমোহনেই গো শব্দটির সংজ্ঞার্থ দেওয়া আছে ২০টি, যার একটি অর্থ কিরণ।শেষে টীকা — দ্রঃ-সকল অর্থ বাঙ্গালায় প্রচলিত নাই। বৈদিক সংস্কৃতে গো-এর অর্থ ছিল আলো এবং ধূলি-র অর্থ অন্ধকার,দুয়ে মিলে গো এবং ধূলির সন্ধিকাল, অর্থাৎ সন্ধ্যা। মনিয়ের-উইলিয়াম্‌সেও গো-এর একটি অর্থ আলোর কিরণ (rays of light), যদিও ধূলির আঁধার অর্থ নেই। গো আলো বোঝালেই গোধুলি শুনতে ভাল লাগে।

দিল্লি থেকে মতিলাল বানারসিদাসের প্রকাশিত কিরীট জোশির The Veda and Indian Culture: An Introducory Essay-র প্রথম অধ্যায়ে আছে গো বলতে গরু বোঝায় এক অর্থে, অন্য অর্থে আলো। যদি বেদের পঠনে গো অর্থ গরু ধরা হয় তবে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত কাজ চলে যায়, কিন্তু অনেক জায়গায় কোনও অর্থ দাঁড়ায় না (... the word go means a cow, in one sence, but it also means light, in another sense. Now it is found that if the word go is interpreted to mean cow in the Veda, it serves well up to a certain point, but this interpretation breaks down at some most crucial points ...)। মার্কিন লোটাস লাইট পাবলিকেশন্‌স্‌-এর প্রকাশিত শ্রী অরবিন্দ ঘোষের The Secret of the Veda-য়, গো শব্দটির দেখা মেলে এক হাজারেরও বেশি জায়গায় এবং বত্রিশ অর্থে যেমন গরু, পানি, আলো, শব্দ, ইত্যাদি (The word go which occurs in more than one thousand verses is given thirty two different meanings ranging from cow, water, ray, sound etc.)। ঋগ্বেদে আছে गोभिरद्रिमैरयत्‌ বা গোভিরদ্রিমৈরয়ৎ, অর্থাৎ (ইন্দ্র) আলো দিয়ে পাহাড় ভেদ করল। এখানে আলো দিয়ে না হয়ে, গরু দিয়ে হয় না। অনেকে পাহাড়কে অজ্ঞানতার প্রতীক হিসেবে দেখে।

এরপরও মনিয়ের-উইলিয়াম্‌সের অভিধানে গোধূলি অর্থ পৃথিবীর ধূলি (earth-dust), যখন মনে হয় পৃথিবী থেকে কুয়াশা উঠছে, যেমন গরম কালে যখন সূর্য অর্ধেক উঠে থাকে আর শীতকালে যখন পূর্ণ সূর্যের তেজ কম থাকে, বা সন্ধ্যা। পৃথিবী অর্থেও গো-এর প্রচলন বেদেই আছে – पदे गौः (পদে গৌঃ, পৃথিবীর চলা পথে, ইংরেজিতে in the footsteps of the earth। এ অর্থে শব্দটি বোধ করি গ্রিক γεος (geos) এর সমার্থক। গবাক্ষ শব্দের ব্যুৎপত্তিতে জ্ঞানেন্দ্রমোহনে লেখা আছে — গো (কিরণ) অক্ষ্‌ (বিস্তৃত কর) + অ (কর্তৃকারক), যে গৃহাদির মধ্যে কিরণ বিস্তার করে, বা গো-গোরু অক্ষি (চক্ষু) যে গোরুর চক্ষুর ন্যায় গোলাকার। এখানে গো অর্থ হয় আলো, নয়ত গরু, ফরাসি থেকে আসা ইংরেজি শব্দ œil-de-bœuf এর মত, bull's eye বা গরুর চোখ, সেই ছোট গোল জানালা বা bullseye window অর্থেই। কাকতালীয় কি? সংস্কৃতে অর্থ ষাঁড়ের চোখ, গোল জানালা, ইত্যাদি।

গবেষণা শব্দটি জ্ঞানেন্দ্রমোহনের মতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান। সংস্কৃতে গবেষণ, মনিয়ের-উইলিয়াম্‌সে অর্থ চাওয়া বা খোঁজা। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে গো+এষণ-ইম্‌ (অন্বেষণকরা) + অন। অর্থ অন্বেষণ। ছোটবেলায় দুষ্টামি করে বলা হত গো অন্বেষণ বা গরু খোঁজা। গো-এর অর্থ আলো ধরে নিলে অর্থটা বেশ খেলে, আলো খোঁজা।

Tuesday, February 05, 2008

বাংলার নিজস্ব গণনাচিহ্ন

সাধারণ ভগ্নাংশ প্রকাশের জন্য বাংলার নিজস্ব চিহ্ন রয়েছে, কিংবা ছিল বলা যায়, যার ভিত্তি ষোল (১৬), ইংরেজিতে hexadecimal। তখন ষোল আনায় এক টাকা ছিল কি না? আগের দিনে শিশুবোধকে পাটীগণিত শেখাতে এইসব কড়াকিয়া বা পণকিয়া ব্যবহৃত হত। পুরনো দিনে লেখাপড়া শেখা লোকেদের দুই একজন নিয়মটা জেনে থাকলেও এখন হয়ত পরিবারের দৈনিক হিসেব নিকেশ করতে এর ব্যবহার আর করে না। ষোলর এক ভাগ থেকে শুরু হয়ে ষোলর পনের ভাগ, ষোল পূর্ণ হলে ১ (এক):

৴ ৵ ৶ ৷৹ ৷৴ ৷৵ ৷৶ ৷৷৹ ৷৷৴ ৷৷৵ ৷৷৶ ৸৹ ৸৴ ৸৵ ৸৶ ১.

পরের বার কেবল সামনে ১ বসবে, একত্রিশ পর্যন্ত, বত্রিশে ২.। (শেষেরটি দাঁড়ি, অঙ্কপাতনের অংশ নয়।) এভাবে চলতে থাকবে। আঠারশ' একান্ন সালে কলকাতায় ছাপানো জে মেন্ডিসের অভিধানে বাংলা চিহ্নের পরিচিতিতে এই ষোলটি সঙ্খ্যা দেওয়া আছে। ব্যাখ্যায় বলা আছে ষোল আনায় এক রুপি (টাকা), ষোল ছটাকে এক সের (ওজন) এবং ষোল পণে এক কাঠা (জমি)। কোনও কোনও পুরনো বইয়ে প্রতিটি সঙ্খ্যার শেষে ৹ লেখা দেখতে পাওয়া যায়, চার, আট এবং বার ছাড়া, কারণ সেখানে এমনিতে একটি অন্ত্য ৹ বিদ্যমান।

তত পুরনো নয় এমন বাংলা বইয়েও, সে অঙ্কেরই হোক বা সাহিত্যের, এই অঙ্কপাতনের ব্যবহার দেখা যায়। বিলেতি বইয়ের একটি নিয়ম হল পৃষ্ঠার নম্বর সঙ্খ্যায় ছাপা হওয়া শুরু হয় বইয়ের মূল পাঠ্যাংশ থেকে, যাকে ইংরজিতে main matter বলে। ইংরেজিতে যা front matter সেগুলোর মধ্যে প্রাথমিক বা অর্ধ নামপত্র বা আখ্যাপত্র থেকে ভূমিকা পর্যন্ত পাতা গণনা করা হলেও তাতে কোন পৃষ্ঠাঙ্ক থাকে না। এই ভূমিকা বা মুখবন্ধ থেকে মূল পাঠ্যাংশের আগের পৃষ্ঠাগুলোতে সাধারণত রোমক অঙ্কে পৃষ্ঠাঙ্ক দেওয়া হয়। বাংলায় এই ক্ষেত্রে এই পুরনো ষোল-ভিত্তির অঙ্কপাতনের ব্যবহার দেখা যায়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণে এমনটিই আছে। তবে অনেকেই এখন বন্ধনীর মধ্যে বা বানান করে পৃষ্ঠাঙ্ক দিয়ে থাকে।

Sunday, February 03, 2008

হবে কি? কী হবে?

আপনি কি পড়ছেন? মানে, পড়ছেন কি? বা পড়ছেন? সাদামাটা প্রশ্ন: এ মুহূর্তে পড়ার কাজটা চলছে কি না? উত্তর হয় হ্যাঁ বা না। এখানে কি-এর কাজ প্রশ্ন করা, প্রশ্নবাচক অব্যয় (interrogative particle)। আবার আপনি কী পড়ছেন? মানে পড়ছেন টা কী? বা কোন বই বা লেখা পড়ছেন? এ মুহূর্তে কোন বই পড়ার কাজ চলছে? উত্তর হ্যাঁ-ও নয়, আবার না-ও নয়। অন্য কোনও কিছু। এখানে কী-এর কাজ সর্বনামের, সর্বনামবাচক অব্যয় (interrogative pronoun)। কি-এর ক্ষেত্রে স্বরাঘাত পড়ে ক্রিয়ার উপর, আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কী-এর উপর। প্রথম ক্ষেত্রে ‘কি’ বাদ দেওয়া যায়, লেখায় এবং কথায়। লেখায় প্রশ্নসূচক চিহ্ন বলে দেবে এটি প্রশ্ন, কথায় (ধ্বনিতত্ত্বের ভাষায়) সাধারণ আরোহী স্বরাঘাতের দরকার পড়বে, অর্থাৎ শেষের অক্ষর (হরফ নয়) প্রথমটির চেয়ে জোরালো উচ্চারিত হবে। ‘কি’ হল প্রশ্ন, বিস্ময় বা সংশয়বোধক; আর ‘কী’ হল সর্বনামবাচক, ক্রিয়া বিশেষণ বা বিশেষণের বিশেষণ। কী আশ্চর্য! আশ্চর্য কি?

সংস্কৃত কিম্‌ থেকে প্রাকৃত হয়ে বাংলায় কি। তবে প্রাকৃতে ‘কি’ এবং ‘কী’ নির্বিশেষে ব্যবহৃত হয়। মধ্য বাংলা সাহিত্যে, এমনি উনিশ শতাব্দ, পর্যন্ত অবশ্য কী-এর ব্যবহার তেমন একটা নেই। কারণ ততদিনে বাংলা প্রাকৃতের বলয় থেকে বের হয়ে সংস্কৃতায়িত হয়েছে। কারণ সংস্কৃতের চর্চা এবং সংস্কৃতের মূল অনুযায়ী বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা। মধ্য বাংলা সাহিত্যের শুরুর দিকে, শিক্ষিত বাঙালি অনেকের ঘরে তখন পাণ্ডুলিপি, যার অধিকাংশই সংস্কৃত। অনেক পরে এসে ‘কি’ এবং ‘কী’ আলাদা শব্দ হিসেবে অর্থভেদের প্রচেষ্টা পায়। কি, সংস্কৃত কিম্‌ (किम्) থেকে; আর কী, সংস্কৃত কীদৃক্‌ (कीदृक्) এর তুলনায়, যার অর্থ কিপ্রকার, কেমন বা কি রকম। সুভাষ ভট্টাচার্যের মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম অর্থভেদের সপক্ষতা করেছেন। শব্দতত্ত্বে আছে —‘অব্যয় শব্দ “কি” এবং সর্বনাম শব্দ “কী” এই দুইটি শব্দের সার্থকতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাদের ভিন্ন বানান না থাকলে অনেক স্থলেই অর্থ বুঝতে বাধা ঘটে। এমন-কি, প্রসঙ্গ বিচার করেও বাধা দূর হয় না। “তুমি কি জানো সে আমার কত প্রিয়” আর “তুমি কী জানো সে আমার কত প্রিয়”, এই দুই বাক্যের একটাতে জানা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হচ্ছে আর একটাতে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে জানার প্রকৃতি বা পরিমাণ সম্বন্ধে...।’

এই বিচারে প্রশ্নসূচক সর্বনাম হিসেবে কিভাবে না লিখে কীভাবে এবং কিসের না লিখে কীসের লেখা উচিত। চলন্তিকায় কী-এর কদর তেমন একটা নয়: ‘কী (কি দেখ)।’ কি-এর উদাহরণে, কি জিনিস; আর ‘বেশী জোর দিতে (“কী সুন্দর! তোমার কী হয়েছে?”’ জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং হরিচরণে ‘কী সর্বনাশ‍!’ পাওয়া যায়, তবে কি এবং কী এর অর্থভেদের ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। জ্যোতিভূষণ চাকীর বাংলা ভাষার ব্যাকরণ এবং হায়াৎ মামুদের বাংলা লেখার নিয়মকানুনে অর্থভেদ সংরক্ষিত। অনেকেই পার্থক্য করে না, আবার অনেকে মেনে চলে।