Saturday, August 08, 2009

বাংলার বাড়তি ধ্বনিমূল

বাংলার ভূখণ্ডে অনেক দিন ধরে ফারসি আর ইংরেজি রাজভাষা থাকবার কারণে বাংলায় বিদেশি ধ্বনিমূলের দেখা মেলে। মান্য বাংলার ধ্বনিভাণ্ডারের বাইরে এই রকম পাঁচটি ধ্বনিমূল আছে – অঘোষ দ্বি-ঔষ্ঠ্য উষ্ম ধ্বনি /f/, ঘোষ দ্বি-ঔষ্ঠ্য উষ্ম ধ্বনি /v/, অঘোষ দ্বি-ঔষ্ঠ্য নৈকট্যক /ɸ/, ঘোষ দ্বি-ঔষ্ঠ্য নৈকট্যক /β/, আর ঘোষ দন্তমূলীয় শিস ধ্বনি /z/। এবং প্রায়ই /f/ ও /ɸ/ গিয়ে ঠেকে //-এ, /v/ ও /β/ গিয়ে ঠেকে //-এ, এবং /z/ গিয়ে ঠেকে //-এ। /f/ ও /ɸ/ এবং /v/ ও /β/ প্রায়ই শোনা যায় ইংরেজি শিক্ষিত এবং বাংলায় সতর্ক উচ্চারণে অভ্যস্ত নয় এমন লোকের বুলিতে, কারণটা হল ইংরেজির /f/ ও /v/। আপিস /ɑpiʃ/ কথাটা বাংলায় শোনা যায় বটে, কিন্তু অফিস বলাই দস্তুর। কিন্তু উচ্চারণটা কি? সাহিত্য সংসদের উচ্চারণ অভিধান এবং কলিকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির অবাঙালিদের জন্য আধুনিক বাংলা অভিধান মতে /ɔpʰiʃ/, বাংলা একাডেমির উচ্চারণ অভিধানে /ɔfis/। অনেকের কাছে মাঝামাঝি /ɔpʰis/ গোছের কিছু একটা। দাঁড়ালটা কি? পশ্চিমবঙ্গের বাংলায় /ɔpʰiʃ/; আর পূর্ববঙ্গের বাংলায় /ɔfis/। অনেকে এই /f/-টা ঠিকমত উচ্চারণ করতে না পেরে উচ্চারণ করে /ɸ/। তেমনি অনেকের কাছেই ভুল /bʱul/ হয়ে যাচ্ছে /vul/ বা /βul/।

আরবি, ফারসি বা উর্দু থেকে আসা /z/-ধ্বনির শব্দগুলো বাংলায় সাধারণত // – জাহাজ (জহাজ়, جـﮩ‍از) /dʒɑɦɑdʒ/, মেজাজ (মিজ়াজ, مزاج) /medʒɑdʒ/, সাজা (সজ়া, سزا) /ʃɑdʒɑ/, কিংবা উজির (ব়জ়ীর, وزير) /udʒir/। অসাধারণত জ় /z/, কারণ নাটকে উজিরে আজম ( ব়জ়ীর-এ-‘আজ়ম, وزير اعظم)-কে /udʒireɑdʒom/ বললে কেমন যেন একটু ঠেকে, তাই /uzireʔɑzɔm/ শোনা যায়। অন্যান্য ভাষা থেকে আসা অল্প-প্রচলিত শব্দে, শিক্ষিতের বুলিতে /z/ প্রায়শই /z/, // নয়। তবে মান্য বাংলার // অনেক উপভাষায় /z/, পরশুরামের z‍ানতি-র মত।

শতাংশের হিসেবে বাংলায় অনেক কম ব্যবহৃত একটি ধ্বনিমূল হল /ʕ/। আস্‌সালামু ‘আলাইকুম (السلام عليكم, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) বাংলাদেশে এবং এ অঞ্চলের অনেক দেশে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত সম্ভাষণ বাক্য। অনেকেই সাধারণভাবে /asalaːmʊ alaɪkʊm/ বললেও, আরবির শুদ্ধ উচ্চারণ হল /ʔasːaˈlaːmʊ ʕaˈlaɪkʊm/। এবং আরবি এবং আরবি-পঠনে শিক্ষিত লোকের বুলিতে শুদ্ধ উচ্চারণটি শোনা যায়।

Wednesday, August 05, 2009

পত্রিকায় সাধু ভাষা-রীতি

পত্রিকায় এখন সাধু ভাষার দেখা মেলে কেবল সম্পাদকীয় নিবন্ধে। পশ্চিম বঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকায় আর বাংলাদেশে দৈনিক ইত্তেফাকে। আগে দু’টি পত্রিকাতেই সাধু ভাষায় সংবাদ ছাপা হত। আনন্দবাজার পত্রিকা খবরের পাতা থেকে সাধু ভাষা গুটিয়ে নিয়েছে ১৯৬৫ সালের ২২শে মার্চে। তার দেখাদেখি অন্যান্য পত্রিকাও সংবাদ পরিবেশনে সাধু ভাষার ইতি টানে। দৈনিক ইত্তেফাক সংবাদ পরিবেশনে সাধু ভাষা ছেড়ে চলতি ভাষার ব্যবহার শুরু করে ২০০১ সালের ১৪ই নভেম্বর। তার আগের দিন অর্থাৎ ১৩ই নভেম্বর ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ঘোষণা ছাপা হয়–
‘একটি ঘোষণা–
ভাষা-বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, তরুণ প্রজন্ম, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, পাঠক-পাঠিকা এবং শুভানুধ্যায়ীদের সুচিন্তিত মতামত অনুযায়ী আগামীকাল বুধবার থেকে দৈনিক ইত্তেফাকে সাধু ভাষা-রীতির বদলে চলতি ভাষা-রীতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের গত ৫০ বছরের ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে সম্পাদকীয় নিবন্ধ আগের মতই সাধু-রীতিতে প্রকাশিত হবে। – ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।’
ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় নিবন্ধের সাধু ভাষা কিন্তু কেবল সর্বনামে আর ক্রিয়াপদে; বিশেষণ, ক্রিয়া-বিশেষণ আর সমাসবদ্ধ পদের বড়ই অভাব। আর সংস্কৃতাগত তৎসম শব্দের চেয়ে আরবি-ফারসির তদ্ভব বা তৎসম শব্দের ব্যবহার বেশি।

Tuesday, August 04, 2009

ক্রিয়া-বিশেষ্যে অভিশ্রুতির ধ্বনি প্রবর্তন

বাংলা ভাষায় -ইবা (চলিত রীতিতে -বা) প্রত্যয় যোগে ক্রিয়া-বাচক বিশেষ্য পদ, ইংরেজিতে যাকে verbal noun বলা হয়, ‘মাত্র’-যোগে এবং চতুর্থী ও ষষ্ঠী বিভক্তিতে ব্যবহৃত হয় – করিবা-মাত্র, করিবার এবং করিবার জন্য। চলিত রীতিতে তা করা-মাত্র, করবার এবং করবার জন্য। সাধু ভাষায় উচ্চারণ নিয়ে সমস্যা না থাকলেও, চলিত ভাষায় আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে করবার উচ্চারণ /kɔrbɑr/, তেমনিভাবে বলবার উচ্চারণ /bɔlbɑr/; খেলবার শব্দটি সুনীতিকুমারের ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণে নেই; কিন্তু সুনীতি-সূত্র অনুসারে /kʰælbɑr/ হওয়ার কথা। ঢাকার বাংলা একাডেমির বাংলা বানান-অভিধানে করবার /kɔrbɑr/, কিন্তু খেলবার বা দেখবার শব্দ দুটো নেই। সংসদ সাহিত্যের বা বাংলা একাডেমির উচ্চারণ অভিধানের একটিতেও করবার বা খেলবার শব্দ দুটি নেই।

সাধু করিবার থেকে অপিনিহিতি কইরবার, এবং বিশেষত পূর্ববঙ্গের কথ্য বাংলায় এধরণের অপিনিহিত উচ্চারণের দেখা মেলে। সেই অপিনিহিত কইর্‌বার থেকে অভিশ্রুতির ফলে চলিত ভাষায় প্রতিস্থাপিত ধ্বনির লুপ্তি, অর্থাৎ করবার। করিবার - কইর‌বার - করবার, খেলিবার - খেইলবার - খেলবার, শুনিবার - শুইনবার - শুনবার, ইত্যাদি। অপনিহিত এই স্বরধ্বনিগুলো আবার শুদ্ধ ধ্বনি নয়, বরং অনাক্ষরিক। ধ্বনি প্রবর্তেনের নিয়মে উচ্চারণগুলো হওয়া উচিত /koribɑr/ - /koirbɑr/ - /korbɑr/, /kʰelibɑr/ - /kʰeilbɑr/ - /kʰelbɑr/, /ʃunibɑr/ - /ʃuinbɑr/ - /ʃunbɑr/, ইত্যাদি। কিন্তু সুনীতিকুমারের বইতে বলা হয়েছে, /kɔrbɑr/; এবং এ নিয়ম মেনে চললে /kʰælbɑr/ ও /ʃonbɑr/।

তবে ভাস্করজ্যোতি সেনগুপ্তের বাংলা উচ্চারণ রীতি বইয়ের ভূমিকায় পবিত্র সরকারের ব্যাখ্যা – বাংলায় আরেক ধরণের ক্রিয়া-বিশেষ্য পদের ব্যবহার আছে এবং সেগুলোও চতুর্থী এবং ষষ্ঠী বিভক্তিতে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর স্বরধ্বনিগুলো সাধু ভাষার একই রকম ক্রিয়াপদের স্বরধ্বনির চেয়ে খানিকটা নিচু। এই নিচু স্বরধ্বনিগুলো (/ɔ, æ, o/) উঁচু স্বরধ্বনিগুলোকে (/o, e, u/) হটিয়ে দিচ্ছে, অর্থগত নৈকট্যের কারণে; হয়ত খানিকটা উঁচু ধ্বনির উচ্চারণের অলসতায়, নিচু ধ্বনির উচ্চারণ করতে জিহ্বার খাটুনি অনেক কম। আপাতত ক্‌অর্‌বার্‌ /kɔrbɑr/ বিশেষত পশ্চিম বঙ্গের ভাষায় এবং কোর্‌বার্‌ /korbɑr/ সাধারণত পূর্ববঙ্গের ভাষায় পরিলক্ষিত হয়। পবিত্র সরকারের মতে দুটি উচ্চারণই মান্য, তবে একসময় করবার /korbɑr/, খেলবার /kʰelbɑr/ আর শুনবার /ʃunbɑr/ আর শোনা যাবে না, থাকবে কেবলই করবার /kɔrbɑr/, খেলবার /kʰælbɑr/ এবং শোনবার/ʃonbɑr/, প্রথম দু’ক্ষেত্রে বানানের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না।

Thursday, July 30, 2009

উচ্চারণে জিহ্বা জড়ানো

এমন কিছু শব্দবন্ধ বা বাক্য থাকে যা উচ্চারণ করতে গেলে জিহ্বা জড়িয়ে যায়, পরপর দ্রুত ঠিকমত বলে ওঠা যায় না। যেমন আমরা বলে থাকি ক লিখতে কলম ভাঙ্গা, ঠিক তেমনি উচ্চারণ করতে দাঁত ভাঙ্গা। ইংরেজিতে একেই বলে টাং টুইস্টার (tongue twister), অভিধানের মতে বাংলায় বলতে হবে দুরুচ্চার্য বাক্য বা শব্দবন্ধ, উচ্চারণের কাঠিন্য এতে বেশ ফুটে ওঠে। দাঁত ভাঙ্গা শব্দও বলা যেতে পারে, যদিও বাংলায় শব্দ সন্নিবেশ (collocation)-এর নিয়মে দাঁত ভাঙ্গা জবাবই দস্তুর। ইংরেজি ভাষায় এ রকম সবচেয়ে প্রচলিত দাঁতভাঙ্গা বাক্য বোধ করি Peter Piper picked a peck of pickled peppers. / A peck of pickled peppers Peter Piper picked। অনেক সময় বাড়তি দুই পঙ্ক্তি যোগ করা হয়: If Peter Piper picked a peck of pickled peppers, / Where’s the peck of pickled peppers Peter Piper picked? এর পরেই হয়ত She sells sea shells on the sea shore। এ ধরণের বাক্য বা শব্দবন্ধ তৈরি হয় ভাষায় ব্যবহৃত প্রায় একই ধরণের ধ্বনিমূলের পাশাপাশি ব্যবহার করে, তা সে ব্যঞ্জনেরই হোক, বা স্বরের।

ফরাসিতে un chasseur sachant chasser sait chasser sans son chien de chasse (যে শিকারী শিকার করতে পারে সে তার শিকারী কুকুর ছাড়াই শিকার করতে পারে)। জর্মনে Es grünt so grün, wenn Spaniens Blüten blühen (স্পেনে ফুল ফুটলে সবুজ অনেক সবুজ দেখায়, বার্নার্ড শ’র পিগম্যালিয়নের The rain in Spain stays mainly in the plain-এর অনুকরণে)। হিন্দিতে বেশ জুতসই এমন একটি বাক্য হল: एक ऊंचा ऊंट है पूंछ ऊंची ऊँट की। पूंछ से भी ऊंची क्या पीठ ऊंची ऊंट की॥ (এক ঊঁচা ঊঁট হৈ পূঁছ ঊঁচী ঊঁট কী। পূঁছ সে ভী ঊঁচী ক্যা পীঠ ঊঁচী ঊঁট কী॥ সে এক লম্বা ঊট, উঁচু তার লেজ। লেজের চেয়ে উঁচু সে ঊটের পিঠ।) বাংলায়ও তেমন বেশ কিছু বাক্য রয়েছে: ‘পাখি পাকা পেঁপে খায়,’ ‘বাবলা গাছে বাঘ ঝোলে’ আর ‘জলে চুন তাজা, তেলে চুল তাজা’ বেশ প্রচলিত। অন্তত ছোটবেলায় প্রত্যেকেই একবার না বলেছে বা বলিয়েছে। আরও কয়েকটি আছে: ‘চাচা চাঁচা চটা চেঁচোনা, আচাঁচা চটা চাঁচো,’ ‘বার হাঁড়ি রাবড়ি বড় বাড়াবাড়ি,’ ‘গড়ের মাঠে গরুর গাড়ি গড়গড়িয়ে যায়,’ ‘কাচা গাব, পাকা গাব’ আর ‘কত না জনতা জানাল যাতনা যতনে।’

মুক ও বধিরদের ব্যবহৃত আঙ্গুলের সাঙ্কেতিক ভাষায়ও জিহ্বা জড়ানোর মত আঙ্গুল পেঁচিয়ে ফেলবার ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সাঙ্কেতিক ভাষার দুরুচ্চার্য শব্দবন্ধকে বলা হয় ফিঙ্গার-ফাম্বলার (finger fumbler)।

Monday, July 27, 2009

বুলির অবোধগম্যতা

ভাষার খেলা বা গুপ্ত ভাষা হল মুখের বুলিকে একটু এদিক-ওদিক ক'রে পালটে দেওয়া যেন অনভ্যস্ত কানে একটু অন্য রকম ঠেকে, বোঝার অসুবিধে হয়। ইংরেজিতে অনেক ভাবেই কাজটি করা হয়। এদের মধ্যে প্রধান এবং সবচেয়ে প্রচলিত বোধ করি পিগ ল্যাটিন (Pig Latin)। ভাষাতত্ত্বের নিয়মে সাধারণভাবে প্রতিটি অক্ষরকে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায় – আরম্ভ বা অনসেট (onset) এবং অবশিষ্ট বা রাইম (rime)। রাইমের আবার দু’টি ভাগ – কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস (nucleus) আর অন্ত বা কোডা (coda)। নাম /nɑm/ শব্দটিতে ন্‌ /n/ হল আরম্ভ, আ /ɑ/ হল কেন্দ্র আর ম্‌ /m/ হল অন্ত। পিগ ল্যাটিনে প্রতিটি শব্দের প্রথম অক্ষরের আরম্ভকে শব্দের শেষে নিয়ে সাথে ay, উচ্চারণ //, যোগ করতে হয়। এতে করে পিগ ল্যাটিন (Pig Latin) কথাটি মুখের বুলিতে গিয়ে দাঁড়াবে ‘ইগপেই অ্যাটিনলেই’ (Igpay Atinlay) /ɪɡpeɪ ætɪnleɪ/। সবসময় যে ay-র ব্যবহার হয় তা নয়, অনেকক্ষেত্রে way, yay, বা hay-র ব্যবহারও দেখা যায়। এই গুপ্ত ভাষার আছে রকমফের এবং বাহারি নাম। পিগ গ্রিক (Pig Greek) বা আবি ডাবি (Ubbi Dubbi) বলে একটি নিয়মে শব্দের প্রতিটি অক্ষরের অবশিষ্টের আগে es /es/ ঢোকানো হয় – how are you? হবে hesow arese yesou? জিবারিশ (Gibberish) বলে একটি নিয়মে প্রতিটি শব্দের প্রথম আরম্ভের পর itherg, itug বা idig ঢোকানো হয় – dog হবে dithergog, ditugog বা didigog। জার্মান ভাষায় B-Language-এ প্রতিটি স্বর বা দ্বিস্বরের পর একই স্বর বা দ্বিস্বর আগে b বসিয়ে আবার উচ্চারণ করা হয় – Deutsche Sprache হয়ে যায় Deubeutschebe Sprabachebe

এধরণের ভাষার খেলা সাধারণত ছোটদের মধ্যে দেখা যায়। মেয়েদের মাঝেও ব্যবহার আছে। বাংলায় এ ধরণের বেশি প্রচলিত রীতিটি হল শব্দের আগে ‘চি’ বসিয়ে দেওয়া – চিআমি চিভাত চিখাই। যদি আরেকটু অবোধ্য করতে হয় তবে শব্দের প্রতিটি প্রতিটি আরম্ভের আগে ‘চি’ বসালেই হবে – চিআচিমি চিভাচিত চিখাচিই। অনেক সময় ‘চি’-এর পরিবর্তে ‘পি’ বা অন্য কোন বর্ণও দেখা যায়। রুশীদেরও প্রায় একই রকম একটি নিয়ম আছে; প্রতিটি অক্ষরের আগে ফু় (фу) যোগ করা হয়, প্রিভ্যেত (привет, অর্থ খানিকটা ওহে’র মত, আর য অর্থাৎ য-ফলার সংস্কৃত উচ্চারণটি একটু খেয়াল রাখতে হবে) হয়ে যায় ফু়প্রিফু়ভ্যেত (фуприфувет); আর এর নাম фуфайский язык বা ফু়ফ়া ভাষা। আরেকটি আরেকটু কঠিন নিয়মে অক্ষরের আরম্ভে ইট যোগ করা হয় – ইটামিটি ভিটাতিট খিটাইটি। প্রায় একই রকম আরেকটি নিয়মে আরম্ভের সাথে ইংচ যোগ করা হয় – ইংচামি ভিংচাত খিংচাব। চি এবং ইংচ যোগে বুলির কথা অভ্র বসুর বাংলা স্ল্যাং: সমীক্ষা ও অভিধান বইতে পাওয়া যায়। পশ্চাৎ বুলির ব্যবহারও বেশ লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে কাজটি হল শব্দটিকে পিছন থেকে উচ্চারণ ক’রে যাওয়া – মিআ তভা ইখা। দুই অক্ষরের, অন্ত সহ, শব্দ হলে অনেক সময় ‘বিস্কুট’কে টস্কুবি না বলে কুট্‌বিস্‌-ও বলা হয়। অক্ষরের প্রতিটি অভ্যস্ত জিহ্বা এবং কানের কাছে এটা কোনও ব্যাপারই নয়। ফরাসিতে ভ়ের্‌লঁ বা Verlan (লঁভের, l'envers থেকে) নামের এক নিয়মে শব্দের প্রতিটি অক্ষর পিছন থেকে উচ্চারণ করা হয় একটু পালটে নিয়ে, অনেকটা কুট্‌বিসের ধাঁচে – arabe থেকে হয় beur বা femme থেকে meufeu

Wednesday, July 15, 2009

মরা কার্তিকের মঙ্গা

বাংলাদেশের উত্তরে পাঁচটি জেলায় আশ্বিনের শুরুতে ধান-বোনার কাজ শেষ হয়ে গেলে গরিব, পরের ক্ষেতে-কাজ-করা লোকের হাতে না থাকে কাজ, না থাকে রেস্ত। দ্রব্যমূল্যের দাম যায় বেড়ে। এ-অবস্থাটা চলে প্রায় দু’মাস ধরে – আশ্বিন আর কার্তিক, আগস্টের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি; স্থানীয় লোকের মুখের ভাষায় মরা কার্তিক। ফিছরই এমনটি ঘটে রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট আর গাইবান্ধায়। দু’মাসের এই সময়টা উত্তারঞ্চলে মঙ্গা নামে পরিচিত। উচ্চারণ /mɔŋɡɑ/। মঙ্গা-পড়া এলাকার লোকেরা আগে নিজেদের মত করে ব্যাপারটা সামলে নিত। ২০০৪ সালে মঙ্গা মোটামুটি হঠাৎ করে গণমাধ্যমের নজরে পড়ে যাওয়ায় বেশ শোর ওঠে ব্যাপারটা নিয়ে। দিনের পর দিন দৈনিক পত্রিকার পাতায় খবর, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ইত্যাদি।

অনেক পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে দেখা যায় মঙ্গা শব্দটি এসেছে মাগা, অর্থাৎ চাওয়া বা ভিখ মাগা, থেকে; মান্য বাংলার মাগা মঙ্গা-পীড়িত অঞ্চলে মাঙ্গা। অনেক ক্ষেত্রে শব্দটির ব্যুৎপত্তিতে দেওয়া থাকত দারিদ্র্য নিরসনে কাজ করে যাওয়া বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত। মঙ্গা-পড়া এলাকার অনেক গরিব লোকই মরা কার্তিকে ভিক্ষে করে দিনাতিপাত করত বা এখনও করে, কিন্তু মাঙ্গা থেকে মঙ্গার সঙ্ঘটন বোধ করি একটু বেশি সহজ হয়ে গেল। মাঙ্গা শব্দটা সে অঞ্চলের মুখের বুলিতে এখনও বিদ্যমান, ত্রিশ বছর আগেও ছিল; একটি আ-কার কমে গিয়ে নতুন শব্দ তৈরি হবার কথা নয়, বিশেষত যখন মঙ্গা শব্দটাও সেই অঞ্চলে ত্রিশ বছর আগেও ছিল?

উত্তরাঞ্চলে মাঙ্গা কথাটা চাওয়া বা যাচ্ঞা করা অর্থে প্রচলিত ঠিক যেমনটি ছিল মধ্য বাংলায় – লৈলুঁ দান কপোত মাঙ্গিয়া, কবিকঙ্কণ থেকে। এই শব্দটি মান্য বাংলার শব্দ মাগা থেকে এসেছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের মতে সংস্কৃত মার্গন থেকে মাগন, সাথে আ-যুক্ত হয়ে মাগনা, সে থেকে সঙ্ক্ষেপ মাগা। মাগা থেকে মাঙ্গা কি ভাবে এল? মধ্য বাংলায় শব্দটিতে চন্দ্রবিন্দু ছিল, সম্ভবত মৈথিলির প্রভাবে – বিরহি যুবতী মাঁগ দরশন দান, বিদ্যাপতি থেকে। হিন্দি ক্রিয়াটিতে চন্দ্রবিন্দু – माँगना (মাঁগনা)। আর দুর্মূল্য অর্থে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে বলতে শোনা যায় চাল বেশ মঙ্গা হয়ে পড়েছে, হয়ত কিঞ্চিত হ-এ ভাবও আছে – ম(হ্‌)ঙ্গা। এই মহঙ্গা শব্দটি হিন্দিতে महँगा বা महंगा আর উর্দুতে مہنگا। উর্দুতে উচ্চারণ অনেকসময় অনেকটা মহ্‌ঙ্গা। এবং প্ল্যাট্‌সের মতে মহঙ্গা এসেছে প্রাকৃত মহগ্‌ঘও, যা কিনা সংস্কৃত মহার্ঘ + কঃ থেকে আগত; অর্থ দুর্মূল্য। মহঙা শব্দটি অসমীয়া ভাষায়ও আছে; চন্দ্রকান্ত অভিধানের মতে, সংস্কৃত মহার্ঘ থেকে হিন্দি মহংগা হয়ে। শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের সংসদ বাংলা অভিধানে মাঙ্গা, বিশেষণ হিসেবে অর্থ দুর্মূল্য আর ক্রিয়া হিসেবে চাওয়া।

Monday, July 13, 2009

খাতিরজমা আর খাতির জমানো

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২২ সালে ছাপানো শিব রতন মিত্রের পুরনো বাঙলা গদ্যের ধরণ (Types of Early Bengali Prose) বইয়ে দেখা যায় ‘সাহ গোলাম আহম্মদ খাতির জমাতে বাগের সাবিক দস্তুরে ভোগ করিবেন’ কিংবা ‘এখন শ্রীযুক্ত আমিন্দী এক ইঙ্গরেজী সনন্দ হুকুম হয় তবে খাতির জমাতে জমি আবাদ করিয়া শ্রী৺ সেবা পূজা করি।’ পুরনো বাংলা গদ্যের নমুনা, প্রথমটির লিপিকাল বঙ্গাব্দ ১১৭২ বা ইংরেজি ১৭৬৫ সাল, পরেরটির ঠিক বিশ বছর পর। ‘খাতির জমা,’ যদিও বর্তমানে প্রায় সব অভিধানেই ‘খাতিরজমা।’ অর্থ কিন্তু তিন ধরণের পদের মাঝে ঘুরপাক খায়।

জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটি বিশেষ্য হিসেবে নিশ্চয়তা আর বিশেষণ হিসেবে নিশ্চিন্ত, পাশে বন্ধনীস্থ টীকা [এই শব্দ ক্রমে বঙ্গভাষায় ব্যবহারে আসিতেছে]। বাঙ্গালা ভাষার অভিধানের প্রথম প্রকাশ ১৯১৬ সালে! উইলিয়াম কেরির অভিধানেও কিন্তু শব্দটি আছে, বিশেষ্য এবং বিশেষণে; অর্থ আরামপ্রাপ্ত, শান্ত, খুশি, মনের স্থিরতা, সন্তুষ্টি, নিশ্চয়তা। কেরির অভিধান বেরিয়েছিল ১৮২৭ সালে। হরিচরণে বিশেষ্য হিসেবে অর্থ মনের শান্তি বা সুখ বা দৃঢ়বিশ্বাস; উদাহরণ, দাশরথি রায়ের পাঁচালি থেকে ‘ক্ষুদ্র বেটাকে খাতির ক’রে, খাতির জমায় ছিলাম ভুলে।’ রাজশেখরে বিশেষ্য দৃঢ়বিশ্বাস, বিশেষণ নিশ্চিন্ত। বাংলা একাডেমির অভিধানে ক্রিয়া বিশেষণ হিসেবে অর্থ নিশ্চিন্তে, নিরুদ্বেগে; উদাহরণ আবুল মনসুর আহমদ থেকে ‘যান, খাতিরজমা থাকুন গিয়া, কিছুই হইব না’ আর সৈয়দ হামজা থেকে ‘চলিল খাতেরজমা ডর নাহি আর।’ শব্দ সঞ্চয়িতায় বিশেষ্য নির্ভীকতা, নিশ্চিন্তভাব আর বিশেষণ নিশ্চিন্ত, যার উপর নির্ভর করা যায় এমন। ব্যুৎপত্তি সিদ্ধার্থে বিশেষণ আরামপ্রাপ্ত, খুশি, তৃপ্ত; উদাহরণ রাধাকান্তের গসপেল থেকে, ‘থাকিহ খাতিরজমা কাল যায় নাই।’ কাজী আব্দুল ওদুদে বিশেষণ, নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন; উদাহরণ ‘বিরুদ্ধপক্ষ কিছুই করতে পারবে না, আপনি খাতিরজমা থাকুন।’ সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধানে, ক্রিয়া বিশেষণ, নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়, আর উদাহরণ সেই সৈয়দ হামজা থেকে। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে অবশ্য শব্দটিকে ঢাকার বুলি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অর্থ ধীরে সুস্থে, অর্থাৎ ক্রিয়া বিশেষণ। আর কলিকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি’র অবাঙালিদের জন্য আধুনিক বাংলা অভিধান (Modern Bengali Dictionary for Non-Bengali Readers)-এ, যেখানে উচ্চারণ দেওয়া আছে /kʰɑtirdʒɔmɑ/, অর্থ বিশেষ্য হিসেবে নিরুদ্বেগ, নিশ্চিন্ত আর বিশেষণ হিসেবে নিশ্চিন্ত, তৃপ্ত, আত্মস্থ। উইলিয়াম গোল্ডস্যাকেও শব্দটির দেখা মেলে বিশেষ্য এবং বিশেষণ হিসেবে।

খাতিরজমা, বা খ়াত়িরজমা‘, শব্দটি ফারসি خاطرجمع থেকে এসেছে। সব অভিধানের তাই মত। জন শেক্সপিয়ারে খাতির অর্থ হৃদয়, চিত্ত, মন, ঝোঁক, স্মৃতি, বর্ণনা, পক্ষ, ইচ্ছা, ইত্যাদি। বাংলায় খাতির শব্দে এর বেশির ভাগ অর্থই বোঝায়। এই ফারসি খাতির এসেছে আরবি خطر থেকে। আর জমার অর্থ ফারসিতে সমাবেশ, যুক্তি, সংগ্রহ, পরিমাণ, যোগফল, সমগ্র এবং বহুবচন। আলাদা ভাবে এই শব্দও বাংলায় প্রচলিত। এরও আগমন আরবি থেকে। তবে খাতিরজমা পূর্ণাঙ্গ শব্দবন্ধ হিসেবে ফারসিতে বিশেষ্য এবং বিশেষণ। ক্রিয়া বিশেষণ বোধ করি বাংলার অবদান। হিন্দিতেও এই শব্দের দেখা মেলে – खातिरजमा (বানানটা বাংলার মতই), বা ख़ातिरजमा, তবে সাথে বাংলার মত থাকা না হয়ে ক্রিয়াপদটা সাধারণত হয় রখনা (रखना, রাখা)। হিন্দিতে বলে গাঁঠ মেঁ জমা রহে তো খাতির জমা (गाँठ में जमा रहे तो खातिरजमा, পয়সা থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়)। সকালে ‘খাতিরজমা’ ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে গিয়ে অপরিচিত লোকের সাথে ‘খাতির জমানো’ পুরোদস্তুর ভিন্ন জিনিস।

Thursday, July 09, 2009

ভাষার সাধু, চলিত

সাধু আর চলিত,বা চলতি, বাংলা ভাষার প্রধান দুই মান্য রীতি। শান্তিপুর আর নদিয়ার হলেও, চলিত ভাষা এখন কোন অঞ্চলের ভাষা নয়। বরং সর্বগ্রাহ্য মান্য ভাষা। আর সাধু ভাষার ব্যবহার এখন বেশ পড়ে গেছে, প্রায় লেখাই হয় না, দুয়েকটি দৈনিকের সম্পাদকীয় ছাড়া। আগে ছিল লেখায় সাধু, আর বচনে চলিত। ভাষাতত্ত্বে একেই বলে দ্বিবাচনভঙ্গি বা দ্বিবিধ ভাষারীতি। এই অবস্থাটা অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে আর নেই। সাধু ভাষা নতুন করে আর ব্যবহৃত হয় না। সাধু ভাষা এখন পুরনো সাহিত্যের অঙ্গ। তাই এই দ্বিবাচনভঙ্গির ব্যাপারটা এখন আর আছে বলা বোধ করি চলে না। গ্রিসেও বোধ হয় ব্যাপারটা একই রকম। ১৮২০-এর পর থেকে লেখার ভাষাকে বলা হত কাথারেভুসা বা পরিশীলিত অর্থাৎ সংস্কৃত গ্রিক, আর মুখের বুলি ছিল দিমোতিকি বা দেহাতি অর্থাৎ চলতি গ্রিক। গেল শতাব্দীর সাতের দশকের খানিক পরে মান্য ভাষার তকমা দেওয়াতে দিমোতিকি-ই গ্রিসে এখন মান্য প্রচলিত বুলি।

এখন চলিত বাংলার সময়। ভবিষ্যতে হয়ত নতুন কিছু আসবে। এখনই আঞ্চলিকতা ছাড়াও শহর-নগরে যা বলা হয় এবং যা লেখা হয় তার মধ্যে বেশ ফারাক দেখা যায়। ভাষাতত্ত্বের বুকনিতে এগুলো অ্যাক্রেলেক্ট, মেসোলেক্ট, ব্যাসিলেক্ট (acrolect, mesolect এবং basilect)-এর পর্যায়ে পড়বে। অ্যাক্রোলেক্ট হল শীর্ষভাষা, মান্য চলিত রূপ যা আমরা লিখে থাকি এবং দপ্তর বা আদালতে এবং গণমাধ্যমে ব্যবহারের চেষ্টা করি। শিক্ষিত দুই অঞ্চলের লোকের মাঝেও এর ব্যবহার দেখা যায়, বোঝার সুবিধার জন্য, বিলেতে যেমন একসময় গৃহীত উচ্চারণ (received pronunciation) ব্যবহৃত হত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, খাইয়াছি (সাধু), খেয়েছি (মান্য চলিত, অ্যাক্রোলেক্ট), এবং খাইছি বা খাইসি (মেসো- বা ব্যাসিলেক্ট)। এক্ষেত্রে খাইছু বা খাইসু কিংবা খাউসু হবে আঞ্চলিকতা (ডায়ালেক্ট, dialect)।

মধ্য যুগে আলাওলদের ভাষাই ছিল আদর্শ। পরে ষোলশ' খ্রিস্টাব্দের দিকে ভাষা পালটে সাধু ভাষার রূপ নেয়। সাধু ভাষা হয় সাহিত্যের ভাষা, শিক্ষিতের ভাষা, অনুষ্ঠানের ভাষা। সাধু কথাটির অর্থ সাধারণভাবে এখন পরিশীলিত, মার্জিত বা ভদ্র ধরা হলেও, সেসময় এর অর্থ ছিল বণিক। সমাজভাষা বিশেষজ্ঞ মনসুর মুসার এই মত। অর্থটির দ্যোতনা এখনও ‘সাধু সাবধান’ কথাটির মধ্যে বিদ্যমান। অর্থাৎ সাধু ভাষা ছিল আমির-সাধুদের ভাষা। পরে ইংরেজদের হাতে পরে প্রাকৃত প্রভাব মুক্ত হয়; এবং সংস্কৃত প্রভাব যুক্ত হয়ে তৈরি মান্য সাধু ভাষা, খানিকটা যেন সংস্কৃতের ব্যাসিলেক্ট। ১৮০১ সালে মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের লেখা থেকে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে – ‘এতদরূপে প্রবর্তমান সকল ভাষা হইতে সংস্কৃত ভাষা উত্তমা বহু বর্ণময়ত্ব প্রযুক্ত এক দ্ব্যক্ষর পশুপক্ষি ভাষা হইতে বহুতরাক্ষর মনুষ্য ভাষার মত ইত্যনুমানে সংস্কৃত ভাষা সর্বোত্তমা এই নিশ্চয়।’ সেসময় দ্বিভাষারীতির ব্যাপারটা আমলে নেওয়া যেত। এরও প্রায় একশ বছরের বেশ কিছু সময় পরে, ১৯১৩ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমথ চৌধুরী সাধু ভাষার জায়গায় সাহিত্যে চলিত ভাষা চালানোর চেষ্টা করে। তাই পরে মান্য ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। একই লেখায় সাধু আর চলিতের মিশ্রণকে গুরুচণ্ডালী বলে অভিহিত করা হত, পরীক্ষার খাতায় তো বটেই।

Tuesday, July 07, 2009

মাগির অশিষ্টতা

বাংলা মৌচাক (১৯৭৫) ছায়াছবিতে উত্তম কুমারকে ছোটভাই রঞ্জিত মল্লিকের সামনে তার প্রেমিকা মিঠু মুখোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়: তুমি ওকে মাগিপাড়া দিয়ে যেতে বলেছ? ছোটভাইয়ের প্রেমিকা মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলে উত্তর দেয়। একটা জিনিস মোটামুটি পরিষ্কার বোঝা যায় যে মাগি শব্দটা পুরনো আমলে অশিষ্ট ছিল না মোটেই। শোনা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কালিপ্রসন্ন সিংহ হরহামেশা শব্দটি ব্যবহার করত। শব্দটিতে হয়ত গ্রাম্যতা ছিল। শব্দটি রবীন্দ্রযুগ থেকে সাহিত্যে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যায়। রাজশেখর বসুর চলন্তিকায় শব্দটি অশিষ্ট, কিন্তু মাগী বানানে, যদিও শব্দটি তদ্ভব, যে কোনও ব্যুৎপত্তির দিক থেকে, আর তাই ই-কার হওয়াই রীতি। বাংলায় শব্দটি দিয়ে তুচ্ছার্থে নারী এবং বয়স্ক মহিলা বোঝানো হয়। মাগিপাড়া শব্দের অর্থ যদিও বেশ্যাপাড়া। তবে যে কোনও অর্থেই শব্দটি অন্তত শহুরে বুলিতে অশিষ্ট।

জ্ঞানেন্দ্রমোহনে আছে সংস্কৃত মাতৃগাম থেকে প্রালিতে মাতুগাম, সে থেকে প্রাকৃতে মাউগ্গাম, তা থেকে মাউগ, মাগু এবং মাগী (পুরনো বানানে)। রাল্‌ফ লিলি টার্নারের ইন্দো-আর্য ভাষার তুলনামূলক অভিধানেও প্রায় একই ব্যুৎপত্তি। হরিচরণের মতে শব্দটি মাগ-এর সাথে ই যোগে নিষ্পন্ন, মাগ এসেছে মাউগ বা মাগু থেকে, মৈথিলিতে মৌগী বা মাগু দুইয়েরই অর্থ নারী। সুকুমার সেনের ব্যুৎপত্তি-সিদ্ধার্থে শব্দটি মার্গিতা থেকে যার অর্থ মাগিবার জিনিস। বিজয়চন্দ্র মজুমদারের মতে শব্দটি মাউগি থেকে এসেছে। বিহারে শব্দটি এখনও চলে। তবে আদি শব্দ দ্রবিড় মুক্কণ্, মোক্কন্ বা মোগ্‌গন্। ওড়িয়াতে মাইকিনা। টমাস বারো এবং মারে বার্নসন এম্যনোর দ্রাবিড়ীয় ব্যুৎপত্তির অভিধানে নারী অর্থে মুঙ্কনি পাওয়া যায়।

Monday, July 06, 2009

উদ্বেধী ও-ধ্বনি

হস্‌ চিহ্নের প্রয়োজন অনেক ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য হলেও, এর ব্যবহার (অন্তত গড়পড়তা) বাঙালির কলম থেকে উঠে গেছে অনেক আগে। তাতে করে বিপত্তিও তৈরি হয়েছে অনেক। পৃথক্‌ শব্দটিকে পৃথক লেখার কারণে ব্যাকরণ-অজ্ঞান বাঙালি খুব সহজেই ভুলে যায় যে সন্ধির সময় পরে স্বর থাকলে আগের ক-য়ে হসন্ত গ-এ পর্যবসিত হয়, হবে পৃথগন্ন; তা না করে অনেকেই লিখে ফেলে পৃথকান্ন। পর্ষৎ থেকে হয়েছে পর্ষত, তা থেকে পর্ষতের, যা সর্বৈব ভুল, হবে পর্ষদের। মতুপ্‌ প্রত্যয়-সাধিত শব্দে হস্‌ চিহ্নের ব্যবহার কেবল পুরনো দিনের ছাপায় চোখে পড়ে। এখন শুধু বুদ্ধিমান (বুদ্ধিমান্‌), রুচিবান (রুচিবান্‌), ধীমান (ধীমান্‌), ও বলবান (বলবান্‌)। শানচ্‌ প্রত্যয়-সাধিত শব্দে মান-এ এই হস চিহ্নটিই একমাত্র পার্থক্য: যেমন, রোরুদ্যমান, বহমান, ইত্যাদি। হস্‌ চিহ্ন দিয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণের এই পার্থক্যকে বজায় রাখা-না-রাখা নিয়ে অনেক বিতর্ক বিদ্যমান। যাই হোক, কালের যাত্রায় হস্‌ চিহ্নটির অন্তত এইক্ষেত্রে ঝরে পরবে বলেই মনে হয়।

কিন্তু কলম থেকে হস্‌ চিহ্ন ঝরে পড়ার আগেও হয়ত বাঙালির মুখের বুলি থেকে হস্‌ চিহ্নের ব্যবহার কয়েকটি ক্ষেত্রে উঠে গেছে। কারণ ষড়্‌যন্ত্র, আদিতে উচ্চারণ হয়ত ছিল /ʃɔɽdʒɔntro/ অর্থাৎ শড়্‌যন্ত্রো এবং আইনমাফিক সেটিই ঠিক। তবে এখন দুয়েকজন ছাড়া তেমনটি উচ্চারণ আর কেউই করে না। এখন দস্তুর হল /ʃɔɽodʒontro/ – প্রথম অক্ষরের শেষে একটি উদ্বেধী, বা intrusive, /o/, অর্থাৎ শড়োযন্ত্রো।

ঢাকার বাংলা একাডেমির বানান অভিধানে (যেখানে উচ্চারণ দেওয়া আছে) ষট্‌ক (ইংরেজিতে যাকে sestet বলা হয়) /ʃɔʈko/, ষড়্‌ঋতু /ʃɔɽritu/, ষড়্‌জ /ʃɔɽdʒo/, ষড়্‌দর্শন /ʃɔɽdɔrʃon/, ষড়্‌যন্ত্র /ʃɔɽdʒontro/, ষড়্‌রিপু /ʃɔɽripu/, এবং ষড়্‌বিধ /ʃɔɽbidʱo/। যদিও একাডেমির উচ্চারণ অভিধানে বিকল্প হিসেবে /ʃɔɽo-/ অনেক ক্ষেত্রে; এই উচ্চারণ অভিধানেই আবার ষটক বিকল্পে /ʃɔtok/। তবে কলিকাতার সাহিত্য সংসদের অভিধানে আবার আর সব ক্ষেত্রে /ʃɔɽo-/ এবং /ʃɔɽ-/-এর বিকল্প দেওয়া থাকলেও, ষড়্‌যন্ত্রের উচ্চারণ কেবল /ʃɔɽodʒontro/।

Wednesday, July 01, 2009

ঘুণ্টিঘর বা ঘুমটিঘর

ছোটবেলার স্কুলের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাকে কেটে দিয়ে যেন চলে গেছে রেললাইন। তৈরি হয়েছে level crossing, বাংলায় যা হরহামেশাই রেলক্রসিং নামে পরিচিত। রেললাইনের দু'ধারে রাস্তার উপর দু'টি লোহার পাইপ। ট্রেন যাওয়া-আসার সময় নামানো হয়; পরে তুলে দেওয়া হয় যেন রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করা যায়। পুরোটার নাম অন্তত বাংলায় রেলগেট। সেই রেলগেটের পাশে লাল-ইঁটের একটি ছোট ঘর। একজন রেলের কর্মচারীও হয়ত থাকে। সবাই বলে সেইটেই নাকি ঘুণ্টিঘর, যেখান থেকে ট্রেনের যাওয়া-আসার ঘণ্টা বাজানো হয়। ঘুমটিঘর কথাটিও শোনা যায়।

পুরনো প্রায় সব অভিধানেই ঘুণ্টী শব্দের অর্থ ছোট ঘণ্টা বা বোতাম। কিন্তু ঘুণ্টী- বা ঘুণ্টিঘর শব্দটি পাওয়া যায় না। জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং বাংলা একাডেমির মতে ঘুণ্টিঘর হল (জামায়) বোতামের ঘর। বোতামের ঘর অর্থে ঘুণ্টিঘরাও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে ঘুণ্টিঘর শব্দটিকে রাজশাহীর বলে দেখানো হয়েছে, অর্থ রেলের ক্রসিং, সাথে আছে ঘণিট শব্দটি দেখার নির্দেশ, যাকে রংপুরের বলে দেখানো হয়েছে, অর্থ রেল খালাসিদের থাকার ঘর। সেই একই অভিধানে ঘুনটি দোআন অর্থ চট্টগ্রামের ভাষায় পানের দোকান। হিন্দিতে घुमटी (ঘুমটী)-র দেখা মেলে, पुलिस की घुमटी (পুলিস কী ঘুমটী, পুলিশের ঠেক)।

Tuesday, June 30, 2009

আণ্টাঘরের ময়দান আর (আফিঙের) গুলি

ঢাকার একটি মাঠের নাম আণ্টাঘরের (নাকি আন্টাঘরের?) ময়দান, অবশ্য এখন কেবলই মুখের কথায়। দুয়েক জায়গায় আণ্ডাঘর কথাটাও দেখা যায়, কারণটা বোধ করি আণ্টা বলে কোনও শব্দ বাঙালির মুখে এখন আর শোনা যায় না, কিন্তু আণ্ডা, ডিম অর্থে, খুবই কাছের। জায়গাটির গাল-ভারী নাম বাহাদুর শাহ পার্ক। আর ১৯৫৭ সালের আগে লোকে বলত ভিক্টোরিয়া পার্ক, ১৮৫৮ থেকে; কারণ রানি ভিক্টোরিয়া শাসনভার গ্রহণ করার কথা এই জায়গায় পড়ে শোনানো হয়েছিল। ১৯৫৭ নামটি পালটানো হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহের সময় যাদের ময়দানের গাছে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল তাদের স্মরণে।

যাই হোক, আণ্টাঘর কেন? অনেক বইয়ে চোখে পড়ে যে সে সময় স্থানীয় লোকেরা বিলিয়ার্ডের বলকে আণ্টা বলত, আণ্ডা থেকে; এবং এইখানে আর্মেনীয়দের একটি বিলিয়ার্ড খেলার ঘর ছিল আর তাই আণ্টাঘর। কিন্তু তখন স্থানীয় লোকেরাই কেবল আণ্টা বলত এই কথাটি ঠিক নয়। কারণ শব্দটি হিন্দুস্তানি, অণ্টা, হিন্দিতে अंटा সে থেকে अंटाघर আর উর্দুতে انٹا সে থেকে انٹا گهر। আণ্টা শব্দটি প্ল্যাট্‌সের উর্দু অভিধানে আর শ্যামসুন্দর দাসের ‘হিন্দী শব্দসাগর’ অভিধানে আছে। ব্যুৎপত্তি — সংস্কৃত অণ্ড তার থেকে প্রাকৃত অণ্ডঅ এবং সেখান থেকে অণ্টা বা আণ্টা, অর্থ বল বা (আফিঙের) গুলি । শ্যামসুন্দরে পাওয়া যায় আণ্টাঘর, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর অর্থে। সে আমলে ইংরেজ কর্মকর্তাদের লেখায়ও আণ্টাঘর শব্দটির হদিস মেলে।

Saturday, June 13, 2009

চীনা ভাষার কথকতা

চীনা ভাষায় বাংলাদেশকে বলা হয় 孟加拉国, ফিনিন (pinyin) mèng jiā lā guó; আর বাংলা ভাষাকে 孟加拉语, (ফিনিন mèng jiā lā yǔ)। Mèng jiā lā সম্ভবত বাঙ্গালাহ্‌ (সুলতানি) থেকে, সে সময়ের কোনও চীনা রাজবংশের আমলের অনুবাদ; আর guó অর্থ দেশ; অর্থ ভাষা। অনভ্যস্ততার কারণে অনেকের কাছেই mèng jiā lā শব্দটির উচ্চারণ খানিকটা মুনজালা-র মত ঠেকে, যদিও আসল উচ্চারণটা প্রায় (যথেষ্ট জ্ঞানের অভাবে ‘প্রায়’) /mɤ˥˩ŋtɕɑ˥˥lɑ˥˥/, প্রথম অক্ষরের স্বরটি সংবৃত-মধ্য অবর্তুল পশ্চাৎধ্বনি।

যাই হোক এই চীনা ভাষার শব্দ বাংলায় লেখা খুব কঠিন, কারণ এতে চ বা ছ ধ্বনিমূল হিসেবে দুই ধরণের, আর সহধ্বনি হিসেবে তিন ধরণের ts (z), ʈʂ (zh), tɕ (j), tsʰ (c), ʈʂʰ (ch), এবং tɕʰ (q); বন্ধনীর হরফ ফিনিনের; তৃতীয়টি দ্বিতীয়টির এবং ষষ্ঠটি পঞ্চমটির সহধ্বনি। তালিকার প্রথমটি দন্তমূলীয় ঘৃষ্টধ্বনি, তৃতীয়টি প্রতিবেষ্টিত ঘৃষ্টধ্বনি আর পঞ্চমটি দন্তমূল-তালব্য ঘৃষ্টধ্বনি। বাংলা হরফে লিখতে গেলে অসুবিধা। অগত্যা ৎস, ট্ষ এবং ট্শ় হিসেবে লিখতে হয়। তারপরেও উচ্চারণে পার্থক্য করা বাঙালির জিহ্বায় এবং কানে বেশ কঠিন। আরও একটি ব্যঞ্জনধ্বনি যার ভাষাতত্ত্বে নাম প্রতিবেষ্টিত নৈকট্যক বেশ বিপদে ফেলে — তামিল ழ এবং মলয়ালম ഴ-এর ধ্বনিটি। মাংস অর্থে চীনা শব্দ 肉 (ফিনিন ròu) /ɻou̯˥˩/-এর প্রথম ব্যঞ্জনধ্বনিটি। স্বরধ্বনির ক্ষেত্রেও কয়েকটি কঠিন উচ্চারণ দেখা যায়, বিশেষ করে বাঙালির কান এবং জিহ্বার জন্য; সংবৃত-মধ্য অবর্তুল ধ্বনি তাদের মধ্যে অন্যতম।

ম্যান্ডারিন চীনা ভাষা যা কিনা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রধান ভাষা তাতে অক্ষর শুরু হয় ২১টি ব্যঞ্জনধ্বনির যে কোন একটি দিয়ে আর শেষ হয় ৩৫টি স্বর বা অনুনাসিক স্বরের যে কোন একটি দিয়ে। সাথে আছে সাতটি বিশেষ অক্ষর। সব মিলিয়ে ৪১৩টি অক্ষর। সাথে চারটি শ্বাসাঘাত যোগ দিলে হয় প্রায় ১,৬০০টি অক্ষর। লেখারও আছে রকম ফের। ম্যান্ডারিন চীনা ভাষায় প্রায় ২,০০০টির মত অক্ষর শিখতে হয় সাধারণ কাজ চালাতে গেলে। মোটামুটি শিক্ষিত লোক নাকি প্রায় ৫,০০০টির মত অক্ষরের সাথে পরিচিত। সর্ববৃহৎ অভিধানে আছে এক লাখেরও বেশি অক্ষর।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে সনাতনী অক্ষর বদলে সহজীকৃত অক্ষরে লেখা হয়, যদিও ম্যান্ডারিন নয় এমন চীনা ভাষা অনেকক্ষেত্রে লেখা হয় সনাতন অক্ষরে। ম্যান্ডারিন শব্দটি কিন্তু পর্তুগিজদের অবদান; মান্দারিম বা মান্দারিঁ থেকে, অর্থ সরকারি কর্মকর্তা, অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তাদের ভাষা।

Wednesday, April 01, 2009

আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার পরিভাষা

আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার ছক ১৮৮৮ সালে তৈরি। তখন দেখতে অবশ্য এখনকার ছকের মত ছিল না। প্রথমে হরফ, পরে ইংরেজি, ফরাসি এবং জার্মান শব্দ দিয়ে উচ্চারণের উদাহরণ, তারও পরে অন্য কোনও ভাষার শব্দের উদাহরণ, যদি প্রয়োজন পড়ে। তালিকার মত। তার বর্ণনার ভাষা ইংরেজি, যদিও আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক সংস্থার কার্যক্রম ছিল ফরাসি ভাষায়। সেই ১৮৮৮ সালের তালিকায় ছিল এখন নেই এমন হরফের সঙ্খ্যা মাত্র দুই। তখন ব্যবহৃত হত আর সব হরফই সর্বশেষ ২০০৫ সালের পরিমার্জিত ছকে আছে, তবে অনেক ক্ষেত্রে তাদের মানও পাল্টে গেছে। তখন সাতটির মত হরফ ছিল তারকা-চিহ্নিত, যার অর্থ সাময়িকভাবে ব্যবহৃত হরফ, যা প্রয়োজন পড়লে পরে পাল্টানো হবে। সেই সাতটির ছয়টি পাল্টে গেছে ২০০৫-এর ছকে।
ধ্বনিমূলের বর্ণনার জন্য ছকে বেশ কিছু শব্দের ব্যবহার করা হয় আর সেগুলোর বাংলাও খুব একটা জুতসই হয় না। এই তালিকাটি বেশ কয়েকটি যেমন ইংরেজি, ফরাসি, জর্মন, রুশ ইত্যাদি ভাষায় পাওয়া যায়। বেশ আগে করা একটি বাংলায় ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার একটি ছক এখানে দেওয়া হল। বাংলা পরিভাষাগুলো যে খুব লাগসই এবং জুতসই হয়েছে তা হয়ত নয়।

Tuesday, March 31, 2009

স্বপ্ন, বাংলার ও ইংরেজির

প্রধান ভাষা পরিবারের মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয়'র দু্ই গুচ্ছ — কেন্তুম আর শতম। কেন্তুম গুচ্ছের জার্মানিক শাখার পশ্চিম জার্মানিক হয়ে নিম্ন জার্মানের একটি ভাষা ইংরেজি। আবার একই পরিবারের শতম গুচ্ছের ইন্দো-ইরানিয়ান শাখার ইন্দো-আর্য হয়ে বাংলা। কিন্তু নাড়ির যোগটা রয়েই গেছে। এই যোগাযোগের এক টা উদাহরণ 'স্বপ্ন'। বাংলা (বা সংস্কৃত) স্বপ্ন শব্দের ইংরেজি জ্ঞাতি হল swefn। অনেক পুরনো ইংরেজি কবিতা The Dream of the Rood-এ আছে: Hwæt! Ic swefna cyst secgan wylle। আধুনিক ইংরেজিতে বলা যায় I am minded to tell a marvellous dream যা কেতকী কুশারী ডাইসনের অনুবাদে ‘অহো! আমি স্বপ্নশ্রেষ্ঠের সংবাদ দিতে উদ্যত।’ মিলটা বেশ স্পষ্ট। পুরনো ইংরেজি সাহিত্যে swefn (নরওয়ের পুরনো ভাষার শব্দ svefn থেকে) শব্দটি দেড়শ'র বেশি বার ব্যবহৃত হয়েছে। তবে পুরনো ইংরেজিতে স্বপ্ন অর্থে বর্তমান dream শব্দটির মানে বোঝাত আনন্দ বা গানবাজনা, এটিও নরওয়ের পুরনো ভাষার শব্দ। মধ্য ইংরেজিতে শব্দটি sweven, অনেক পরের ইংরেজিতেও তাই। জেফ্রি চসারে পাওয়া যায় I trowe no man hadde the wit/To conne wel my sweven rede (আমার বিশ্বাস কারুর এমন জ্ঞান ছিল না যে আমার স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে)। ১৮৮৫ সালের রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টনের আরব্য রজনীর অনুবাদে পাওয়া যায় — [The queen] went in to the Sultan and assured him that their daughter had suffered during all her wedding-night from swevens and nightmare; তবে অর্থটি হয় স্বপ্ন বা ঘুমের মধ্যে দেখতে পাওয়া দৃশ্য।

সংস্কৃতেও স্বপ্নের (स्वप्न) চেয়ে ঘুমের অর্থ প্রধান, অন্তত মনিয়ের-উইলিয়ামসের মতে। ইংরেজি swefn শব্দটির ব্যুৎপত্তি দেখানো হয় প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় *swépnos বা *súpnos থেকে। গ্রিকে ὕπνος (hypnos বা হুপ্নোস)।

Saturday, March 14, 2009

শব্দের সোজা দিক-উল্টো দিক

ইংরেজি palindrome, বাংলায় প্যালিনড্রোম, প্যালিন্ড্রোম-ও লেখা যেতে পারে। এক-কথার বাংলা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থ এমন কোন শব্দ বা শব্দবন্ধ কিংবা বাক্য যা উল্টোদিক থেকে পড়লেও সোজাই মনে হয়। সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে গ্রিক πάλιν (palin অর্থ পিছন) এবং δρóμος (dromos অর্থ দিক) মিলে শব্দ বানানো হয়েছিল ইংরেজিতে। যদিও গ্রিকদের কাছে এই ধরণের শব্দ বা শব্দবন্ধ καρκινική επιγραφή (karkiniké epigrafé, কারকিনিকে এপিগ্রাফে অর্থ কাঁকড়া লেখা) নামে পরিচিত ছিল। তেমনই প্রাচীন গ্রিক একটি শব্দবন্ধ হল ΝΙΨΟΝΑΝΟΜΗΜΑΤΑΜΗΜΟΝΑΝΟΨΙΝ (প্রাচীন গ্রিকে বাক্যের শব্দ আলাদা করে লেখ হত না) (nipson anomemata me monan opsin অর্থ মুখের সাথে আমার পাপও ধুয়ে দাও); লেখা থাকত সাধারণ ফোয়ারার গায়ে। ধ্রুপদী গ্রিকের পরের জমানার প্যালিনড্রোম।

ইংরেজিতে খুব প্রচলিত একটি প্যালিনড্রোম হল Able was I ere I saw Elba (যদিও বলা হয়ে থাকে সম্রাট নাপোলেওনের মুখের কথা, তবুও এ নিয়ে বিবাদ আছে)। ইংরেজিতে প্যালিনড্রোমের অভাব নেই; অভাব নেই ইউরোপের অনেক ভাষাতেই। ফিনিশ ভাষাকে তো প্যালিনড্রোমের ভাষাই বলা হয়। সংস্কৃতেও চতুর্দশ শতকের দৈবজ্ঞ সূর্য পণ্ডিতের লেখা ৪০ শ্লোকের রামকৃষ্ণ বিলোম কাব্যম নামের একটি কবিতা পাওয়া যায় যার প্রতিটি শ্লোক একেকটি প্যালিনড্রোম। উদাহরণ: তামসীত্যসতি সত্যসীমতা মায়য়াক্ষমসমক্ষয়ায়মা। মায়য়াক্ষমসমক্ষয়ায়মা তামসীত্যসতি সত্যসীমতা॥ (৩ নং শ্লোক)। যাই হোক, বাংলায় প্যালিনড্রোম বেশ বিরল। ছোটবেলার প্রায় সবার জানা ‘রমাকান্ত কামার’ ছাড়া আর প্রায় তেমন নেই। তিন অক্ষরের কয়েকটি শব্দ পাওয়া যায়: মধ্যম, নতুন, নবীন, সমাস, মলম, জমজ, দরদ ইত্যাদি। একটু বড়: নবজীবন। কয়েকটি শব্দবন্ধও পাওয়া যায়: ‘থাক রবি কবির কথা,’ ‘বিরহে রাধা নয়ন ধারা হে রবি’ ইত্যাদি; ধারণা করা হয় এ দু'টি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান। আরও দুয়েকটি পাওয়া গেছে, যদিও উৎস জানা নেই: ‘কীর্তন মঞ্চ পরে পঞ্চম নর্তকী’ এবং ‘মার কথা থাক, রমা।’

Wednesday, March 11, 2009

দপ্তর, দিফথেরা থেকে

অফিস বা আগের দিনের বুলিতে যা আপিস তারই বাংলা দফতর। মানে যেখানে খাতাপত্র রাখা হয়। বাংলায় দফতর, দফ্‌তর বা দপ্তর যে বানানেই লেখা হোক না কেন তা আদতে ফারসির دفتر (দফ়তর), হিন্দিতে दफ़्तर; আরবির মাধ্যমে, বানান একই। আরবিতে অর্থ হিসাবের খাতা, যা কিনা বেশ কিছু হিসাবের কাগজ সুতো দিয়ে বাঁধা। আরবিতে শব্দটি গেছে গ্রিক থেকে। গ্রিক ভাষায় διφθέρα (diphthera, দিফথেরা), প্রাচীন গ্রিকে *διψτέρα; অর্থ পাতলা ঝিল্লি বা চামড়া। প্যাপিরাস আসার আগে পর্যন্ত এই পাতলা চামড়া ব্যবহৃত হত লেখার জন্য। ফারসিতে অফিস অর্থে দফতরখানার (دفترخانه) ব্যবহারও আছে। সেই গ্রিক থেকেই সম্ভবত হিব্রুতে daftar বা diftar (דפתר), লেখার খাতা; আদি গ্রিক diphthera হিব্রুতেও পাওয়া যায় — diftera (דפתרא), সেই গ্রিক অর্থেই। ইংরেজিতে daftar শব্দটির দেখা মেলে ১৭৭৬ সালে। বাংলায় ইংরেজি headquarters অর্থে সদরদপ্তর প্রচলিত আছে।

ফারসিতে দফতরী (دفتری) শব্দের অর্থ দফতরের লোক, যদিও বাংলায় দফতরী (সাধারণত দপ্তরী) বলতে আর্দালি বোঝানো হয়। হিন্দিতে दफ़्तरी বলতে অফিস সঙ্ক্রান্ত (दफ़्तरी कामकाज, দফ়তরী কামকাজ, অফিসের কাজ) কিংবা অফিসে কাজ করে (प्रेस के एक दफ़्तरी, প্রেস কি এক দফ়তরী, প্রেসের এক কর্মচারী) বা বই বাঁধাই করে এমন লোককে বোঝায়।

Tuesday, March 10, 2009

ইংরেজির বিশেষণ, বাংলায় বিশেষ্য?

গ্রামদেশে একসময় প্রায় সবাই বলত এবং এখনও অনেকেই ব'লে থাকে যে লোকটির বাসা জেলা প্রোপারে, হয়ত বা শুধুই প্রোপারে অথবা জায়গাটা থানা প্রোপার থেকে বেশ দূর। শব্দটি ইংরেজি, তবে অর্থ খানিকটা বাংলায় প্রচলিত আরবি সদর (صدر) এর মত। কেন্দ্র, প্রধান ইত্যাদি অর্থে। হিন্দিতে যে অর্থে বলা হয় सदरबाज़ार (সদরবাজার) বা উর্দুতে صدر بازار, অর্থাৎ প্রধান বাজার। বাংলায় বলা হয় জেলার বা জেলা সদর শহর, সঙ্ক্ষেপে জেলার বা জেলা সদর; আর সে থেকে উপজেলা সদর বা থানা সদর; যা কিনা মফস্‌সল (পুরনো বানানে মফস্বল এবং এটিও একটি আরবি শব্দ, مفصل; অর্থ সদর ছাড়া জেলার আর সব এলাকা)-এর বিপরীত। ইংরেজিতে কোনও স্থানবাচক শব্দের পরে proper বিশেষণটি বসলে তার অর্থ দাঁড়ায় সেই জায়গার মূল এলাকা বা কেন্দ্র। বাংলার ক্ষেত্রে ইংরেজির এই proper /ˈprɒpə/ উচ্চারণ পাল্টে প্রোপার /propɑr/ এবং যদি ধরে নিতে হয় যে ইংরেজি ব্যাকরণের বিশেষ্য-পরবর্তী বিশেষণের ব্যবহার বাংলায় একদমই চলে না, তাহলে বলতে হবে ইংরেজিতে শব্দটি বিশেষণ হলেও বাংলায় তা বিশেষ্য এবং এর আগের জেলা বা থানা শব্দটি তার বিশেষণ।