Sunday, September 30, 2007

বাংলার রোমক বর্ণমালা

যেখানে বাংলার জন্য বঙ্গলিপি ব্যবহার করা যায় না এমন ক্ষেত্রে রোমক হরফের ব্যবহার করা হয় হামেশাই। ইংরেজিতে বা রোমক হরফ ব্যবহার করে এমন যে কোন ভাষার কোনও বইয়ে এবং ইংরেজি খবরের কাগজে প্রতিনিয়ত। আগের সংস্কৃত লেখার নিয়মে পুরোপুরি বাংলা লেখা যায় না বিধায় আন্তর্জাতিক মান সংস্থা ২০০১ সালে 'আমাস ১৫৯১৯: দেবনাগরী এবং সম্পর্কিত ইন্দীয় লেখার লাতিন হরফে প্রতিবর্ণীকরণ' নামের এক পদ্ধতি চালু করে। এই নিয়মে বঙ্গলিপির রোমক প্রতি-হরফ গুলো হল: অ (a), আ (ā), ই (i), ঈ (ī), উ (u), ঊ (ū), ঋ (r̥), এ (e), ঐ (ai), ও (o), ঔ (au), ক (k), খ (kh), গ (g), ঘ (gh), ঙ (ṅ), চ (c), ছ (ch), জ (j), ঝ (jh), ঞ(ñ), ট (ṭ), ঠ (ṭh), ড (ḍ), ঢ (ḍh), ণ (ṇ), ত (t), থ (th), দ (d), ধ (dh), ন (n), প (p), ফ (ph), ব (b), ভ (bh), ম (m), য (y), র (r), ল (l), শ (ś), ষ (ṣ), স (s), হ (h), ড় (ṛ), ঢ় (ṛh), য় (ẏ), ৎ (t[:]), ং (ṁ), ঃ (ḥ), এবং ঁ (m̐) (স্বরের সাথে ~, উপরে বসবে)। সাথে যে নিয়মগুলো মানতে হবে তা হল প্রতিটি অন্তর্নিহিত অ লিখতে হবে; এই অ-এর অনুপস্থিতি বিরাম (হস বা হল) চিহ্ন হিসেবে পরের ব্যঞ্জনের সাথে মিলে যুক্তাক্ষর তৈরি করবে। যদি কখনও বিরাম চিহ্নের কারণে অনিভপ্রেত অক্ষর তৈরি হয় তা ঠিক করার জন্য দুই অক্ষরেরর মাঝে বা কোনও অক্ষরের আগে কোলন (:) চিহ্নের ব্যবহার করতে হবে, যেমন বই (ba:i) বা বৈ (bai)। যে কোনও ব্যঞ্জনের সাথে য-ফলার জন্য y হলেও য-এ য-ফলার জন্য ẏẏ ব্যবহার করতে হবে। যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত থাকবে আর সঙ্খ্যা হিন্দু-আরবি সঙ্খ্যায় রূপান্তরিত হবে। যদি কখনও কম্পিউটারে ASCII-তে লিখতে হয় তার জন্য রোমক বর্ণমালাটি হল: অ (a), আ (aa), ই (i), ঈ (ii), উ (u), ঊ (uu), ঋ (,r), এ (e), ঐ (ai), ও (o), ঔ (au), ক (k), খ (kh), গ (g), ঘ (gh), ঙ (;n), চ (c), ছ (ch), জ (j), ঝ (jh), ঞ(~n), ট (.t), ঠ (.th), ড (.d), ঢ (.dh), ণ (.n), ত (t), থ (th), দ (d), ধ (dh), ন (n), প (p), ফ (ph), ব (b), ভ (bh), ম (m), য (y), র (r), ল (l), শ (;s), ষ (.s), স (s), হ (h), ড় (.r), ঢ় (.rh), য় (;y), ৎ (t[:]), ং (;m), ঃ (.h), এবং ঁ (~m) (স্বরের সাথে ~, আগে বসবে)।

ছাপার জন্য রোমক বর্ণমালায় বাংলার উদাহরণ: haẏato dekhibe ceẏe sudarśana uṛiteche sandhyāra bātāse. / haẏato śunibe eka lakṣmīpẽcā ḍākiteche śimūlera ḍāle. বা ASCII-তে ha;yato dekhibe ce;ye surar;sana u.riteche sandhyaara baataase. / ha;yato ;sunibe eka lak.smiip~ecaa .daakiteche ;simuulera .daale. (হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে। / হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে)।

ইংরেজি পত্রিকায় বা খবরের কাগজে বা খানিকটা সরকারি কাজে যেখানে প্রতিবর্ণীকরণ কঠিনভাবে মানার প্রয়োজন নেই, সেখানের নিয়মটা একটু আলাদা। ১৮৭১ সালে ভারতের পরিসঙ্খ্যান মহাপরিচালক উইলিয়াম উইলসন হান্টার 'ভারতীয় নামের বানানের নির্দেশিকা'য় তারই ১৮৬০ সালের দিকে তৈরি করা এক লিপ্যন্তরীকরণ পদ্ধতির প্রকাশ করে। পরের বছর ভারত সরকার তা গ্রহণ করে। সেই হান্টারীয় (Hunterian) পদ্ধতিতে দীর্ঘ স্বরের উপরে মাত্রা (macron) বসবে (যদিও সার্ভে অব বাংলাদেশ গেল শতাব্দীর আশির দশক থেকে স্থানের নামের বানানের ক্ষেত্রে এই মাত্রা আর ব্যবহার করে না): অ (a), আ (ā/a), ই (i), ঈ (ī/i), উ (u), ঊ (ū/u), ঋ (ri), এ (e), ঐ (ai), ও (o), ঔ (au), ক (k), খ (kh), গ (g), ঘ (gh), ঙ (ng), চ (ch), ছ (chh), জ (j), ঝ (jh), ঞ(ny), ট (t), ঠ (th), ড (d), ঢ (dh), ণ (n), ত (t), থ (th), দ (d), ধ (dh), ন (n), প (p), ফ (ph), ব (b), ভ (bh), ম (m), য (y), র (r), ল (l), শ (s/sh), ষ (sh), স (s), হ (h), ড় (r), ঢ় (rh), য় (ẏ), ৎ (t), ং (m/n), ঃ (h), এবং ঁ (m)। উচ্চারিত না হলে অন্তর্নিহিত অ লেখা হয় না। জ্ঞ কে gy লেখা হয়।

Friday, September 28, 2007

রোমক হরফে বাংলা

রোমক হরফে বাংলা লেখার চল অনেক পুরনো। ১৮৯৪ সালে জেনেভায় এক সংস্কৃতজ্ঞ সম্মেলনে রোমক হরফে সংস্কৃত কি ভাবে লেখা হবে তা ঠিক করা হয়। সেই নিয়ম মেনেই রোমক হরফে বাংলাও লেখা হচ্ছিল এতকাল। তারও আগে ১৭৪৩ সালে লিসবন থেকে ছাপানো বাংলার প্রথম ব্যাকরণ বই কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ (Crepar Xaxtrer Orth,bhed,)-এ ঢাকার ভাওয়াল অঞ্চলের বাংলার যে উদাহরণ দেওয়া আছে তাও রোমক হরফে, পর্তুগিজের পঠনরীতি অনুযায়ী লেখা — পিতা আমারদিগের, পরম স্বর্গে আসল। তোমার সিদ্ধি নামেরে সেবা হউক: আইসুক আমারদিগেরে তোমার রাইজ্যত [রাজ্যে]: তোমার যে ইচ্ছা, সেই হউক: যেমন পরথিবীতে [পৃথিবীতে], তেমন স্বর্গে। (Pitá amaradiguer,/ Poromo xorgué aslo./ Tomar xidhi nameré,/ Xeba houq:/ Aixuq amardigueré/ Tomar raizot:/ Tomar zé icha,/ Xei houq:/ Zemon porthibité,/ Temon xorgué.) [আধুনিক বানানে বাংলায় লেখা হল]। এরপর ১৮০৩ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাপানো জন বোর্থউইক গিলক্রাইস্ট সম্পাদিত ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট নামের এক বইয়ে তারিণীচরণ মিত্রকৃত ঈশপের একটি গল্পের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয় রোমক হরফে। ১৮৮১ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী ছেপে বের হয় রোমক হরফে। এরপর ১৯৭১ সালে সুকুমার সেনের ইংরেজিতে লেখা বাংলাভাষার ব্যুৎপত্তিকোষেও (An Etymological Dictionary of Bengali) বাংলা শব্দ রোমক হরফে লেখা। মাঝে পুরো বই রোমক হরফে ছেপে বের না হলেও এই হরফে সংস্কৃত এবং বাংলা কি করে লেখা যায় তার দিক নির্দশনা দিয়েছে আর্থার কোক বার্নেল বা কার্ল রিকার্ড লেপ্‌সিউস-এর মত আরও অনেকেই।

সেই সংস্কৃতজ্ঞদের নিয়ম যা এখন আন্তর্জাতিক সংস্কৃত প্রতিবর্ণীকরণ বর্ণমালা (International Alphabet of Sanskrit Transliteration) নামে পরিচিত, তাতে অবশ্য বাংলা লেখায় কিঞ্চিৎ অসুবিধা হয়। কারণ সংস্কৃতে বাংলার মত য়, ড় এবং ঢ় নেই। রোমক y দিয়ে সংস্কৃত য (य) এবং বাংলা য এবং য়, আর ṛ (r এর নিচে বিন্দু) দিয়ে সংস্কৃত ঋ (ऋ) এবং বাংলা ঋ এবং ড় লেখা হয়। সমস্যা হল পাঠককে বুঝে নিতে হয় একই হরফ কখন য এবং কখন য়, বা কখন ঋ এবং কখন ড়। এ সমস্যা দূর করতে আন্তর্জাতিক মান সংস্থার প্রবর্তিত আমাস ১৫৯১৯: দেবনাগরী এবং সম্পর্কিত ইন্দীয় লেখার লাতিন হরফে প্রতিবর্ণীকরণ (ISO 15919 Transliteration of Devanagari and related Indic scripts into Latin characters) পদ্ধতিতে y এর উপর বিন্দু ẏ দিয়ে য় এবং y দিয়ে য বোঝানো হয় আর r এর নিচে বিন্দু ṛ দিয়ে ড় এবং r এর নিচে বৃত্ত r̥ দিয়ে ঋ বোঝানো হয়। সমস্ত নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার ক্ষেত্রে একই নিয়ম। অনুস্বারের ক্ষেত্রে রোমক সংস্কৃত হরফের ṃ-এর নিচের বিন্দু উপরে উঠে ṁ আসে।

Saturday, September 22, 2007

বাংলার যতিচিহ্ন

বাংলার দাঁড়িই, দুই দাঁড়িও, কেবল নিজস্ব যতিচিহ্ন। বাকি সব বাংলায় এসেছে ইংরেজির অনুকরণে। নিয়মিত হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে। মধ্য বাংলায় বিরামের জন্য ব্যবহৃত হত তারকা চিহ্ন (*)। পরে সে স্থানে ব্যবহৃত হতে থাকে দাঁড়ি। দুই দাঁড়ি ছিল সাধারণত কবিতার সম্পত্তি, আগের যুগে। বর্তমানে তা টাইপোগ্রাফিক এমবেলিশমেন্ট। বাংলায় আরেকটি চিহ্নের ব্যবহার ছিল, মধ্যযুগেও। তার নাম কাকপদ (×)। প্রতিলিপির সময় কোথাও কিছু বোঝা না গেলে বা কোনও কিছু আমলে না নিলে, এখন যেমন ইংরেজি লোপচিহ্নের আদলে তিন-বিন্দু (...) ব্যবহার করা হয়, তখন বাংলা গুণনচিহ্নের মত তিনটি কাকপদ ব্যবহার করা হত।

বিদ্যাসাগরের বেতাল পঞ্চবিংশতির দশম সংস্করণ থেকে ইংরেজির আদলে যতি চিহ্নের ব্যবহার দেখা যায়। একদম শুরুর দিকে, ১৮৪০ সালে হিন্দু কলেজ পাঠশালাতে পড়ানোর জন্য 'শিশুসেবধি' নামের একটি প্রাইমার বা অ-আ-ক-খ'র বই ছাপানো হয়। এতে যতিচিহ্নের বর্ণনায় বলা আছে বাক্যের ভেদ বোধক রেখার নাম 'চিহ্ন' (,), বিচ্ছেদ ভেদবোধক রেখার নাম 'দাঁড়ি' (।) এবং লেখক কিংবা বক্তার কৃত যে প্রয়োগ তদ্বোধক চিহ্নের নাম 'অবিকল' (“”), যা এখন উদ্ধার চিহ্ন নামে পরিচিত।

নামগুলো পরে পালটে গিয়ে দাঁড়ায় পদচ্ছেদ (,), অর্ধচ্ছেদ (;), পূর্ণচ্ছেদ (।), দৃষ্টান্তচ্ছেদ (:), প্রশ্নচিহ্ন (?), বিস্ময়চিহ্ন (!), রেখাচিহ্ন (—), উদ্ধারচিহ্ন (“”) এবং পদযোজকচিহ্ন (-)। একসময় আবার বলা হত প্রাথমিকা (,), সামিকা (;)। কখনও বা কোলন ভুল করে বিসর্গ মনে না হয় তাই সাথে একটি ড্যাশ ব্যবহার করা শুরু হয়ে গিয়েছিল, নাম তার কোলন-ড্যাশ।

Friday, September 21, 2007

বাংলার হরফ, সংস্কৃতের বর্ণমালা

বাংলার হরফ নিজস্ব, তবে বর্ণমালা নিজের নয়। সংস্কৃত বর্ণক্রম বাংলার উপর চাপিয়ে দেওয়া, বা নেওয়া। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পর থেকে দুয়েকটি হরফের অবস্থান বদল।, মান্য বর্ণমালায় দু-একটি হরফের লুপ্তি। বাংলার এই হরফ তার নিজস্ব হলেও গোটা চারেক ভাষা লেখার কাজে তা ব্যবহৃত হয় বা হত। বাংলা হরফে লেখা হয়, বাংলা এবং এর উপভাষা ছাড়াও, অহমিয়া, সংস্কৃত, সাঁওতালি আর মণিপুরি। সংস্কৃতের প্রধান লিপি এখন দেবনাগরীকে ধরা হয়, বিশেষত ইংরেজদের আগমনের পর থেকে। সংস্কৃতর রোমক হরফেও লেখা হয় আর লেখা হয় ভারতীয় বেশ কয়েকটি লিপিতে, তামিল-গোত্রীয় গ্রন্থ লিপি সহ। সাঁওতালি বাংলা ছাড়াও লেখা হয় ইংরেজি, দেবনাগরী এবং ওড়িয়া হরফে। ওল চিকি বলে একটি হরফেও। মণিপুরির এক অংশ যার নাম মৈতৈ তা লেখা হয় মৈতৈ নামের এক হরফে আর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরির হরফ বাংলা। এছাড়াও বাংলা দেশের বেশ কিছু উপজাতির ভাষা যেমন খাসিয়া, আচিক, ককবরক ইত্যাদি বাংলা হরফে লেখা হয়।

বাংলা হরফে লেখা অহমিয়া, সংস্কৃত, সাঁওতালি এবং মণিপুরির উদাহরণ --- 'কিয়নো ঈশ্বরে জগতলৈ এনে প্রেম করিলে, যে, তেওঁর পুত্রত যি কোনোৱে বিশ্বাস করে, সি নষ্ট নহৈ, অনন্ত জীৱন পাবর নিমিত্তে, তেওঁর সেই একজাত পুত্রকেই দান করিলে।' (অহমিয়া)।। 'তদ্বদহং যুষ্মান্‌ ব্যাহরামি, একেন পাপিনা মনসি পরিবর্ত্তিতে, ঈশ্বরস্য দুতানাং মধ্যেহ প্যানন্দো জায়তে।' (সংস্কৃত)।। 'এন্তে ঈশ্বর দ ধারতিরেন কো নুনাঃ এ দুলাড়কেৎ কোআ, আইঃরেন একুপুত হপনে এমকোদেতায়া, যেমন উনিরে সানাম পাতিয়াউঃকো আলোকো নষ্ঠোঃ। বিচকোম জায়জুগ জিওন কো ঞাম।' (সাঁতালি, সাঁতাল পরগণা)।। এবং 'করিননো হাইববু ঈশ্বরনা তাইবংপাম্বা অসিবু অসুপ নুংশিব্বি‍া অসিনি, ইবুংঙো মহাক্বী অনিশুদবা মচা নিপা অদুবু পিবি, মচা অদুবু খাজবা মী পুম্‌নমক্‌ অদুবুদি মাংহনদনা লোম্বা নাইদবা খবাই ফন্দনি।' (মণিপুরি)।।

আসামের উত্তর প্রচলিত রংদানিয়া বা রভা ভাষায় বাংলা হরফের উদাহরণ --- 'আতানা যে কাই ঈশ্বরনি খুসি ছাংয়ে ফুসিয়া, উ আংই ফজাংবারা, আরও আংই মমব্রাতাং, জিব্রা ফজমবারতাং আরও ওনিবারা আরও জিব্রা।' অহমিয়া, সাঁওতালি এবং মণিপুরি বাক্যের বাংলা পাঠ --- 'কারণ ঈশ্বর জগৎকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার একজাতা পুত্রকে দান করিলেন, যেন, যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়।' বাইবেলের পাঠ, হিস্পানি ভাষায় 'বর্তমান ও অতীতের বর্ণমালা' ওয়েব সাইট থেকে নেওয়া।

Tuesday, September 18, 2007

বাংলার হিন্দুয়ানি, মুসলমানি

ফারসি মোঘল সাম্রাজ্যের ভাষা থাকার কারণে এবং পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহানের সময়ে সেনাদের মধ্যে উর্দুর ব্যবহারের ফলে ইংরেজদের হাতে পড়ার আগেই বাংলায় অনেক আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে, পোশাক-ধর্ম পাল্টে, কিংবা আরবি-ফারসি হিসেবেই। আঠারশ' শতাব্দীর প্রথমদিকের লেখা --- 'হোমাঙু বাদসাহের ওফাত হইলে হিন্দোস্তানে বাদসাহ হইতে ব্যাজ হইল, আপনারদের মধ্যে আত্মকলহ কইয়া বিস্তর২ লড়াই কাজিয়া হইল।' পরে বাংলা ভাষায় এই আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার কমে যায়। সাধু ভাষা হয় সাহিত্যের বাহন আর সরল ভাষা, যা গেল শতাব্দীর প্রায় দেড় দশক পরে বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষা নামে পরিচিত হয়, চলতে থাকে মুখের ভাষায়। ভারত ভাগের পরে, খানিকটা ধর্মীয় কারণে সংস্কৃতায়িত বাংলা (যা অনেকে হিন্দুয়ানি বাংলা বলে মনে করে) ছেড়ে আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্যে এক ধরণের (এসলামি) বাংলার প্রচলন ঘটে বা ঘটানো হয়। এসময় এরকম ধরণের প্রস্তাবও ছিল যে 'অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট' না লিখে 'অনেক পীরে মাজেজা নষ্ট' বলা হোক। দু-একটি উদাহরণ --- 'ফজরের আউয়াল ওয়াকতে উঠিয়া ফুফু-আম্মা চাচাজীকে কহিলেন, আমাকে জলদি এক বদনা পানি দাও। আমি পায়াখানা ফিরিয়া গোসল করিয়া নামাজ পড়িয়া নাশতা খাইব।' বা 'গোজশ্‌তা এশায়াতে আমরা অতীতে বাংলা ভাষার নানা মোড় পরিবর্তনের কথা মোখ্‌তাসার ভাবে উল্লেখ করেছিলাম।' অথবা 'শহর কলকাত্তায় শেফাউল মুল্‌ক্‌ তশরিফ রাখিতেছেন না বহুত রোজের কথা। আর তশরিফ রাখিলেই ফায়দাই বা কি? সে ছিল এক জামানা। ওজারতের তেজারত আর তেজারতের ওজারতে সুবে বাঙ্গলা ছিল সরগরম।' সংস্কৃত, আরবি-ফারসি, ফরাসি, পর্তুগিজ, তুর্কি, বর্মি সব ভাষার শব্দ নিয়েই বাংলা ভাষার, তার হিন্দুয়ানিও নেই মুসলমানিও নেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আগের বাংলায় যেমন আরবি-ফারসি ও সংস্কৃত শব্দ পাওয়া যায়, তার পরেও ঠিক তেমনই পাওয়া যায়। বাংলার ভাষার প্রকৃতি বজায় রেখে সহজে খাপ যায় এমন ভাবে বিদেশি শব্দের ব্যবহার বাংলায় ঢের সাহিত্যিকের লেখায় পাওয়া যায়। যদি কোনও ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণে লেখায় বা বাচনে সংস্কৃত বা আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য দেখা দেয়, তাহলে তা ভাষাপ্রকার (register) হিসেবে চিহ্নিত হবে।

Saturday, September 15, 2007

আরবি-ফারসি হরফে বাংলা

গেল শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর পর্যুদস্ত পরিকল্পনার বেশ কিছুদিন আগে সরকার আরও একটি ব্যাপারে নড়াচড়া শুরু করেছিল। তা হল আরবি-ফারসি (সরকার এবং মদদগারদের ভাষায় উর্দু) হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরকারের এ চেষ্টার নিন্দা জানায়। গুরুগম্ভীর কাজের জন্য, যেমন উর্দুতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায়, আরবি-ফারসি হরফে বাংলার প্রতিবর্ণীকরণ (transliteration) হতেই পারে। তবে সে সময়ের সরকার যা চেষ্টা করছিল তা হল লিপ্যন্তরীকরণ (transcription), বাংলা ভাষার উচ্চারণ অনুযায়ী উর্দুতে কাছাকাছি উচ্চারণে শব্দের পর শব্দ লিখে যাওয়া। আরবি-ফারসি হরফে বাংলার আলোচনা শোনা গেলেও ব্যাপারটা দেখতে কেমন তা বোঝা যায় না। দেখতে কেমন তার একটা ধারণা পাওয়া যায় মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত বঙ্গলা আদব কী তারীখ (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস) বইয়ে। সেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও অনেকের লেখা উর্দু হরফে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এমনই এক নমুনা, মধুসূদন দত্তর বঙ্গভাষা ---


হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;—
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর‐ধন‐লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

যদিও এক ভাষার হরফ আরেক ভাষা নিয়েছে বা আরেক ভাষার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রতিটি ভাষা তার নিজের হরফেই সুন্দর। জন বিম্‌স্‌ তার আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষার তুলনামূলক ব্যাকরণের ভূমিকায় বলেছিল --- ভারতীয় বর্ণমালার মধ্যে বাংলা সবচেয়ে সুন্দর এবং লেখতে সহজ... আধুনিক বাংলা হরফ এখন প্রাচীন ভারতীয় বর্ণমালাজাত যে কোন হরফের চেয়ে অনেক দ্রুত এবং সহজে লেখা যায়।

Friday, September 14, 2007

ঈশপের গল্পে ভাষার উচ্চারণ

আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালায় বিভিন্ন ভাষার উচ্চারণের উদাহরণ দিতে গিয়ে ঈশপের একটি গল্প উদ্ধৃত করা হয়, তার ধ্বনিতাত্ত্বিক লেখন সহ। The North Wind and the Sun were disputing which of them was stronger, when a traveller came along wrapped in a warm cloak. They agreed that the one who first succeeded in making the traveller take his cloak off should be considered stronger than the other. Then the North Wind blew as hard as he could, but the more he blew, the more closely did the traveller fold his cloak around him; and at last the North Wind gave up the attempt. Then the Sun shone out warmly, and immediately the traveller took off his cloak. And so the North Wind was obliged to confess that the Sun was the stronger of the two. গল্পটির একটি নীতিকথা আছে। তা থাক। ধ্বনিতত্ত্বে গল্পটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয় তার ধ্বনিতাত্ত্বিক লেখনের মাধ্যমে ভাষার উচ্চারণের উদাহরণ দেখানোর জন্য। ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত Principles of the International Phonetic Association-এ গল্পটির ৭০টির মত পাঠের লেখন ছাপা হয়েছিল। মাঝে মাঝে Journal of the International Phonetic Association-এ বেশ কিছু ভাষার উচ্চারণ এভাবে দেখানো হয়েছে। ১৯৯৯-সালে ছাপানো Handbook of the International Phonetic Association-এ ২৩টি ভাষার উচ্চারণ এ গল্পের পঠনে দেখানো হয়েছে। ১৯২২ সালে Bulletin of the School of Oriental Studies, University of London-এ প্রকাশিত Phonetic Transcriptions from Indian Languages নামের সুনীতিকুমারের একটি লেখায় সম্ভবত গল্পটির বাংলায় একটি উদাহরণ ছাপা হয়েছে (কখনও হাতে পড়েনি)। গল্পটির বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়: 'উত্তুরে বাতাস আর সূর্য তাদের মধ্যে কে বেশি শক্তিশালী তা নিয়ে ঝগড়া করছিল। এমন সময় এক পথিক গরম জামা গায়ে সে পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বাতাস আর সূর্য দুজনেই রাজি হল তাদের মধ্যে যে পথিককে তার জামা খুলতে বাধ্য করতে পারবে সেই হবে বেশি শক্তিশালী। এরপর উত্তুরে বাতাস তার ভীষণ বেগে বইতে লাগল। বাতাসের জোর যত বাড়তে থাকল পথিক তত শক্ত করে জামা গায়ে জড়াতে থাকল। অবশেষে বাতাস হাল ছাড়ল। এবার সূর্য প্রবল তেজ ছড়াতে লাগল। সেই সাথে পথিক তার গরম জামা খুলে ফেলল। আর উত্তুরে বাতাস মেনে নিল যে সূর্য বেশি শক্তিশালী।' সাদামাটা ধ্বনিমূলক (phonemic) লেখনে — /ut̪t̪ure bɑt̪ɑʃ ɑr ʃurdʒo t̪ɑd̪̪er mod̪ʱːe ke beʃi ʃokt̪iʃɑli t̪ɑ nie dʒʱɔɡɽɑ kortʃʰilo. æmon ʃɔmɔĕ æk pot̪ʰik ɡɔrom dʒɑmɑ ɡɑĕe ʃe pɔt̪h d̪ie ɦẽʈe dʒɑtʃʰːilo. bɑt̪ɑʃ ɑr ʃurdʒo dudʒɔnei rɑdʒi holo t̪ɑd̪er mod̪ʱːe dʒe pot̪ʰikːe t̪ɑr dʒɑmɑ khult̪e bɑd̪ʱːo kort̪e pɑrbe ʃei hɔbe beʃi ʃokt̪iʃɑli. erpɔr ut̪t̪ure bɑt̪ɑʃ bʱiʃɔn beɡe boit̪e lɑɡlo. bɑt̪ɑʃer dʒor dʒɔt̪o bɑɽt̪e tʰɑklo pot̪ʰik t̪ɔt̪o ʃɔkt̪o kore dʒɑmɑ ɡɑĕe dʒɔɽɑt̪e t̪ʰɑklo. ɔboʃeʃe bɑt̪ɑʃ ɦɑl tʃʰɑɽlo. ebɑr surdʒo probol t̪edʒd tʃʰɔɽɑt̪e lɑɡlo. ʃei ʃat̪ʰe pot̪ʰik t̪ɑr ɡɔrom dʒɑmɑ khule phelːo. ɑr ut̪t̪ure bɑt̪ɑʃ mene nilo dʒe surdʒo beʃi ʃokt̪iʃɑli./ কোনও রকম স্বরাঘাত চিহ্নের ব্যবহার করা হয়নি।

Monday, September 10, 2007

মান্য বাংলা, লেখায় এবং বাচনে

ভাষা পাল্টায় বিভিন্ন সময়ে আর ভাষা একই সময়ে পাল্টায় বাধায় — নদীই হোক, পাহাড়, জনপদের অভাব কিংবা রাজনৈতিক সীমরেখা। সময়ের রেখায় পাল্টানো ভাষার পরিচিতি পুরনো, মধ্যযুগীয় বা আধুনিক বাংলার মাঝে। ভিন্ন শতাব্দীর ভিন্ন বাংলাও এর নিদর্শন। আর একই সময়ে অবস্থানগত পাল্টানো বাংলার আরেক নাম আঞ্চলিকতা, ঢাকার বাংলা বা বীরভূমের বাংলা। এধরণের বাংলায় আবার সময়ে পাল্টানো বাংলার ছাপ থেকে যায়। তারপরেও, অত্যুৎসাহী কিছুলোকের ভাবাদর্শী মতের বাহুল্য বাদ দিলে, বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের মান্য চলতি বাংলা একই, লেখক বা ক্ষেত্রবিশেষে আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য বা সংস্কৃত শব্দের বাড়তি ওজন, এটুকুই যা বিবেচ্য। সাধারণভাবে কেবল কাকা-চাচা, মাসি-খালা, নমস্কার-সালাম বা জল-পানি ইত্যাদিই চোখে পড়ে বা সাধারণ আলোচনায় উঠে আসে। কারণ বোঝা বা বোঝানোর সুবিধা। কার্যসূচী-কার্যক্রম, জলহাওয়া-আবহাওয়া, কুড়ি-বিশ বা আরও অনেক শব্দের কথা নিয়ে আলোচনা দেখা যায় না। কলকাতায় মান্য বাংলায় প্রথম পুরুষের একবচনে সাধারণ অতীত কালে ক্রিয়ার শেষে -এ যোগ করা হয় (চলন্তিকা-রও তাই মত), ও কি বললে? ঢাকায় মান্য বাংলায় তেমনটি দেখা যায় না। কলকাতার 'ও কি বললে?'-র জায়গায় ঢাকায় হয়ত বলা হয় 'সে কি বলল?' এই 'ও' এবং 'সে' — সেও খানিকটা বিভদই। বাংলাদেশে একটা, দুইটা, তিনটা, চারটা এবং পাঁচটা, কিন্তু কলকাতায় একটি, দুটো, তিনটে, চারটে এবং পাঁচটা। সচেষ্ট বাচন ছাড়া বাংলাদেশে বাংলার চন্দ্রবিন্দুর দেখা পাওয়া (নাকি শোনা?) ভার। উচ্চারণেও কিছুটা গরমিল বর্তমান, যদিও মান্য বাচনে তা ধরা হয় না। কলকাতার লোকেরা আজকে /̍ɑdʒke/ উচ্চারণে জ-এর ঘোষতা বজায় রাখতে গিয়ে পরের ক-কে খানিকটা ঘোষতা প্রদান করে /̍ɑdʒk̬e/, আর ঢাকার লোকেরা ক-এর অঘোষতা বজায় রাখতে গিয়ে জ-কে ঘোষতারহিত করে ফেলে /̍ɑdʒ̊ke/। দুটোই সমীভবন, সামনে এবং পিছনে। একই রকমভাবে (চুল) আঁচড়ে /̍ɑ͂tʃɽe/ কলকাতায় /̍ɑ͂t̬ʃɽe/ আর ঢাকায় /̍ɑtʃre/। হয়ত অনেক অনেক দিন পর বাংলার দু'টি রূপ জন্ম নেবে — সময়ে, রাজনৈতিক সীমারেখায়। হয়ত তেমনটি ঘটবেই না, দুই রাজনৈতিক ভূখণ্ডের নৈকট্যের কারণে। তবে এখনও পর্যন্ত বাংলার মান্যরূপ হরেদরে একটিই, ঢাকায়ই হোক, কলকাতায় বা লন্ডনে।