Tuesday, March 31, 2009

স্বপ্ন, বাংলার ও ইংরেজির

প্রধান ভাষা পরিবারের মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয়'র দু্ই গুচ্ছ — কেন্তুম আর শতম। কেন্তুম গুচ্ছের জার্মানিক শাখার পশ্চিম জার্মানিক হয়ে নিম্ন জার্মানের একটি ভাষা ইংরেজি। আবার একই পরিবারের শতম গুচ্ছের ইন্দো-ইরানিয়ান শাখার ইন্দো-আর্য হয়ে বাংলা। কিন্তু নাড়ির যোগটা রয়েই গেছে। এই যোগাযোগের এক টা উদাহরণ 'স্বপ্ন'। বাংলা (বা সংস্কৃত) স্বপ্ন শব্দের ইংরেজি জ্ঞাতি হল swefn। অনেক পুরনো ইংরেজি কবিতা The Dream of the Rood-এ আছে: Hwæt! Ic swefna cyst secgan wylle। আধুনিক ইংরেজিতে বলা যায় I am minded to tell a marvellous dream যা কেতকী কুশারী ডাইসনের অনুবাদে ‘অহো! আমি স্বপ্নশ্রেষ্ঠের সংবাদ দিতে উদ্যত।’ মিলটা বেশ স্পষ্ট। পুরনো ইংরেজি সাহিত্যে swefn (নরওয়ের পুরনো ভাষার শব্দ svefn থেকে) শব্দটি দেড়শ'র বেশি বার ব্যবহৃত হয়েছে। তবে পুরনো ইংরেজিতে স্বপ্ন অর্থে বর্তমান dream শব্দটির মানে বোঝাত আনন্দ বা গানবাজনা, এটিও নরওয়ের পুরনো ভাষার শব্দ। মধ্য ইংরেজিতে শব্দটি sweven, অনেক পরের ইংরেজিতেও তাই। জেফ্রি চসারে পাওয়া যায় I trowe no man hadde the wit/To conne wel my sweven rede (আমার বিশ্বাস কারুর এমন জ্ঞান ছিল না যে আমার স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে)। ১৮৮৫ সালের রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টনের আরব্য রজনীর অনুবাদে পাওয়া যায় — [The queen] went in to the Sultan and assured him that their daughter had suffered during all her wedding-night from swevens and nightmare; তবে অর্থটি হয় স্বপ্ন বা ঘুমের মধ্যে দেখতে পাওয়া দৃশ্য।

সংস্কৃতেও স্বপ্নের (स्वप्न) চেয়ে ঘুমের অর্থ প্রধান, অন্তত মনিয়ের-উইলিয়ামসের মতে। ইংরেজি swefn শব্দটির ব্যুৎপত্তি দেখানো হয় প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় *swépnos বা *súpnos থেকে। গ্রিকে ὕπνος (hypnos বা হুপ্নোস)।

Saturday, March 14, 2009

শব্দের সোজা দিক-উল্টো দিক

ইংরেজি palindrome, বাংলায় প্যালিনড্রোম, প্যালিন্ড্রোম-ও লেখা যেতে পারে। এক-কথার বাংলা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থ এমন কোন শব্দ বা শব্দবন্ধ কিংবা বাক্য যা উল্টোদিক থেকে পড়লেও সোজাই মনে হয়। সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে গ্রিক πάλιν (palin অর্থ পিছন) এবং δρóμος (dromos অর্থ দিক) মিলে শব্দ বানানো হয়েছিল ইংরেজিতে। যদিও গ্রিকদের কাছে এই ধরণের শব্দ বা শব্দবন্ধ καρκινική επιγραφή (karkiniké epigrafé, কারকিনিকে এপিগ্রাফে অর্থ কাঁকড়া লেখা) নামে পরিচিত ছিল। তেমনই প্রাচীন গ্রিক একটি শব্দবন্ধ হল ΝΙΨΟΝΑΝΟΜΗΜΑΤΑΜΗΜΟΝΑΝΟΨΙΝ (প্রাচীন গ্রিকে বাক্যের শব্দ আলাদা করে লেখ হত না) (nipson anomemata me monan opsin অর্থ মুখের সাথে আমার পাপও ধুয়ে দাও); লেখা থাকত সাধারণ ফোয়ারার গায়ে। ধ্রুপদী গ্রিকের পরের জমানার প্যালিনড্রোম।

ইংরেজিতে খুব প্রচলিত একটি প্যালিনড্রোম হল Able was I ere I saw Elba (যদিও বলা হয়ে থাকে সম্রাট নাপোলেওনের মুখের কথা, তবুও এ নিয়ে বিবাদ আছে)। ইংরেজিতে প্যালিনড্রোমের অভাব নেই; অভাব নেই ইউরোপের অনেক ভাষাতেই। ফিনিশ ভাষাকে তো প্যালিনড্রোমের ভাষাই বলা হয়। সংস্কৃতেও চতুর্দশ শতকের দৈবজ্ঞ সূর্য পণ্ডিতের লেখা ৪০ শ্লোকের রামকৃষ্ণ বিলোম কাব্যম নামের একটি কবিতা পাওয়া যায় যার প্রতিটি শ্লোক একেকটি প্যালিনড্রোম। উদাহরণ: তামসীত্যসতি সত্যসীমতা মায়য়াক্ষমসমক্ষয়ায়মা। মায়য়াক্ষমসমক্ষয়ায়মা তামসীত্যসতি সত্যসীমতা॥ (৩ নং শ্লোক)। যাই হোক, বাংলায় প্যালিনড্রোম বেশ বিরল। ছোটবেলার প্রায় সবার জানা ‘রমাকান্ত কামার’ ছাড়া আর প্রায় তেমন নেই। তিন অক্ষরের কয়েকটি শব্দ পাওয়া যায়: মধ্যম, নতুন, নবীন, সমাস, মলম, জমজ, দরদ ইত্যাদি। একটু বড়: নবজীবন। কয়েকটি শব্দবন্ধও পাওয়া যায়: ‘থাক রবি কবির কথা,’ ‘বিরহে রাধা নয়ন ধারা হে রবি’ ইত্যাদি; ধারণা করা হয় এ দু'টি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান। আরও দুয়েকটি পাওয়া গেছে, যদিও উৎস জানা নেই: ‘কীর্তন মঞ্চ পরে পঞ্চম নর্তকী’ এবং ‘মার কথা থাক, রমা।’

Wednesday, March 11, 2009

দপ্তর, দিফথেরা থেকে

অফিস বা আগের দিনের বুলিতে যা আপিস তারই বাংলা দফতর। মানে যেখানে খাতাপত্র রাখা হয়। বাংলায় দফতর, দফ্‌তর বা দপ্তর যে বানানেই লেখা হোক না কেন তা আদতে ফারসির دفتر (দফ়তর), হিন্দিতে दफ़्तर; আরবির মাধ্যমে, বানান একই। আরবিতে অর্থ হিসাবের খাতা, যা কিনা বেশ কিছু হিসাবের কাগজ সুতো দিয়ে বাঁধা। আরবিতে শব্দটি গেছে গ্রিক থেকে। গ্রিক ভাষায় διφθέρα (diphthera, দিফথেরা), প্রাচীন গ্রিকে *διψτέρα; অর্থ পাতলা ঝিল্লি বা চামড়া। প্যাপিরাস আসার আগে পর্যন্ত এই পাতলা চামড়া ব্যবহৃত হত লেখার জন্য। ফারসিতে অফিস অর্থে দফতরখানার (دفترخانه) ব্যবহারও আছে। সেই গ্রিক থেকেই সম্ভবত হিব্রুতে daftar বা diftar (דפתר), লেখার খাতা; আদি গ্রিক diphthera হিব্রুতেও পাওয়া যায় — diftera (דפתרא), সেই গ্রিক অর্থেই। ইংরেজিতে daftar শব্দটির দেখা মেলে ১৭৭৬ সালে। বাংলায় ইংরেজি headquarters অর্থে সদরদপ্তর প্রচলিত আছে।

ফারসিতে দফতরী (دفتری) শব্দের অর্থ দফতরের লোক, যদিও বাংলায় দফতরী (সাধারণত দপ্তরী) বলতে আর্দালি বোঝানো হয়। হিন্দিতে दफ़्तरी বলতে অফিস সঙ্ক্রান্ত (दफ़्तरी कामकाज, দফ়তরী কামকাজ, অফিসের কাজ) কিংবা অফিসে কাজ করে (प्रेस के एक दफ़्तरी, প্রেস কি এক দফ়তরী, প্রেসের এক কর্মচারী) বা বই বাঁধাই করে এমন লোককে বোঝায়।

Tuesday, March 10, 2009

ইংরেজির বিশেষণ, বাংলায় বিশেষ্য?

গ্রামদেশে একসময় প্রায় সবাই বলত এবং এখনও অনেকেই ব'লে থাকে যে লোকটির বাসা জেলা প্রোপারে, হয়ত বা শুধুই প্রোপারে অথবা জায়গাটা থানা প্রোপার থেকে বেশ দূর। শব্দটি ইংরেজি, তবে অর্থ খানিকটা বাংলায় প্রচলিত আরবি সদর (صدر) এর মত। কেন্দ্র, প্রধান ইত্যাদি অর্থে। হিন্দিতে যে অর্থে বলা হয় सदरबाज़ार (সদরবাজার) বা উর্দুতে صدر بازار, অর্থাৎ প্রধান বাজার। বাংলায় বলা হয় জেলার বা জেলা সদর শহর, সঙ্ক্ষেপে জেলার বা জেলা সদর; আর সে থেকে উপজেলা সদর বা থানা সদর; যা কিনা মফস্‌সল (পুরনো বানানে মফস্বল এবং এটিও একটি আরবি শব্দ, مفصل; অর্থ সদর ছাড়া জেলার আর সব এলাকা)-এর বিপরীত। ইংরেজিতে কোনও স্থানবাচক শব্দের পরে proper বিশেষণটি বসলে তার অর্থ দাঁড়ায় সেই জায়গার মূল এলাকা বা কেন্দ্র। বাংলার ক্ষেত্রে ইংরেজির এই proper /ˈprɒpə/ উচ্চারণ পাল্টে প্রোপার /propɑr/ এবং যদি ধরে নিতে হয় যে ইংরেজি ব্যাকরণের বিশেষ্য-পরবর্তী বিশেষণের ব্যবহার বাংলায় একদমই চলে না, তাহলে বলতে হবে ইংরেজিতে শব্দটি বিশেষণ হলেও বাংলায় তা বিশেষ্য এবং এর আগের জেলা বা থানা শব্দটি তার বিশেষণ।