Tuesday, December 04, 2007

বাংলার সিরিলিক বর্ণমালা

রোমক হরফের মত অন্য হরফেও বাংলা লেখার প্রয়োজন পড়ে, সাধারণ কাজ যেমন পত্রিকার সংবাদে বা অন্য ভাষায় বইয়ের নাম লেখার জন্য তো বটেই, বেশ জ্ঞানগম্যি ভরা কাজের জন্যও। সাধারণ কাজে রোমক হরফে যেমন বাংলা লেখা হয়, হান্টারীয় পদ্ধতিতে, তেমনি বোধ করি রুশ ভাষায়ও হয়, যেমন: сонар тори (সোনার তরী, Золотая ладья) বা амар шонар бангла (আমার সোনার বাংলা, моя золотая бенгалия)। সোভিয়েত এনসিক্লোপেদিয়ার ১৯৬৬ সালে ছাপানো রুস্কো-বেঙ্গাল্‌স্কি স্লোভার' (русско-бенгальский словарь)-এ বাংলার উচ্চারণ বোঝানোর জন্য রুশ বর্ণাশ্রয়ী চিহ্নের ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকটা বাংলার রোমক হরফে প্রতিবর্ণীকরণের আদলেই।


কিন্তু এই অভিধানেও উচ্চারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি কিছু করা হয় নি।

ভারতের মুম্বাইয়ের কাছে ধম্মগিরি ভিত্তিক বিপস্সন রিসার্চ ইন্‌স্টিটিউট-এর ত্রিপিটকের ওয়েব সাইটে ধর্মগ্রন্থটি অনেক হরফের পাশাপাশি বাংলা এবং সিরিলিক হরফেও দেওয়া আছে। যদিও এদের নিয়মটা একটু আলাদা।

লিপ্যন্তরীকরণ নিয়ে কাজ করার সময় একবার বাংলার সিরিলিক বর্ণমালা তৈরির প্রয়োজন পড়েছিল। দেখতে মোটামুটি পরিবর্তিত রোমক হরফের মতই, বিশেষ করে বর্ণাশ্রয়ী চিহ্নগুলো।


রুশ ভাষায় ব্যবহৃত সিরিলিক হরফের বাইরে গিয়ে উজ়বেকি, তাতার, তুর্কমেনীয়, সার্বীয়, মেসিদোনীয়, আজ়েরবাইজানি, তাজিকি, মোলদাভীয় ইত্যাদি ভাষার সিরিলিক হরফের ব্যবহার করলে আরও বেশ ক'টি হরফ পাওয়া যায় বেছে নেবার জন্য।

Monday, November 26, 2007

উপভাষার জন্য হরফ

ইংরেজির পূর্ব অ্যাংলিয়ান উপভাষার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল য়-ধ্বনির লোপ (yod dropping)। এই উপভাষার আমেজ আনতে গিয়ে চার্লস ডিকেন্স তার ডেভিড কপারফিল্ড-এ ব্যবহার করেছে dootiful (দায়িত্বপূর্ণ)। নরফোকের একটি প্রসিদ্ধ পণ্যের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হত, হয়ত এখনও হয়, bootiful (সুন্দর)। বাংলায়ও একই রকম ভাবে উপভাষা লেখা হয়ে আসছে। কিন্তু এভাবে উপভাষার লেখন ভাষাতত্ত্বের কাজে আসছে না। সুইডিশ উপভাষা লেখার জন্য ১৯৭৮ সালে অধ্যাপক জে. এ. লান্ডেল (সুইডিশ উচ্চারণ নয়) একটি ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা তৈরি করেছিল, যদিও এর চল এখন গুটিকয়েক ভাষাতত্ত্ববিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারপরেও তা দিয়ে উপভাষার অনেকটি লিপিবদ্ধ করা গেছে। মান্য বানান রীতিতে উপভাষা বা লোকভাষা লেখা সম্ভব নয়, কারণ এতে সংশয়ের অবকাশ থাকে। বাংলা একাডেমীর বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে প্রথাগত হরফ ব্যবহার করেই কয়েকটি নিয়মের কথা ভাবা হয়েছিল। অভিধানে সে সব ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু খুব একটা কাজের হয় নি।

অভিধানটিতে অঞ্চলভিত্তিক উচ্চারণের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে: এসব অঞ্চল ছাড়া সর্বত্র চন্দ্রবিন্দু রক্ষিত, এখানে আদিতে মহাপ্রাণতা রক্ষিত, ওখানে শব্দ অন্ত্য ব্যতীত সর্বত্র মহাপ্রাণতা রক্ষিত, এসব এলাকায় ড়-ধ্বনি র-এর মত, অন্য সব এলাকায় পার্থক্য রক্ষিত, ওখানে চ-বর্গের মূল ধ্বনি রক্ষিত, এখানে পরিবর্তিত এবং চ-এর জায়গায় চ‘, ছ-এর জায়গায় স, জ-এর জায়গায় য, এবং ঝ-এর জায়গায় ঝ‘, অনেক জায়গার জন্য দীর্ঘ স্বর, খণ্ড-ত, বিসর্গ, মুর্ধন্য ণ এবং ষ ব্যবহৃহ হয় নি, ইংরেজি -এর জায়গায় শ এবং -এর জায়গায়, ত-এর আগে, স ব্যবহৃত হয়েছে, ইংরেজি -ধ্বনির জন্য এ্যা (অ্যা হলে বোধ করি ভাল হত) ব্যবহৃত হয়েছে, অ-ধ্বনি অ দিয়ে এবং অ-নিহিত ও-ধ্বনি ও দিয়ে সংজ্ঞাপিত, যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি হস্‌ চিহ্ন দিয়ে ভেঙ্গে লেখা হয়েছে, দ্বৈতস্বর অই এবং অউ যথাক্রমে ঐ এবং ঔ দিয়ে লেখা হয়েছে। যদিও একগাদা নিয়ম মেনে অভিধানে শব্দের উচ্চারণ খোঁজার ঝক্কি থাকলেও, এত কিছুর পরও কিছু কিছু ব্যাপার স্পষ্ট নয়।

য দিয়ে ইংরেজি z-ধ্বনি নির্দেশের ব্যাপারটি সুবিধের নয়, যখন একই হরফ অন্য শব্দে ইংরেজির j-ধ্বনির দ্যোতক। জ-বিন্দু (জ়) দিয়ে ধ্বনিটি প্রকাশ করা উচিত। এরপরও দেখতে হবে উপভাষার লেখার ক্ষেত্রে ধ্বনিটি ঘৃষ্ট না উষ্ম‌। এবং এই পার্থক্য দেখানোর প্রয়োজন আছে কি না। সিলেটি বাংলায় ক হরফটির কখনও /q/, আরবি ق-এর মত। এবং কখনও বা /x/, আরবি خ-এর মত। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের নিয়মে ক় এবং খ় লেখা উচিত। প এবং ফ প্রায়শই ফ়, যা ইংরেজির f-ধ্বনির মত। অনেক উপভাষায় এ-ধ্বনি এবং অ্যা-ধ্বনির মাঝে একটি ধ্বনি আছে যাকে বিবৃত এ-ধ্বনি বা সংবৃত অ্যা-ধ্বনি বলা যেতে পারে। এর দেখা মিলবে সিলেট অঞ্চলে কিংবা মেদিনীপুরের হলদিয়া অঞ্চলে। কেউ কেউ মনে করে এ-কারযুক্ত হরফের পর একটি ইলেক চিহ্ন দিয়ে উচ্চারণটি বোঝানো যেতে পারে: দেশ, দে’শ এবং দ্যাশ। অনেকে জিহ্বামূলীয় স্পর্শধ্বনিকেও ইলেক চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করতে চায়: আ’'তি (হাতি), যেমনটি কুমিল্লা বা সিলেটে শুনতে পাওয়া যায়। ব্যঞ্জনের দ্বিত্বে য-ফলার ব্যবহার না করাই ভাল। ওড়িয়ার মত কোন ক্ষেত্রে অন্ত্য বা আদ্য অ-এর অ-ধ্বনির (ও-ধ্বনি নয়) উচ্চারণ কিভাবে লেখা হবে? ওড়িয়ার 'তুম্ভর নাম কি' (ତୁମ୍ଭର ନୀମ କି? তোমার নাম কি?) 'তুম্ভর্অ নাম্অ কি?' হিসেবে লেখা যেতে পারে, নাহলে সমস্ত অন্ত্য-অ ও-ধ্বনি ও-কার দিয়ে লিখতে হবে। কারও কারও ধারণা লেখা উচিত ইলেক চিহ্ন দিয়ে: ক'র্‌ল' /kɔrlɔ/।

Friday, November 23, 2007

সিদ্‌র্‌ নামের ঘূর্ণিঝড়

গেল ১৫ই নবেম্বরের বিকেলে বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলে ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের নাম সিড্‌র (হয়ত সিদ্র্‌ হলে ভাল হত, বা সিদ্‌র্‌, আরও ভাল; হিন্দিতে লেখা হচ্ছে भीषण चक्रवाती तूफान सिद्र, ভীষণ চক্রবাতী তূফান সিদ্র), যদিও বাংলায় উচ্চারিত হচ্ছে সিড্‌অর্‌, লেখাও হচ্ছে হসন্ত ছাড়া। যাই হোক। পরের দিন ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি লেখার শিরনাম, সিডর অর্থ চোখ; সিংহলীতে, অর্থটি গর্তও হতে পারে। পরের দিন একটি ইংরেজি দৈনিকের একটি খবরে ছিল সিংহলী ভাষায় সিডর অর্থ গর্ত বা চোখ। ঘূর্ণিঝড়েরও একটি চোখ ছিল, বেশ বড়। এ থেকে ভ্রান্ত অনুমান হতে পারে। সিংহলীতে চোখকে বলা হয় অ্যাস (ඇස); আর গর্তকে সিদুর (සිදුර); দুটোই অ-কারান্ত উচ্চারণ। হয়ত বাংলা (নাকি সংস্কৃত) ছিদ্রের কোনও ভাবে জ্ঞাতি ভাই। সিংহলী একটি ইন্দীয় ভাষা। দেখে মনে হয় ভগ্ন সংস্কৃত শব্দের সঙ্খ্যা সিংহলীতে বিস্তর। বাংলায় এধরণের শব্দগুলো পালি বা প্রাকৃতের মাধ্যমে আগত, তদ্ভব। সিংহলীতে তৎসম শব্দ স্তুতি (ধন্যবাদ), হিম (বরফ), বয়স (বয়স), নব (নতুন, আধুনিক), আরম্ভ (শুরু) ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনি দেখা পাওয়া যায় তদ্ভব শব্দের, মুণ (মুণ্ড?) মুখ অর্থে, মিহিরি (মিছরি?) মিষ্টি অর্থে, দোর (দ্বার > দুয়ার?) বাংলাও দোর, দরজা অর্থে, গঙ্গ (গঙ্গা?) নদী অর্থে, অ্যাঙ্গ (অঙ্গ?) শরীর অর্থে, বা রহস (রহস্য?) গোপন অর্থে, ইত্যাদি; সব শব্দই অ-কারান্ত।

বিশ্ব আবহাওয়া বিজ্ঞান সংস্থার উত্তর ভারত সাগরের ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের তালিকায় থাকা সিদ্‌র্‌ (السّدرة, আস্‌-সিদ্‌রা) শব্দটি আদতে ওমানের দেওয়া, এবং তা আরবি শব্দ। ওমানের দেওয়া তালিকায় আর সাতটি নামও আরবিতেই। ২০০৬-এর ২৮শে এপ্রিল মায়ানমারের আঘাত হানা ঝড়টির নাম ছিল মালা, শ্রীলঙ্কার দেওয়া নাম, সিংহলীতে, যদিও বাংলাতে শব্দটি একই, অর্থ সমেত। সিংহলীতে সিদ্‌র্‌-এর পরের পরের ঝড়টির নাম হতে পারে আবে। তবে মাঝের সম্ভাব্য ঝড়টির নাম হবে নার্গিস, পাকিস্তানের দেওয়া। বর্তমান তালিকায় আটটি দেশের দেওয়া ৬৪টি নাম আছে, সময়কাল মধ্য ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত।

আরবি আস-সিদ্‌রা বা আস-সিদ্‌র্‌ অর্থ সাধারণভাবে কুলগাছ যার বৈজ্ঞানিক নাম Ziziphus spina-christi। প্রাচীন গাছ। ইবনে সিনার বই আল-কানুন ফ়ি আল-তিব্ব্‌-এ ভেষজ গুণের জন্য গাছটির নাম পাওয়া যায়। আগে ওমানে সিদ্‌র্‌-এর পাতার চূর্ণ দিয়ে মাথার চুল পরিষ্কার করা হত।

Wednesday, November 14, 2007

বাংলায় গ্রিক শব্দ

ভারতবর্ষের সাথে গ্রিসের লেনদেন শুরু যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩২৭ বছর আগে মহামতি আলেকজান্ডারের পাঞ্জাব আক্রমণের মধ্য দিয়ে, তক্ষশীলার অধিপতি রাজা অম্ভি দিগ্বিজয়ী সিকন্দারের কাছে আর্তসমর্পন করে সে সময়। পরে আলেকজান্ডারের সাথে মগধের রাজা পুরুর যুদ্ধ পরের বছর। আরও পরে সেলুকাসের আক্রমণ রাজা চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য, যা বর্তমানে পাঞ্জাব নামে পরিচিত। সেলুকাসের দূত মেগাস্থিনিসের একটি বইও আছে এ বিষয়ে, ইন্দিকা নামে। তারও আগের গ্রিসে ভারতবর্ষ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ পারস্যের রাজা কুরুর (Cyrus) মাধ্যমে, ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি। এ অঞ্চলের ভাষায় তাই গ্রিক শব্দ থাকা স্বাভাবিক। এবং বাংলায় বর্মি শব্দের মত গ্রিক শব্দের সংখ্যাও খুবই অল্প, হালি দুয়েক। এর প্রায় সবই এসেছে সংস্কৃতের হাত ধরে। সুড়ঙ্গ, কেন্দ্র, হোরা, দাম, ময়দা, এবং জামিত্র। মনিয়ের মনিয়ের-উইলিয়ামস‌্-এর অভিধান মতে যবনিকা (যার জবনিকা বানানটিও শুদ্ধ, ইওনিয়া (Ἰόνια) > যবন (यवन) > যবনিকা, জবনিকা) ইত্যাদিও গ্রিক থেকে আগত। আরও দুয়েকটা শব্দ থাকতে পারে। সংস্কৃতে তো আছেই, বংশীয় শব্দের পাশাপাশি গ্রিক থেকে আগত অর্বাচীন শব্দ: যেমন, উষ্ট্র (বাংলায় উট) আর ক্রমেলক।

বাংলায় সুড়ঙ্গ বেশি প্রচলিত হলেও আসল বানান সুরঙ্গ। শব্দটি সংস্কৃততে सुरङ्ग (-ङ्गा), অর্থ, দেয়ালে বা মাটির নিচে খোঁড়া গর্ত। বাংলায় সিঁধ কাটা অর্থেও সুড়ঙ্গের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিকে σύριγξ (syringx, গুহা)। শব্দটি লাতিনে ঢুকেছে syrinx হিসেবে, অর্থ গুহাপথ, বা মাটির নিচে চলাচলের গর্ত। আধুনিকে গ্রিকে শব্দটি একটু অন্যভাবে আছে, σηραγξ (sēranx)। বাংলায় কেন্দ্র, সংস্কৃতের केन्द्र, বৃত্তের কেন্দ্র, আর গ্রিকে κέντρον (kentron, বৃত্তের মাঝের বিন্দু)। শব্দটি লাতিনে আছে centrum হিসেবে, কম্পাসের স্থির কাঁটা বা বৃত্তের মাঝবিন্দু অর্থে। হোরা, সংস্কৃতে होरा (ঘণ্টা, সময়), এবং গ্রিকে ὡρα (hōra, দিনের চব্বিশ ভাগের একভাগ সময়)। এই শব্দ দিয়েই বোধ করি ভারতবর্ষে চব্বিশ ঘণ্টার দিনের হিসেবের শুরু। আগে কালগণনা হত বিপল, পল, দণ্ড, প্রহর ইত্যাদি দিয়ে। দাম শব্দটি গ্রিক δραχμή (drakhmē, মুদ্রার নাম) থেকে আগত সংস্কৃত द्रम्य (দ্রম্য, দাম), তার প্রাকৃতের আধুনিক রূপ । দ্রাখ্‌মে > দ্রম্য > দম্ম > দাম। বনেদি সংস্কৃত শব্দ মূল্য সমানভাবে বিরাজমান। ময়দা শব্দটির পরিবর্তন ঘটেছে, সাথে পরিভ্রমণও। গ্রিক σεμίδαλις (semidalis, মিহি গমের আটা) থেকে সংস্কৃতে समीदा (সমীদা), সেখান থেকে প্রাকৃত মীদা এবং সম্ভবত মধ্য এশিয়া ভ্রমণের পর ফারসি ميده (ময়দা) হিসেবে বাংলায় আগমন। কারও কারও মতে জামিত্র শব্দটিও গ্রিক δίαμετρον (diametron, ব্যাসরেখা) সংস্কৃত जामित्र-এর মাধ্যমে।

Saturday, November 03, 2007

জিলা না জেলা?

বাংলার জেলা আরবির জ়িলা থেকে ব্যুৎপন্ন। আরবিতে বানান (ضلع, জ়িলা', ẓilaʻ), অর্থ, পাঁজর, এবং সে থেকে দিক। উর্দুতেও ضلع। হিন্দিতে जिला বা ज़िला। জন টমসন প্ল্যাট‌্স-এর উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি এবং ইংরেজি অভিধানে রোমক হরফে ẓilaʻ বা zila‘, অর্থ দিক, অংশ, (প্রদেশের) বিভাগ, জেলা, (বইয়ের পাতায় ছাপার) কলাম। Concise Oxford Dictionary আর Chamber's-এ zillah। হবসন-জবসনে zilla, তবে খুব বেশি একটা চোখে পড়ে না। বছর পঁচিশেক আগে জিলা কথাটা বেশ প্রচলিত ছিল, এখনও আছে গুটি কয়েক জায়গায়, যেমন জিলা স্কুলের নামে, কয়েক জায়গায় জিলা পরিষদ ভবনেও তাই লেখা থাকত। এখন প্রায় সব জায়গায় জেলা হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে ইশকুলগুলিকেও জেলা স্কুল বলা হয়।

বাংলায় সাধারণত আরবি শব্দ ফারসি এবং উর্দুর মাধ্যমে ই পরিবর্তিত হয়ে এ হিসেবে দেখা দেয়, যেমন, নিজ়ারত থেকে নেজ়ারত। তবে উর্দু অভিধান ফ'রহঙ্গ-ই-রব্বানী-তে উচ্চারণ দেওয়া আছে জিলা। তারপরও উচ্চারণজনিত আলস্যের কারণে উঁচু স্বর ই একটু নেমে গিয়ে মধ্য এ-য় ঠেকেছে। বাংলা উচ্চারণের এটিই কি ধর্ম? ইংরেজিতে শব্দটির উচ্চারণে তেমন পরিবর্তন না হলেও, বাংলাদেশে অন্তত বানানটির একটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে গেল দশ বছরে। আগে লেখা হত upazilla, এখনও লেখা হয়; তবে অনেক ক্ষেত্রে তা পাল্টে upazila হয়ে গেছে।

Friday, November 02, 2007

পৃথগ্‌বাসে বৈচারিক হাকিম

ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো বিচার ব্যবস্থার উপর প্রতিবেদনে পৃথকীকরণ বা বিযুক্তিকরণ অর্থে পৃথক্‌করণের ব্যবহার করেছে। দুটি শব্দই জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে আছে, যদিও সুভাষ ভট্টাচার্যের বাংলা প্রয়োগ অভিধান মতে পৃথক্‌করণ লেখাই ভাল। অন্যদিকে দুই ধরণের হাকিমের কথা বলতে গিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে বিচারিক (judicial) এবং নির্বাহী (executive) হাকিম। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং আনিসুজ্জামান সঙ্কলিত এবং সম্পাদিত আইন-কোষের মতে শব্দটি বৈচারিক। তাই হওয়াটা স্বাভাবিক; কারণ ইক প্রত্যয়ে স্বরের বৃদ্ধি হয়: বিচার + ইক = বৈচারিক। অনেকেই ঝামেলা এড়াতে বিচারবিভাগীয় কথাটি ব্যবহার করেছে। বৈচারিক (वैचारिक) শব্দটি হিন্দি এবং মরাঠিতেও প্রচলিত, সংস্কৃতের নিয়ম মেনেই, বোধ করি। পৃথক্‌করণের সাথে আইন-কোষে প্রতিশব্দ দেওয়া আছে পৃথগ্‌বাস।

Wednesday, October 31, 2007

কেদারা ও চেয়ার এবং মেজ ও টেবিল

কেদারার একলা ভাগ্য বাংলায় তেমন একটা ভাল নয়। শব্দটি পর্তুগিজ কাদেইরা (cadeira) থেকে আগত। পরে ইংরেজির চেয়ার (chair) বেশি প্রাধান্য পায় এবং হয়ত এক সময় কেদারা কথ্য ভাষা থেকে ছিটকে পড়ে। তবে অন্য শব্দের সাথে এর ব্যবহার আগেও ছিল, এখনও আছে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের আরণ্যক-এ আছে 'ঘরে একখানা ভালো ছবি নাই, ভালো বই নাই, ভালো কৌচ-কেদারা দূরের কথা, ভালো তাকিয়া-বালিস-সাজানো বিছানাও নাই।' আর কলকাতার ভূমি নামের একটি দলের গানেও কেদারা পাওয়া যায় আরেকটি শব্দের সাথে, আরাম কেদারা (গান: বারান্দায় রোদ্দুর)। কেদারা একটু অ-বাংলা শোনালেও, আরাম কেদারা ইংরেজি armchair বা easy-chair থেকে অনেক বাংলা।

বাংলায় একই রকম আরেকটি পঙ্‍ক্তিচ্যুত শব্দ হল মেজ। টেবিল, ফারসি ميز থেকে। বাংলা অভিধানে শব্দটি বহাল তবিয়তে আছে, নেই কেবল তার ব্যবহার। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান মতে শব্দটি কুমিল্লার উপভাষায় প্রচলিত; অন্য রূপে, ম্যাজ়। অনেকের মতে শব্দটি পর্তুগিজ (mesa থেকে আগত। তবে বাংলা বেশিরভাগ অভিধানের অঙ্গুলিনির্দেশ ফারসির দিকে। জন টমসন প্ল্যাট‌্স-এর উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি এবং ইংরেজি অভিধানে শব্দটিকে ফারসি হিসেবে দেখানো হয়েছে। ফারসি মেজ এসেছে পহ‌্লবি mīj থেকে যা সংস্কৃত মহ (मह्) এর সমগোত্রীয়। সংস্কৃত শব্দটির অর্থ ভোজ বা বলিদান হলেও ফারসি শব্দটির অর্থ টেবিল। টেবিল, তথা বাসার, কর্তা বলেই মেজবান অর্থ অতিথি সৎকারক। শব্দটি পর্তুগিজ থেকে আগত মনে করার কারণ হয়ত এই যে ভারতবর্ষীয় বা কাছাকাছি অনেক ভাষাতেই পর্তুগিজ শব্দটি ঢুকে গেছে, অনেক ক্ষেত্রে একটু অন্য রূপে। যেহেতু পহ‌্লবিতেও শব্দটি আছে, তাই মধ্য এশিয়ায় ইন্দো-ইরানি কোনও ব্যাপার থেকে থাকতে পারে। ফারসিতে অর্থ টেবিল বা খাবার টেবিল; অতিথিও হয়। হিন্দুস্তানিতে মেজ লগানা (मेज़ लगाना, مير لگانا) বা মেজ বিছানা (मेज़ बिछाना, مير بچهانا) অর্থ টেবিলে খাবার দেওয়া। মেজ-কুর্সী (मेज़-कुर्सी, ميز-كرسى) অর্থ টেবিল-চেয়ার, শব্দ ভিন্ন, তবে ক্রমটা একই। হিন্দুস্তানিতে মেজ শব্দটি প্রচলিত হলেও, বাংলায় টেবিলের জনপ্রিয়তা এবং গ্রাহ্যতা বেশি।

Tuesday, October 30, 2007

লণ্ঠন

বাংলায় লণ্ঠন কথাটি বোধ করি ইংরেজি lanthorn থেকে এসেছে। ইংরেজিতে lantern শব্দটি লাতিন থেকে ফরাসির মাধ্যমে এলেও এক সময় অনেকের ধারণা ছিল শব্দটির ইংরেজি বানান হবে lanthorn, কারণ এটির পাশের ঢাকনা বানাতে শিঙের ব্যবহার করা হত। লোকব্যুৎপত্তির একটি উদাহরণ। ১৬৯৬তে ছাপানো এড্‌ওয়ার্ড ফিলিপ‌্স‌্-এর নতুন বিশ্বের ইংরেজি শব্দাবলি বা সাধারণ অভিধান-এ (The New World of English Words or a General Dictionary) পাওয়া যায় 'magick lanthorn'। ষোলশ' এবং সতেরশ' খ্রিস্টাব্দের দিকে এই বানান ইংল্যান্ডে প্রচলিত ছিল। প্রায় একই সময়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষে আসে। তাই মনে হয় lantern-এর চেয়ে lanthorn থেকেই লণ্ঠন আসার সম্ভাবনা বেশি। আবার নাও হতে পারে, কারণ হিন্দিতে শব্দটি लालटेन (লালটেন) যা lantern-এর কাছাকাছি। Lanthorn বানানটি আমেরিকায়ও প্রচলিত ছিল, ১৫৯০-এর আগে। বাংলাদেশে ব্যবহৃত লণ্ঠনকে বলা হয় hurricane lantern কারণ ঝড়েও এর আলো নিভে যায় না। এর আরেকটি নাম কেরোসিন লণ্ঠন। প্রচলন শুরু হয় ১৮০০ শেষের দিক থেকে।

ইংরেজির তদ্ভব শব্দ বলে বানানে ন্‌ + ঠ হওয়া উচিত। এদিবে আবার বহুদিনের সংস্কার এবং বাংলায় ঠ এর আগে ন যুক্ত না হওয়ার কারণে, ণ্ঠ-ই সই, রুগ্ন-র মত। প্রথমটিতে ধরে নিতে হবে ন, পরেরটিতে ণ, যদিও বানান উলটো।

Monday, October 29, 2007

বাংলায় শব্দসঙ্ক্ষেপন

বাংলায় শব্দসঙ্ক্ষেপনের জন্য একেক জায়গায় একেক কায়দা চোখে পড়ে। কেউ ডাক্তার, সে চিকিৎসকই হোক বা অচিকিৎসক, লেখে ডাঃ, কেউবা ডা. কেউ শুধু ডা (কোনও রকম চিহ্ন ছাড়া); অনেকে আবার চিকিৎসক হলে ডা, অচিকিৎসক হলে ড লেখে। কেউ কেউ ইংরেজির ফুল স্টপের পরিবর্তে কমা ব্যবহারের পক্ষপাতী। আনন্দবাজার পত্রিকার লেখনরীতি বিন্দুকেই প্রাধান্য দিয়েছে, যদিও বলা আছে অনেকে পঃ বঙ্গ লিখে পশ্চিম বঙ্গ বোঝায়।পুরনো দিন থেকে বাংলায় শব্দ সঙ্ক্ষেপনের জন্য হয় অনুস্বার (‍ঃ) নয় বিসর্গ (‍ং) ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অনেক পুরনো বাংলা দলিলপত্রে দেখা যায় ইং (ইংরেজি), কাং (কাছারি), গুঃ (গুজরত, মারফত), পঃ (পরগনা), ইত্যাদি। এখনও দেখা মেলে কোং (কোম্পানি), গং (গয়রহ), তাং (তারিখ), নং (নম্বর), বা মোঃ (মোহাম্মদ), মোসাঃ (মোসাম্মত), আঃ (আব্দুল), রেজিঃ (রেজিস্ট্রেশন), ইত্যাদি। যারা নামের শব্দ সঙ্ক্ষেপের জন্য ইংরেজির ফুল স্টপের ব্যবহার করে তাদেরই লেখায় আবার পাওয়া যায় কোং, তাং, নং, ইত্যাদি। এদের কেউই আবার ন. (নম্বর), মো. (মোহাম্মদ), তা. (তারিখ) ইত্যাদি লেখে না, যদিও লেখে ড. বা ডা.। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে পুরনো বাংলার অনুস্বারের আদলে একটি ছোট বৃত্ত, তবে মাত্রার বেশ নিচে, ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন,বা৹। রাজশেখর বসুর চলন্তিকায় দেখা যায় বিঃ অর্থ বিশেষ। চলন্তিকায় অবশ্য তু. বলতে তুর্কি শব্দ আর তুঃ বলতে তুলনীয় বোঝানো হয়েছে।

Saturday, October 27, 2007

বাংলার রোমক বর্ণমালার আরও কিছু কথা

রোমক হরফে বাংলা লেখার কায়দা ঠিক করার সময় আরও কিছু ব্যাপার আলোচনা করা হয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত 'আমাস ১৫৯১৯: দেবনাগরী এবং সম্পর্কিত ইন্দীয় লেখার লাতিন হরফে প্রতিবর্ণীকরণ' পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। তবে একটা খসড়া দাঁড় করানো হয়েছিল, বাংলা হরফে বিদেশি ধ্বনি, বিশেষত আরবি-ফারসি, লেখার জন্য। যেমন, s̱ (ث) _s, h̤ (ح) ,h, ḵ‍ẖ (خ) _kh, ẕ (ذ) _z, z (ز) z, ž (ژ) ^z, s̤ (ص) ,s, ż (ض) ;z, t̤ (ط) ,t, ẓ (ظ) .z, ‘ (ع) `, ġ (غ) ^g, f (ف) f, q (ق) q, এবং w (و) w। বন্ধনীর আগে ছাপানোর জন্য, বন্ধনীর মাঝে আরবি-ফারসি এবং বন্ধনীর পরে ASCII চিহ্ন দেওয়া হল। বাংলা হরফের সাথে বিভিন্ন সময়ে এবং বইয়ে বিভিন্ন বর্ণাশ্রয়ী চিহ্নের ব্যবহার করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি নিম্ন-বিন্দু বা পার্শ্ব-বিন্দুই নিয়ম। অন্ততপক্ষে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, নিম্ন-বিন্দু দিতে হবে, যেমন স়, হ়, খ়, জ়, জ়, ঝ় (জ̤), স়, দ় (ধ়), ত়, জ়, ‘অ, গ় (ঘ়), ফ়, ক় এবং ব় (ৱ); নিম্ন-বিন্দু না দেওয়া গেলে পার্শ্ব-বিন্দু দিতে হবে, যেমন ক., খ., বা গ.। কোথাও বা বিন্দুটি মাত্রার ঠিক পাশে বা উপরে বসানো হয়। তারপরেও যেহেতু একই পদ্ধতির মধ্যে একটাই কেবল নিয়ম থাকা উচিত, তাই যেকোনও একটি চিহ্নের ব্যবহার করলেই চলবে। বিন্দু দিয়ে হরফের পরিবর্ধন ইন্দীয় অন্যান্য ভাষাতেও আছে। তবে পুরো ব্যাপারটি কিন্তু বিশেষায়িত কাজের জন্য, আমজনতার লেখার জন্য নয়। জ্ঞানের যেমন ভার আছে, ঝামেলাও তেমনই বেশি।

Friday, October 26, 2007

বাংলার নুকতা

বাংলায় নুকতার ব্যবহার ইউনিকোডের অবদান, যদিও এই নুকতা (অভিধানে বা গবেষণা গ্রন্হে হয়ত নুক়ত়া লেখা উচিত কারণ আরবি, ফারসি বা উর্দুতে উচ্চারণ ভিন্ন হলেও, শব্দটির বানান نقطه, অর্থ, বিন্দু; ইংরেজিতে nuqta বা আরও শুদ্ধ করে nuḳt̤a বা nuqt̤a লেখা উচিত হলেও সাধারণত লেখা হয় nukta) ছাপায় দেখতে পাওয়া যায় অনেক দিন থেকেই। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, রাজশেখর বসুর চলন্তিকা, বা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় এই নুকতার ব্যবহার হয়ে আসছিল, কেবল এর নাম ছিল বিন্দু — পার্শ্ব বা নিম্ন। ইউনিকোডের ওপর ভারতীয় লিপির উপাত্ত বিনিময় নিয়মের (Indian Script Code for Information Interchange) প্রভাবে এর নাম বাংলা থেকে আরবি বা ফারসি হয়ে গেছে। এই নুকতার কারণে ইউনিকোডে তিনটি বাংলা হরফ লেখায় বিকল্প চালু হয়েছে — য়, ড় এবং ঢ়। এককভাবে লেখা ছাড়াও য, ড এবং ঢ এর সাথে নুকতা যোগ করেও লেখা যায়। এতে একটি ছোট অসুবিধা হয় বই কি। জানা না থাকলে কিংবা একই লেখায় দুই ধরণের হরফ থাকলে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। দুই নুকতা বা দ্বি-বিন্দুর উদাহরণও বাংলার ছাপায় পাওয়া যায়, যদিও ইউনিকোড সাধারণভাবে বাংলা লেখার নিয়মে তা পাওয়া যায় না। বাংলায় ফরাসি বা রুশ সাহিত্যের অনুবাদে ফরাসি j(e)-ধ্বনি, যা ইংরেজির (vi)s(ion)-ধ্বনিতুল্য, বা রুশ ж-ধ্বনি, যা ইংরেজিতে zh দিয়ে লেখা হয়, লেখার জন্য জ-এর নিচে দুই বিন্দুর ব্যবহার করা হয়। আদতে ফরাসি ধ্বনি (/ʒ/) এবং রুশ ধ্বনি (/ʐ/) এক না হলেও ইংরেজিতে একই ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ করা হয় বলে বাংলায়ও একই হরফের ব্যবহার করা হয় (ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনায় বোধ করি পার্থক্যটা বজায় রাখা উচিত)। ইউনিকোডে জ-এ দ্বি-বিন্দু লিখতে হলে জ-এর সাথে ব্যবহার করতে হবে যে ইউনিকোড ক্যারেক্টার তার নাম Combining Diaresis Below (̤) — জ̤।

বিন্দু ছাড়া আরও একটি অর্থে নুকতা শব্দের ব্যবহার অন্তত কথ্য বাংলায় দেখা যায় — নুকতা দিয়ে বলা, অর্থ জোর দিয়ে বলা। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে বা বাংলা একাডেমীর আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে এই অর্থটি নেই। হিন্দুস্তানিতে পাওয়া যায় নুকতা লগানা (नुकता लगाना, نقطه لگانا), অর্থ, গালাগালি করা, দোষ দেওয়া, দোষারোপ করা।

Thursday, October 25, 2007

বাংলায় বর্মি শব্দ

বাংলা ভাষায় বর্মি শব্দ কুল্লে দুই — লুঙ্গি আর ফুঙ্গি। প্রথমটির দেখা মেলে ঘরের বের হলেই, বিশেষ করে বাংলাদেশে। দ্বিতীয়টি কেবল অভিধানে আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতায় (আরও গোটাকতেক জায়গায় পাওয়া সম্ভব, ইতিহাস, ভূগোল বা ভ্রমণ কাহিনির বইয়ে)।

লুঙ্গি শব্দটি বর্মিতে လိုဈည္, রোমক হরফে longyi, উচ্চারণ /lòuɲdʒì/। বাংলার উচ্চারণ থেকে একটু আলাদা, তবে স্বগোত্রীয বলে চেনা যায়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসে শব্দটি বর্মি, তবে অভিধানটিতে ব্যুৎপত্তির জায়গায় সাথে ফারসি লুঙ্গি শব্দটি দেওয়া আছে। হিন্দিতে लुंगी, আর উর্দুতে لنگى। শব্দটি ফারসিতেও পাওয়া যায়, لنگی হিসেবেই। Chamber's-এ পাওয়া যায়, lungi, হিন্দি এবং ফারসি থেকে, অর্থ, নিম্নদেশে বা মাথায় পরিধেয় কাপড়। Concise Oxford Dictionary-তেও lungi, উর্দু থেকে, অর্থ, নিম্নদেশে পরিধেয় কাপড়। বাংলায় বাঙ্গালি পুরুষের নিম্নদেশে পরিধেয় বস্ত্র হলেও, ফারসিতে একসময় তা পাগড়ির কাপড়কেও বোঝাত। জন টমসন প্ল্যাট‌্স-এর উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি এবং ইংরেজি অভিধানের মতে মুসলমানদের ধুতি বা লাঙ্গ হিসেবে পরার জন্য রঙিন কাপড়, বা মাথার পাগড়ির জন্য চেক বা সোনালি কাপড়। শব্দটি ব্যুৎপন্ন হিন্দি লাঙ্গ (लांग) থেকে যার অর্থ পায়ের ভাঁজে পরার জন্য এক ধরণের ধুতি। জন শেক্সপিয়ারের হিন্দুস্তানি ও ইংরেজি অভিধানে অর্থ লাঙ্গ হিসেবে পরার জন্য এক ধরণের রঙিন কাপড়। জোসেফ ফ্রান্সিস স্টেইনগ্লাসের ১৮৯২ সালে ছাপানো ফারসি-ইংরেজি অভিধানের অর্থ, এক ধরণের কাপড় যা কোমরে দু'পায়ের মাঝখান দিয়ে পরতে হয়। হেনরি ইউল-এর ১৯০৩ সালে ছাপানো হবসন-জবসন-এ longhee, ব্যুৎপত্তি, হিন্দি লুঙ্গী < ফারসি লুঙ্গ বা লাঙ্গ, লুঙ্গী, অর্থ, গায়ে পেঁচিয়ে পরার কাপড়, ফরাসিরা যাকে pagne বলে, অর্থাৎ নিম্নদেশে এক বা দুইবার পেঁচিয়ে কোমরে গুঁজে দেওয়া। এ অভিধানেও লুঙ্গি বলতে পাগড়ির কাপড়কেও বোঝানো হয়েছে। এতকিছুর অর্থ হল, লুঙ্গি শব্দটি ফারসি থেকে হিন্দির মাধ্যমে বাংলায় ব্যুৎপন্ন হলেও হতে পারে। আবার তা না হলেও, ফারসি এবং হিন্দি শব্দের বানান এবং অর্থে যথেষ্ট প্রভাবিত বর্মি থেকে আগত এই লুঙ্গি শব্দটি।

দু'পায়ের ভাঁজে কোমরে পেঁচিয়ে পরার কাপড় অর্থে ফারসি আরেকটি শব্দ বাংলায় বিদ্যমান, যদিও এর দেখা মেলে বাংলার উপভাষায় — তবন, তহবন, তফন, তঅমান, ইত্যাদি বানানে। ফারসি তহ্-বন্দ্‌ (ته بند), তহ্‌ অর্থ নিম্নদেশ, আর বন্দ্‌ অর্থ যা পেঁচিয়ে পরা যায়, ইংরেজিতে loin cloth, অর্থাৎ লুঙ্গি।

ফুঙ্গির দেখা মেলে না সহজে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'শ্মশান-শয্যায় আচার্য্য হরিনাথ দে' কবিতার দ্বিতীয় স্তবকটি এ রকম —

একটি চিতায় পুড়ছে আজি আচার্য্য আর পুড়ছে লামা,
প্রোফেসার আর পুড়ছে ফুঙি, পুড়ছে শমস্‌-উল্‌-উলামা।
পুড়ছে ভট্ট সঙ্গে তারি মৌলবী সে যাচ্ছে পুড়ে,
ত্রিশটি ভাষার বাসাটি হায় ভস্ম হ'য়ে যাচ্ছে উড়ে।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে পাওয়া যায় ফুঙ্গি (-ঙ্গী) এসেছে বর্মি ফুঙ্গি থেকে, অর্থ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। চট্টলাদির উচ্চারণে শব্দটি দাঁড়ায় পুঙ্গি বা পুঙি-তে। গ্রাম্য উদাহরণ, পুঙির পুত, সন্ন্যাসীর পুত্র, জারজ অর্থে। সাধু বর্মি শব্দের বাংলা তদ্ভব গালি, অর্থ ও বানানে।

Tuesday, October 23, 2007

বাংলা-ইংরেজির ইয়ার-বক্সি

বাংলায় যাকে সমার্থক দ্বন্দ্ব সমাস এবং ইংরেজিতে (near-synonym) idiomatic binomials বা binomial idioms বলা হয় সেগুলোর গঠনে বেশ একটি মিল দেখতে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দু' ভাষাতেই শব্দ দুটির একটি এক ভাষার আরেকটি অন্য ভাষার। বাংলার ক্ষেত্রে হাট-বাজার (বাংলা-ফারসি); ইংরেজিতে home and hearth (দেশি ইংরেজি-নর্‌মান)। উদাহরণ আরও আছে: শাক-সবজি, দান-খয়রাত, দুখ-দরদ, ফাঁড়া-গর্দিশ, মান-ইজ্জত, লজ্জা-শরম, ভাই-বেরাদর, দেশ-মুল্লুক, ধন-দৌলত, রাজা-বাদশা, ঝড়-তুফান, হাসি-খুশি, মায়া-মহব্বত, জন্তু-জানোয়ার, সীমা-সরহদ, এবং খাতির-যত্ন। ইংরেজিতে: meek and humble, odd and strange, meet and proper, nook and corner, sorrow and grief, moil and toil, whims and caprices, weeds and brambles এবং kith and kin। আধুনিক বাংলায় বেশ কিছু শব্দ এরকম বাংলা আর ইংরেজি মিলে হয়েছে: উকিল-ব্যারিস্টার, বিড়ি-সিগারেট, ফ্ল্যাট-বাড়ি, এবং ডল-পুতুল। ইংরেজির time and tide এর সাথে wait হবে না waits হবে এ নিয়ে জেরবার থাকে বাংলা দেশের অনেক ছাত্রই। অনেকেরই (শিক্ষকদেরও) ধারণা এর অর্থ সময় এবং স্রোত, তাই সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না, অতএব wait। এদিকে ইংরেজি ব্যাকরণেই বলছে এরকম ক্ষেত্রে যদি যুগ্ম শব্দ একই বস্তু বা বিষয় বোঝায় তবে waits-ই হবে, অর্থাৎ প্রথমপুরুষে একবচন, ক্রিয়ার জন্য। ইংরেজিতে যে সময়ে এই শব্দ গুচ্ছ চালু হয় তখন tide বলতে সময়ই বোঝাত। শব্দটি পুরনো ইংরেজি tíd থেকে ব্যুৎপন্ন। প্রায় একই সময়ের ইংরেজিতে পাওয়া যায়, Fast falls the eventide (দ্রুত নামিছে সন্ধ্যা, বা সান্ধ্যকাল) — Henry Francis Lyte-এর 'Abide with Me' প্রার্থনা সঙ্গীতের শুরুর পঙ্‌ক্তি। অতএব, এ ক্ষেত্রে Time and tide waits for none

Monday, October 15, 2007

ফারসি শব্দের বাংলা তদ্ভব

বাংলায় সাধারণত বলা হয় কুকুর, বেড়াল বা হরিণ, আর স্ত্রীলিঙ্গ মাদি (মাদী কি লেখা উচিত, ফারসি তৎসমের বাংলা তদ্ভব, দীর্ঘ-স্বর পরিহার্য) কুকুর, মাদি বেড়াল আর মাদি হরিণ। পুরুষলিঙ্গে কখনও কখনও মদ্দা কথাটির ব্যবহার দেখা যায়, যেমন মদ্দা পশু, তবে বিরল। বাংলায় (সাধারণত) পশুর স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ মাদি এবং এই শব্দের ব্যবহার না করলেই তা পুরুষ প্রাণীটিকে বোঝাবে। এই মাদি (যদিও মাদী বেশি প্রচলিত, একে বিদেশি, তায় তার তদ্ভব, ই-কারই হওয়া উচিত) শব্দটি বাংলার অবদান, ফারসি মাদা (নারী) থেকে। ফারসিতে নর মানে পুরুষ, আর মাদা মানে নারী, যেমন, شير نر (শের নর, সিংহ) আর شير مده (শের মাদা, সিংহী)। হিন্দি এবং উর্দুতে নারী-পুরুষ অর্থে নর-মাদা দেখা যায়, যেমন नर-मादा का समागम (নর-মাদা কা সমাগম, নারী-পুরুষের সমাগম)।

Sunday, October 14, 2007

সংস্কৃতর লেবাসে তদ্ভব, বা বিদেশি, শব্দ

বাংলায় বেশ কটি শব্দ আছে আপাতদৃষ্টিতে যাদের সংস্কৃত না বলে ভাববার কোনও কারণ নেই। যেমন, রাণী (আধুনিক বানানে রানি), কাহিনী (কাহিনি), ভিখারিণী (ভিখারিনি), রূপসী (রূপসি) ইত্যাদি। বানানের নতুন নিয়ম মানতে গিয়ে বেশির ভাগ লোকই হিমশিম খেয়েছে এই সব শব্দ থেকে ঈ-কার পাল্টে ই-কার করতে গিয়ে; আর প্রায় সবাই একবার না একবার চিন্তা করেছে ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে কি না তা নিয়ে, যদিও এখন অনেকেই, বিশেষকরে পশ্চিম বঙ্গে, অবলীলায় ই-কার ব্যবহার করে। এবং সেটিই হওয়া উচিত। রানি শব্দটি ব্যুৎপন্ন হয়েছে রাজ্ঞী থেকে: রাজ্ঞী বা রাজনী> রণ্‌ণী > রানী > রানি। সংস্কৃত ব্যকরণের নিয়ম অনুযায়ী র-এর পরে মূর্ধন্য ণ ব্যবহারের নিয়ম, তাছাড়া অপভ্রংশে যেহেতু ণ তাই ব্যুৎপত্তির বিচারে মূর্ধন্য ণ-ই স্বাভাবিক। তবে বাংলা বানানের নিয়মে বলা আছে যে ণত্ব-বিধান কেবল তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে খাটে। এই ণ অনেক আগেই দন্ত্য ন-এ পরিণত হয়েছে। বেশ কিছু কাল ধরে অনেকে ঈ-কার পাল্টে ই-কারে এসেছে। বাংলা বানানের নিয়মেই: তৎসম শব্দে দীর্ঘ স্বর থাকলে তদ্ভব শব্দে দীর্ঘ এবং হ্রস্ব দুয়ের বিধান, তবে হ্রস্ব স্বর হলে বানানটা আধুনিক হয়। তাছাড়া নিয়মে বলা আছে কেবল তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে স্বরের দীর্ঘত্ব বা হ্রস্বত্ব রক্ষিত হবে। একইভাবে অর্বাচীন সংস্কৃত কথানিকা থেকে আগত কাহিনি তার স্বরের দীর্ঘত্ব হারিয়েছে: কথানিকা > অপভ্রংশ কহানিয়া > বাংলা কাহিনি। সংস্কৃত রূপস্‌ থেকে পুরুষ বিশেষণ রূপবান, স্ত্রী বিশেষণ রূপীয়সী। রূপসি শব্দটি পুরোপুরি বাংলার অবদান, আধুনিক বানানটিও তাই রুপসি হওয়া উচিত। প্রথমে -সী থেকে -সি হয়েছে। রূ- অনেকের জন্য রু- এখনও হয় নি, কারণটা সম্ভবত রূপসী রুপসি হলে তার সাথে রূপের সম্পর্কটি আর থাকে না। তবে সেটিও হয়ত হয় যাবে। নয়ত সংস্কৃত রূপ + বাংলা -সি ধরে নিতে হবে। সংস্কৃত ভিক্ষার্থী থেকে ভিখারী (সংস্কৃতের ক্ষ তদ্ভবে প্রায়ই খ এবং মূলের দীর্ঘস্বর পুরনো বানানে দীর্ঘই থেকে গেছে)। আধুনিক বানানটি ভিখারি হলেই ভাল। সে থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে স্ত্রীলিঙ্গে ভিখারিণী। আধুনিক বানানটি ভিখারিনি।

বাংলায় সংস্কৃতরূপী আরবি শব্দের মধ্যে নামকরা হল মফস্বল (বর্ণান্তরে মফঃস্বল বা মপস্বল) এবং মোক্ষম। প্রথমটির ক্ষেত্রে শব্দটি আরবি (مفصل, মফস্‌সল), তবে অর্থটি একান্তই ভারতবর্ষীয়। আর দ্বিতীয়টি পুরোপুরি আরবি (محكم, মহ্‌কম), বানানটি কেবল সংস্কৃত। পুরনো দিনে (পুথিতেও হামেশা দেখা যায়) হরফ দ্বিত্বে ব-ফলা বা বিসর্গের ব্যবহার, শব্দটি সেকারণেই মফস্বল। তবে আধুনিক কালে লেখা হয় মফস্‌সল। আরবিতে শব্দটির অর্থ স্পষ্ট, পরিপূর্ণ, বিশদ, ইত্যাদি। জন টমসন প্ল্যাট্‌স-এর ১৮৮৪-সালে ছাপানো উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি ও ইংরেজি অভিধান মতে একটি সদর এলাকা ছাড়া জেলার আর সব এলাকাকে বোঝায়; শহর ছেড়ে প্রামাঞ্চল, ইত্যাদি। অন্য অর্থের ব্যবহারও অভিধানটিতে আছে: মুফস্‌সল কহনা বা মুফস্‌সল বয়ান করনা, অর্থ বিশদভাবে বলা বা বর্ণনা করা। ১৮৩৪ সালে ছাপানো জন শেক্সস্পিয়ারের হিন্দুস্তানি এবং ইংরেজি অভিধানের মতে গ্রামাঞ্চল অর্থটি ভারতবর্ষের অবদান (peculiar to India)। শব্দটি আধুনিক হিন্দিতে আছে (मुफस्सल), উর্দুতেও (مفصل)। ১৯০৩ সালের হবসন-জবসনে শব্দটি আছে, mofussil বানানে। সংসদেও তাই। Chamber's Twentieth Century Dictionary-তেও একই বানানে। হবসন-জবসনের অর্থ 'জেলার সদর বা প্রধান এলাকা বাদ দিয়ে গ্রামাঞ্চল' সব জায়গাতেই বিদ্যমান। মফস্‌সল বানানটির পরিবর্তন ঘটলেও, মোক্ষম এতটাই বাংলা (নাকি সংস্কৃত)যে এটার পরিবর্তন বোধ করি সম্ভব নয়।

Friday, October 12, 2007

(পঁচিশে মার্চের) কালরাত

চারপাশে প্রায়ই শোনা যায় (পঁচিশে মার্চের) কালোরাত (আদতে বানানটি 'কালরাত,' ও-কারটি উচ্চারণ বোঝানোর জন্য দেওয়া)। এই উচ্চারণটি শোনা যায় রেডিও বা টেলিভিশনেও। যারা কালোরাত উচ্চারণ করে তারা ভুলে যায় যে বাংলায় কয়েকটি একই বানানের কাল শব্দের মাঝে একটির অর্থ যম, মৃত্যু, সর্বসংহারক ইত্যাদি, আর অন্য একটির অর্থ কৃষ্ণবর্ণ। প্রথমটির উচ্চারণ কাল্ এবং দ্বিতীয়টির কালো। আর বাংলায় কালরাত শব্দটি এসেছে সংস্কৃত কালরাত্রি থেকে যেখানে যম, মৃত্যু বা সর্বনাশ অর্থটি বিদ্যমান। মৃত্যুর রাত, বা ভয়ানক রাত অর্থে, যদিও রাত সাধারণত কৃষ্ণবর্ণের হয়। মনিয়ের মনিয়ের-উইলিয়ামস্‌-এর সংস্কৃত অভিধানে 'কালরাত্রি'র সংজ্ঞা দেওয়া আছে the night of all-destroying time। কৃষ্ণবর্ণের সাথে বা কোকিলের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালায় উচ্চারণটি /kɑlrɑt̪/, /kɑlorɑt̪/ নয়।

Wednesday, October 10, 2007

দেবনাগরী হরফে বাংলা

দেবনাগরী হরফে দুইভাবে বাংলা লেখা হয়। এক, হিন্দির উচ্চারণের নিয়ম মেনে, যেমন पथेर पांचाली (পথের পাঁচালী, पथ का गीत); আরেক, বর্ণের প্রতিবর্ণ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে, যেমন तव शुभ नामे जागे / तव शुभ आशिष मागे / गाहे तव जय गाथा (তব শুভ নামে জাগে / তব শুভ আশিস মাগে / গাহে তব জয়গাথা)। প্রথম পদ্ধতির ব্যবহার পত্রপত্রিকায় হরহামেশা দেখা যায়। তবে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ভারত থেকে বেশ কিছু বাংলা বই ছেপে বেরিয়েছে, ভারতবর্ষের অন্য ভাষী যারা বাংলা বোঝে বা বলতে পারে কিন্তু পড়তে বা লিখতে পারে না তাদের জন্য। যেমনটি হয়েছে ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের বেলায়। গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। লেখা বাংলায় হলেও ভারতের অন্য ভাষীলোকেদের জন্য সেটি লেখা হয় দেবনাগরী হরফে এবং গাওয়া হয় হিন্দি উচ্চারণের নিয়ম মেনে। তবে বাংলা থেকে হিন্দিতে প্রতিবর্ণীকরণের জন্য তিনটি দেবনাগরী হরফের পরিবর্তন করতে হয়েছে: य़ (য), ड़ (ড়), এবং ढ़ (ঢ়)। শেষের দুটি হরফ হিন্দিতে কৃতঋণ শব্দে ব্যবহারের জন্য হলেও, প্রথমটি ব্যবহৃত হয় বাংলা লেখার জন্য। ধরা হয় য-(ẏ)-य़ আর য়-(y)-य। আমাস ১৫৯১৯-তে কিন্তু রোমক,এমনকি দেবনাগরী, প্রতিবর্ণগুলো উল্টো: য-(y)-य এবং য়-(ẏ)-य़।

Saturday, October 06, 2007

উপভাষার লেখন

বার্নার্ড শ-এর পিগম্যালিঅন নাটকে প্রফেসর হিগিন্সকে দেখা যায় একটি খাতা থেকে পড়ছে — Cheer ap, Keptin; n' baw ya flahr orf a pore gel. লন্ডনের কক্‌নি ইংরেজিতে ফুলওয়ালির বলা কথা। আন্তর্জাতিক ধ্বনিমাত্রিক বর্ণমালা ছাড়া আসল উচ্চারণ বোঝানো দায়। তাই মান্য লেখ্য রীতি বেশ খানিকটা এদিক ওদিক করে সাধারণ বোধগম্যতার মধ্যে রেখে কক্‌নি ইংরেজির ধরণ বোঝানো হয়েছে। হার্পার লি'র To Kill a Mocking Bird-এ পাওয়া যায়: Mr. Nathan put cement in that tree, Atticus, an' he did it to stop us findin' things-he's crazy, I reckon, like they say, but Atticus, I sweat to God he ain't ever harmed us, he ain't ever hurt us, he coulda cut my throat from ear to ear that night but he tried to mend my pants instead.... তেমনটি আছে চালর্স ডিকেন্স কিংবা মার্ক টোয়েনে। সাহিত্যে উপভাষা বা লোকভাষা উঠে আসবেই। সব ভাষার সাহিত্যেই হয়। বাংলায়ও, হামেশাই। শওকত আলীর (হাতের কাছে আছে বলে, বিশেষ কোনও কারণ নেই) উত্তরের খেপ-এ পাওয়া যায় — 'আইবো, সাতটা বাজলেই আইয়া পড়বো। চিন্তা নাই। ... ওস্তাদ, একটা কথা কমু?' এ রকমটি পাওয়া যাবে মানিক বন্দ্যেপাধ্যায়, পরশুরাম (রাজশেখর বসু), তারাশঙ্কর বন্দ্যেপাধ্যায় থেকে শুরু করে হাল আমলের অনেকেরই লেখায়। সাহিত্যে কোনও একভাবে উচ্চারণের কাছাকাছি লিখেই পার পাওয়া যায়। যার ওই ভাষার সাথে পরিচিতি আছে সেই কেবল স্বাদটা নিতে পারে, বাকি সবাই কল্পনার রং মিশিয়ে নিজেদের মত বুঝে নেয়। এ ধরণের উপভাষার লেখন থেকে ভাষার উচ্চারণের প্রকৃতি বোঝা যায় না। কারণ উপভাষা কিভাবে লেখা হবে তার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। 'জোর' লিখলে বোঝা যায় না এটা জোর, যেমনটি দিনাজপুরের ভাষায়, নাকি জ়োর, যেমনটি বরিশালের ভাষায় বলা হয়, ইংরেজির z-এর মত করে। বাংলা একাডেমীর ফরমায়েশ অনুসারে য হরফটি দিয়ে ইংরেজির z বোঝানোর ব্যাপারটি অনেকেই মানে না। যুক্তিও দূর্বল। কারণ সেই য-ই তৎসম এবং তদ্ভব শব্দে ইংরেজির -ধ্বনির প্রতীক, আবার আরবি-ফারসি শব্দে ইংরেজির -ধ্বনির প্রতীক। একটু গোলমেলে ঠেকে। ইউনিকোডের জগতে বোধ করি জ-নিম্নবিন্দু (জ়) জায়গা করে নেবে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসেও একই রকম ব্যবহার। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতও প্রায় একই রকম। আর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাসহ যে কোনও প্রকাশনাতেই এই বিন্দুর ব্যবহার করে আসছে। তাই বোধ করি পরশুরামের গড্ডালিকায় পাওয়া যায় — 'অয়, অয়, z‍ানতি পার না।' এই অয়-এ শুরুতে জিহ্বামূলীয় স্পর্শ ধ্বনি (glottal stop) আছে কি না তা কিন্তু দেখানো হচ্ছে না, অথচ বাংলার অনেক উপভাষায় এর বিদ্যমানতা পরিলক্ষিত। শুদ্ধ বাংলার এ-ধ্বনি এ-র মতই, তবে ধ্বনিটি সিলেটের দিকে গেলেই, ভাষাতত্ত্বের ভাষায় একটু নিচের দিকে নেমে যায় — এ-ধ্বনি এবং অ্যা-ধ্বনির মাঝামাঝি। মেদিনিপুরের বাংলায়ও এই ধ্বনি বিদ্যমান। ফরাসি-জার্মানে ধ্বনিটি আছে। মার্কিনিদের ইংরেজি বুলিতেও আছে। ইংল্যান্ডে গৃহীত উচ্চারণ (Received Pronunciation) বলতে যা বোঝায়, তাতে এই ধ্বনি নেই। ভাষাতাত্ত্ববিদরা অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা বা এই বর্ণমালার কিছু হরফ ইংরেজির হরফের সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করে।

Sunday, September 30, 2007

বাংলার রোমক বর্ণমালা

যেখানে বাংলার জন্য বঙ্গলিপি ব্যবহার করা যায় না এমন ক্ষেত্রে রোমক হরফের ব্যবহার করা হয় হামেশাই। ইংরেজিতে বা রোমক হরফ ব্যবহার করে এমন যে কোন ভাষার কোনও বইয়ে এবং ইংরেজি খবরের কাগজে প্রতিনিয়ত। আগের সংস্কৃত লেখার নিয়মে পুরোপুরি বাংলা লেখা যায় না বিধায় আন্তর্জাতিক মান সংস্থা ২০০১ সালে 'আমাস ১৫৯১৯: দেবনাগরী এবং সম্পর্কিত ইন্দীয় লেখার লাতিন হরফে প্রতিবর্ণীকরণ' নামের এক পদ্ধতি চালু করে। এই নিয়মে বঙ্গলিপির রোমক প্রতি-হরফ গুলো হল: অ (a), আ (ā), ই (i), ঈ (ī), উ (u), ঊ (ū), ঋ (r̥), এ (e), ঐ (ai), ও (o), ঔ (au), ক (k), খ (kh), গ (g), ঘ (gh), ঙ (ṅ), চ (c), ছ (ch), জ (j), ঝ (jh), ঞ(ñ), ট (ṭ), ঠ (ṭh), ড (ḍ), ঢ (ḍh), ণ (ṇ), ত (t), থ (th), দ (d), ধ (dh), ন (n), প (p), ফ (ph), ব (b), ভ (bh), ম (m), য (y), র (r), ল (l), শ (ś), ষ (ṣ), স (s), হ (h), ড় (ṛ), ঢ় (ṛh), য় (ẏ), ৎ (t[:]), ং (ṁ), ঃ (ḥ), এবং ঁ (m̐) (স্বরের সাথে ~, উপরে বসবে)। সাথে যে নিয়মগুলো মানতে হবে তা হল প্রতিটি অন্তর্নিহিত অ লিখতে হবে; এই অ-এর অনুপস্থিতি বিরাম (হস বা হল) চিহ্ন হিসেবে পরের ব্যঞ্জনের সাথে মিলে যুক্তাক্ষর তৈরি করবে। যদি কখনও বিরাম চিহ্নের কারণে অনিভপ্রেত অক্ষর তৈরি হয় তা ঠিক করার জন্য দুই অক্ষরেরর মাঝে বা কোনও অক্ষরের আগে কোলন (:) চিহ্নের ব্যবহার করতে হবে, যেমন বই (ba:i) বা বৈ (bai)। যে কোনও ব্যঞ্জনের সাথে য-ফলার জন্য y হলেও য-এ য-ফলার জন্য ẏẏ ব্যবহার করতে হবে। যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত থাকবে আর সঙ্খ্যা হিন্দু-আরবি সঙ্খ্যায় রূপান্তরিত হবে। যদি কখনও কম্পিউটারে ASCII-তে লিখতে হয় তার জন্য রোমক বর্ণমালাটি হল: অ (a), আ (aa), ই (i), ঈ (ii), উ (u), ঊ (uu), ঋ (,r), এ (e), ঐ (ai), ও (o), ঔ (au), ক (k), খ (kh), গ (g), ঘ (gh), ঙ (;n), চ (c), ছ (ch), জ (j), ঝ (jh), ঞ(~n), ট (.t), ঠ (.th), ড (.d), ঢ (.dh), ণ (.n), ত (t), থ (th), দ (d), ধ (dh), ন (n), প (p), ফ (ph), ব (b), ভ (bh), ম (m), য (y), র (r), ল (l), শ (;s), ষ (.s), স (s), হ (h), ড় (.r), ঢ় (.rh), য় (;y), ৎ (t[:]), ং (;m), ঃ (.h), এবং ঁ (~m) (স্বরের সাথে ~, আগে বসবে)।

ছাপার জন্য রোমক বর্ণমালায় বাংলার উদাহরণ: haẏato dekhibe ceẏe sudarśana uṛiteche sandhyāra bātāse. / haẏato śunibe eka lakṣmīpẽcā ḍākiteche śimūlera ḍāle. বা ASCII-তে ha;yato dekhibe ce;ye surar;sana u.riteche sandhyaara baataase. / ha;yato ;sunibe eka lak.smiip~ecaa .daakiteche ;simuulera .daale. (হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে। / হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে)।

ইংরেজি পত্রিকায় বা খবরের কাগজে বা খানিকটা সরকারি কাজে যেখানে প্রতিবর্ণীকরণ কঠিনভাবে মানার প্রয়োজন নেই, সেখানের নিয়মটা একটু আলাদা। ১৮৭১ সালে ভারতের পরিসঙ্খ্যান মহাপরিচালক উইলিয়াম উইলসন হান্টার 'ভারতীয় নামের বানানের নির্দেশিকা'য় তারই ১৮৬০ সালের দিকে তৈরি করা এক লিপ্যন্তরীকরণ পদ্ধতির প্রকাশ করে। পরের বছর ভারত সরকার তা গ্রহণ করে। সেই হান্টারীয় (Hunterian) পদ্ধতিতে দীর্ঘ স্বরের উপরে মাত্রা (macron) বসবে (যদিও সার্ভে অব বাংলাদেশ গেল শতাব্দীর আশির দশক থেকে স্থানের নামের বানানের ক্ষেত্রে এই মাত্রা আর ব্যবহার করে না): অ (a), আ (ā/a), ই (i), ঈ (ī/i), উ (u), ঊ (ū/u), ঋ (ri), এ (e), ঐ (ai), ও (o), ঔ (au), ক (k), খ (kh), গ (g), ঘ (gh), ঙ (ng), চ (ch), ছ (chh), জ (j), ঝ (jh), ঞ(ny), ট (t), ঠ (th), ড (d), ঢ (dh), ণ (n), ত (t), থ (th), দ (d), ধ (dh), ন (n), প (p), ফ (ph), ব (b), ভ (bh), ম (m), য (y), র (r), ল (l), শ (s/sh), ষ (sh), স (s), হ (h), ড় (r), ঢ় (rh), য় (ẏ), ৎ (t), ং (m/n), ঃ (h), এবং ঁ (m)। উচ্চারিত না হলে অন্তর্নিহিত অ লেখা হয় না। জ্ঞ কে gy লেখা হয়।

Friday, September 28, 2007

রোমক হরফে বাংলা

রোমক হরফে বাংলা লেখার চল অনেক পুরনো। ১৮৯৪ সালে জেনেভায় এক সংস্কৃতজ্ঞ সম্মেলনে রোমক হরফে সংস্কৃত কি ভাবে লেখা হবে তা ঠিক করা হয়। সেই নিয়ম মেনেই রোমক হরফে বাংলাও লেখা হচ্ছিল এতকাল। তারও আগে ১৭৪৩ সালে লিসবন থেকে ছাপানো বাংলার প্রথম ব্যাকরণ বই কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ (Crepar Xaxtrer Orth,bhed,)-এ ঢাকার ভাওয়াল অঞ্চলের বাংলার যে উদাহরণ দেওয়া আছে তাও রোমক হরফে, পর্তুগিজের পঠনরীতি অনুযায়ী লেখা — পিতা আমারদিগের, পরম স্বর্গে আসল। তোমার সিদ্ধি নামেরে সেবা হউক: আইসুক আমারদিগেরে তোমার রাইজ্যত [রাজ্যে]: তোমার যে ইচ্ছা, সেই হউক: যেমন পরথিবীতে [পৃথিবীতে], তেমন স্বর্গে। (Pitá amaradiguer,/ Poromo xorgué aslo./ Tomar xidhi nameré,/ Xeba houq:/ Aixuq amardigueré/ Tomar raizot:/ Tomar zé icha,/ Xei houq:/ Zemon porthibité,/ Temon xorgué.) [আধুনিক বানানে বাংলায় লেখা হল]। এরপর ১৮০৩ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাপানো জন বোর্থউইক গিলক্রাইস্ট সম্পাদিত ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট নামের এক বইয়ে তারিণীচরণ মিত্রকৃত ঈশপের একটি গল্পের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয় রোমক হরফে। ১৮৮১ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী ছেপে বের হয় রোমক হরফে। এরপর ১৯৭১ সালে সুকুমার সেনের ইংরেজিতে লেখা বাংলাভাষার ব্যুৎপত্তিকোষেও (An Etymological Dictionary of Bengali) বাংলা শব্দ রোমক হরফে লেখা। মাঝে পুরো বই রোমক হরফে ছেপে বের না হলেও এই হরফে সংস্কৃত এবং বাংলা কি করে লেখা যায় তার দিক নির্দশনা দিয়েছে আর্থার কোক বার্নেল বা কার্ল রিকার্ড লেপ্‌সিউস-এর মত আরও অনেকেই।

সেই সংস্কৃতজ্ঞদের নিয়ম যা এখন আন্তর্জাতিক সংস্কৃত প্রতিবর্ণীকরণ বর্ণমালা (International Alphabet of Sanskrit Transliteration) নামে পরিচিত, তাতে অবশ্য বাংলা লেখায় কিঞ্চিৎ অসুবিধা হয়। কারণ সংস্কৃতে বাংলার মত য়, ড় এবং ঢ় নেই। রোমক y দিয়ে সংস্কৃত য (य) এবং বাংলা য এবং য়, আর ṛ (r এর নিচে বিন্দু) দিয়ে সংস্কৃত ঋ (ऋ) এবং বাংলা ঋ এবং ড় লেখা হয়। সমস্যা হল পাঠককে বুঝে নিতে হয় একই হরফ কখন য এবং কখন য়, বা কখন ঋ এবং কখন ড়। এ সমস্যা দূর করতে আন্তর্জাতিক মান সংস্থার প্রবর্তিত আমাস ১৫৯১৯: দেবনাগরী এবং সম্পর্কিত ইন্দীয় লেখার লাতিন হরফে প্রতিবর্ণীকরণ (ISO 15919 Transliteration of Devanagari and related Indic scripts into Latin characters) পদ্ধতিতে y এর উপর বিন্দু ẏ দিয়ে য় এবং y দিয়ে য বোঝানো হয় আর r এর নিচে বিন্দু ṛ দিয়ে ড় এবং r এর নিচে বৃত্ত r̥ দিয়ে ঋ বোঝানো হয়। সমস্ত নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার ক্ষেত্রে একই নিয়ম। অনুস্বারের ক্ষেত্রে রোমক সংস্কৃত হরফের ṃ-এর নিচের বিন্দু উপরে উঠে ṁ আসে।

Saturday, September 22, 2007

বাংলার যতিচিহ্ন

বাংলার দাঁড়িই, দুই দাঁড়িও, কেবল নিজস্ব যতিচিহ্ন। বাকি সব বাংলায় এসেছে ইংরেজির অনুকরণে। নিয়মিত হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে। মধ্য বাংলায় বিরামের জন্য ব্যবহৃত হত তারকা চিহ্ন (*)। পরে সে স্থানে ব্যবহৃত হতে থাকে দাঁড়ি। দুই দাঁড়ি ছিল সাধারণত কবিতার সম্পত্তি, আগের যুগে। বর্তমানে তা টাইপোগ্রাফিক এমবেলিশমেন্ট। বাংলায় আরেকটি চিহ্নের ব্যবহার ছিল, মধ্যযুগেও। তার নাম কাকপদ (×)। প্রতিলিপির সময় কোথাও কিছু বোঝা না গেলে বা কোনও কিছু আমলে না নিলে, এখন যেমন ইংরেজি লোপচিহ্নের আদলে তিন-বিন্দু (...) ব্যবহার করা হয়, তখন বাংলা গুণনচিহ্নের মত তিনটি কাকপদ ব্যবহার করা হত।

বিদ্যাসাগরের বেতাল পঞ্চবিংশতির দশম সংস্করণ থেকে ইংরেজির আদলে যতি চিহ্নের ব্যবহার দেখা যায়। একদম শুরুর দিকে, ১৮৪০ সালে হিন্দু কলেজ পাঠশালাতে পড়ানোর জন্য 'শিশুসেবধি' নামের একটি প্রাইমার বা অ-আ-ক-খ'র বই ছাপানো হয়। এতে যতিচিহ্নের বর্ণনায় বলা আছে বাক্যের ভেদ বোধক রেখার নাম 'চিহ্ন' (,), বিচ্ছেদ ভেদবোধক রেখার নাম 'দাঁড়ি' (।) এবং লেখক কিংবা বক্তার কৃত যে প্রয়োগ তদ্বোধক চিহ্নের নাম 'অবিকল' (“”), যা এখন উদ্ধার চিহ্ন নামে পরিচিত।

নামগুলো পরে পালটে গিয়ে দাঁড়ায় পদচ্ছেদ (,), অর্ধচ্ছেদ (;), পূর্ণচ্ছেদ (।), দৃষ্টান্তচ্ছেদ (:), প্রশ্নচিহ্ন (?), বিস্ময়চিহ্ন (!), রেখাচিহ্ন (—), উদ্ধারচিহ্ন (“”) এবং পদযোজকচিহ্ন (-)। একসময় আবার বলা হত প্রাথমিকা (,), সামিকা (;)। কখনও বা কোলন ভুল করে বিসর্গ মনে না হয় তাই সাথে একটি ড্যাশ ব্যবহার করা শুরু হয়ে গিয়েছিল, নাম তার কোলন-ড্যাশ।

Friday, September 21, 2007

বাংলার হরফ, সংস্কৃতের বর্ণমালা

বাংলার হরফ নিজস্ব, তবে বর্ণমালা নিজের নয়। সংস্কৃত বর্ণক্রম বাংলার উপর চাপিয়ে দেওয়া, বা নেওয়া। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পর থেকে দুয়েকটি হরফের অবস্থান বদল।, মান্য বর্ণমালায় দু-একটি হরফের লুপ্তি। বাংলার এই হরফ তার নিজস্ব হলেও গোটা চারেক ভাষা লেখার কাজে তা ব্যবহৃত হয় বা হত। বাংলা হরফে লেখা হয়, বাংলা এবং এর উপভাষা ছাড়াও, অহমিয়া, সংস্কৃত, সাঁওতালি আর মণিপুরি। সংস্কৃতের প্রধান লিপি এখন দেবনাগরীকে ধরা হয়, বিশেষত ইংরেজদের আগমনের পর থেকে। সংস্কৃতর রোমক হরফেও লেখা হয় আর লেখা হয় ভারতীয় বেশ কয়েকটি লিপিতে, তামিল-গোত্রীয় গ্রন্থ লিপি সহ। সাঁওতালি বাংলা ছাড়াও লেখা হয় ইংরেজি, দেবনাগরী এবং ওড়িয়া হরফে। ওল চিকি বলে একটি হরফেও। মণিপুরির এক অংশ যার নাম মৈতৈ তা লেখা হয় মৈতৈ নামের এক হরফে আর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরির হরফ বাংলা। এছাড়াও বাংলা দেশের বেশ কিছু উপজাতির ভাষা যেমন খাসিয়া, আচিক, ককবরক ইত্যাদি বাংলা হরফে লেখা হয়।

বাংলা হরফে লেখা অহমিয়া, সংস্কৃত, সাঁওতালি এবং মণিপুরির উদাহরণ --- 'কিয়নো ঈশ্বরে জগতলৈ এনে প্রেম করিলে, যে, তেওঁর পুত্রত যি কোনোৱে বিশ্বাস করে, সি নষ্ট নহৈ, অনন্ত জীৱন পাবর নিমিত্তে, তেওঁর সেই একজাত পুত্রকেই দান করিলে।' (অহমিয়া)।। 'তদ্বদহং যুষ্মান্‌ ব্যাহরামি, একেন পাপিনা মনসি পরিবর্ত্তিতে, ঈশ্বরস্য দুতানাং মধ্যেহ প্যানন্দো জায়তে।' (সংস্কৃত)।। 'এন্তে ঈশ্বর দ ধারতিরেন কো নুনাঃ এ দুলাড়কেৎ কোআ, আইঃরেন একুপুত হপনে এমকোদেতায়া, যেমন উনিরে সানাম পাতিয়াউঃকো আলোকো নষ্ঠোঃ। বিচকোম জায়জুগ জিওন কো ঞাম।' (সাঁতালি, সাঁতাল পরগণা)।। এবং 'করিননো হাইববু ঈশ্বরনা তাইবংপাম্বা অসিবু অসুপ নুংশিব্বি‍া অসিনি, ইবুংঙো মহাক্বী অনিশুদবা মচা নিপা অদুবু পিবি, মচা অদুবু খাজবা মী পুম্‌নমক্‌ অদুবুদি মাংহনদনা লোম্বা নাইদবা খবাই ফন্দনি।' (মণিপুরি)।।

আসামের উত্তর প্রচলিত রংদানিয়া বা রভা ভাষায় বাংলা হরফের উদাহরণ --- 'আতানা যে কাই ঈশ্বরনি খুসি ছাংয়ে ফুসিয়া, উ আংই ফজাংবারা, আরও আংই মমব্রাতাং, জিব্রা ফজমবারতাং আরও ওনিবারা আরও জিব্রা।' অহমিয়া, সাঁওতালি এবং মণিপুরি বাক্যের বাংলা পাঠ --- 'কারণ ঈশ্বর জগৎকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার একজাতা পুত্রকে দান করিলেন, যেন, যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়।' বাইবেলের পাঠ, হিস্পানি ভাষায় 'বর্তমান ও অতীতের বর্ণমালা' ওয়েব সাইট থেকে নেওয়া।

Tuesday, September 18, 2007

বাংলার হিন্দুয়ানি, মুসলমানি

ফারসি মোঘল সাম্রাজ্যের ভাষা থাকার কারণে এবং পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহানের সময়ে সেনাদের মধ্যে উর্দুর ব্যবহারের ফলে ইংরেজদের হাতে পড়ার আগেই বাংলায় অনেক আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে, পোশাক-ধর্ম পাল্টে, কিংবা আরবি-ফারসি হিসেবেই। আঠারশ' শতাব্দীর প্রথমদিকের লেখা --- 'হোমাঙু বাদসাহের ওফাত হইলে হিন্দোস্তানে বাদসাহ হইতে ব্যাজ হইল, আপনারদের মধ্যে আত্মকলহ কইয়া বিস্তর২ লড়াই কাজিয়া হইল।' পরে বাংলা ভাষায় এই আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার কমে যায়। সাধু ভাষা হয় সাহিত্যের বাহন আর সরল ভাষা, যা গেল শতাব্দীর প্রায় দেড় দশক পরে বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষা নামে পরিচিত হয়, চলতে থাকে মুখের ভাষায়। ভারত ভাগের পরে, খানিকটা ধর্মীয় কারণে সংস্কৃতায়িত বাংলা (যা অনেকে হিন্দুয়ানি বাংলা বলে মনে করে) ছেড়ে আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্যে এক ধরণের (এসলামি) বাংলার প্রচলন ঘটে বা ঘটানো হয়। এসময় এরকম ধরণের প্রস্তাবও ছিল যে 'অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট' না লিখে 'অনেক পীরে মাজেজা নষ্ট' বলা হোক। দু-একটি উদাহরণ --- 'ফজরের আউয়াল ওয়াকতে উঠিয়া ফুফু-আম্মা চাচাজীকে কহিলেন, আমাকে জলদি এক বদনা পানি দাও। আমি পায়াখানা ফিরিয়া গোসল করিয়া নামাজ পড়িয়া নাশতা খাইব।' বা 'গোজশ্‌তা এশায়াতে আমরা অতীতে বাংলা ভাষার নানা মোড় পরিবর্তনের কথা মোখ্‌তাসার ভাবে উল্লেখ করেছিলাম।' অথবা 'শহর কলকাত্তায় শেফাউল মুল্‌ক্‌ তশরিফ রাখিতেছেন না বহুত রোজের কথা। আর তশরিফ রাখিলেই ফায়দাই বা কি? সে ছিল এক জামানা। ওজারতের তেজারত আর তেজারতের ওজারতে সুবে বাঙ্গলা ছিল সরগরম।' সংস্কৃত, আরবি-ফারসি, ফরাসি, পর্তুগিজ, তুর্কি, বর্মি সব ভাষার শব্দ নিয়েই বাংলা ভাষার, তার হিন্দুয়ানিও নেই মুসলমানিও নেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আগের বাংলায় যেমন আরবি-ফারসি ও সংস্কৃত শব্দ পাওয়া যায়, তার পরেও ঠিক তেমনই পাওয়া যায়। বাংলার ভাষার প্রকৃতি বজায় রেখে সহজে খাপ যায় এমন ভাবে বিদেশি শব্দের ব্যবহার বাংলায় ঢের সাহিত্যিকের লেখায় পাওয়া যায়। যদি কোনও ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণে লেখায় বা বাচনে সংস্কৃত বা আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য দেখা দেয়, তাহলে তা ভাষাপ্রকার (register) হিসেবে চিহ্নিত হবে।

Saturday, September 15, 2007

আরবি-ফারসি হরফে বাংলা

গেল শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর পর্যুদস্ত পরিকল্পনার বেশ কিছুদিন আগে সরকার আরও একটি ব্যাপারে নড়াচড়া শুরু করেছিল। তা হল আরবি-ফারসি (সরকার এবং মদদগারদের ভাষায় উর্দু) হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরকারের এ চেষ্টার নিন্দা জানায়। গুরুগম্ভীর কাজের জন্য, যেমন উর্দুতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায়, আরবি-ফারসি হরফে বাংলার প্রতিবর্ণীকরণ (transliteration) হতেই পারে। তবে সে সময়ের সরকার যা চেষ্টা করছিল তা হল লিপ্যন্তরীকরণ (transcription), বাংলা ভাষার উচ্চারণ অনুযায়ী উর্দুতে কাছাকাছি উচ্চারণে শব্দের পর শব্দ লিখে যাওয়া। আরবি-ফারসি হরফে বাংলার আলোচনা শোনা গেলেও ব্যাপারটা দেখতে কেমন তা বোঝা যায় না। দেখতে কেমন তার একটা ধারণা পাওয়া যায় মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত বঙ্গলা আদব কী তারীখ (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস) বইয়ে। সেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও অনেকের লেখা উর্দু হরফে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এমনই এক নমুনা, মধুসূদন দত্তর বঙ্গভাষা ---


হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;—
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর‐ধন‐লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

যদিও এক ভাষার হরফ আরেক ভাষা নিয়েছে বা আরেক ভাষার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রতিটি ভাষা তার নিজের হরফেই সুন্দর। জন বিম্‌স্‌ তার আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষার তুলনামূলক ব্যাকরণের ভূমিকায় বলেছিল --- ভারতীয় বর্ণমালার মধ্যে বাংলা সবচেয়ে সুন্দর এবং লেখতে সহজ... আধুনিক বাংলা হরফ এখন প্রাচীন ভারতীয় বর্ণমালাজাত যে কোন হরফের চেয়ে অনেক দ্রুত এবং সহজে লেখা যায়।

Friday, September 14, 2007

ঈশপের গল্পে ভাষার উচ্চারণ

আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালায় বিভিন্ন ভাষার উচ্চারণের উদাহরণ দিতে গিয়ে ঈশপের একটি গল্প উদ্ধৃত করা হয়, তার ধ্বনিতাত্ত্বিক লেখন সহ। The North Wind and the Sun were disputing which of them was stronger, when a traveller came along wrapped in a warm cloak. They agreed that the one who first succeeded in making the traveller take his cloak off should be considered stronger than the other. Then the North Wind blew as hard as he could, but the more he blew, the more closely did the traveller fold his cloak around him; and at last the North Wind gave up the attempt. Then the Sun shone out warmly, and immediately the traveller took off his cloak. And so the North Wind was obliged to confess that the Sun was the stronger of the two. গল্পটির একটি নীতিকথা আছে। তা থাক। ধ্বনিতত্ত্বে গল্পটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয় তার ধ্বনিতাত্ত্বিক লেখনের মাধ্যমে ভাষার উচ্চারণের উদাহরণ দেখানোর জন্য। ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত Principles of the International Phonetic Association-এ গল্পটির ৭০টির মত পাঠের লেখন ছাপা হয়েছিল। মাঝে মাঝে Journal of the International Phonetic Association-এ বেশ কিছু ভাষার উচ্চারণ এভাবে দেখানো হয়েছে। ১৯৯৯-সালে ছাপানো Handbook of the International Phonetic Association-এ ২৩টি ভাষার উচ্চারণ এ গল্পের পঠনে দেখানো হয়েছে। ১৯২২ সালে Bulletin of the School of Oriental Studies, University of London-এ প্রকাশিত Phonetic Transcriptions from Indian Languages নামের সুনীতিকুমারের একটি লেখায় সম্ভবত গল্পটির বাংলায় একটি উদাহরণ ছাপা হয়েছে (কখনও হাতে পড়েনি)। গল্পটির বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়: 'উত্তুরে বাতাস আর সূর্য তাদের মধ্যে কে বেশি শক্তিশালী তা নিয়ে ঝগড়া করছিল। এমন সময় এক পথিক গরম জামা গায়ে সে পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বাতাস আর সূর্য দুজনেই রাজি হল তাদের মধ্যে যে পথিককে তার জামা খুলতে বাধ্য করতে পারবে সেই হবে বেশি শক্তিশালী। এরপর উত্তুরে বাতাস তার ভীষণ বেগে বইতে লাগল। বাতাসের জোর যত বাড়তে থাকল পথিক তত শক্ত করে জামা গায়ে জড়াতে থাকল। অবশেষে বাতাস হাল ছাড়ল। এবার সূর্য প্রবল তেজ ছড়াতে লাগল। সেই সাথে পথিক তার গরম জামা খুলে ফেলল। আর উত্তুরে বাতাস মেনে নিল যে সূর্য বেশি শক্তিশালী।' সাদামাটা ধ্বনিমূলক (phonemic) লেখনে — /ut̪t̪ure bɑt̪ɑʃ ɑr ʃurdʒo t̪ɑd̪̪er mod̪ʱːe ke beʃi ʃokt̪iʃɑli t̪ɑ nie dʒʱɔɡɽɑ kortʃʰilo. æmon ʃɔmɔĕ æk pot̪ʰik ɡɔrom dʒɑmɑ ɡɑĕe ʃe pɔt̪h d̪ie ɦẽʈe dʒɑtʃʰːilo. bɑt̪ɑʃ ɑr ʃurdʒo dudʒɔnei rɑdʒi holo t̪ɑd̪er mod̪ʱːe dʒe pot̪ʰikːe t̪ɑr dʒɑmɑ khult̪e bɑd̪ʱːo kort̪e pɑrbe ʃei hɔbe beʃi ʃokt̪iʃɑli. erpɔr ut̪t̪ure bɑt̪ɑʃ bʱiʃɔn beɡe boit̪e lɑɡlo. bɑt̪ɑʃer dʒor dʒɔt̪o bɑɽt̪e tʰɑklo pot̪ʰik t̪ɔt̪o ʃɔkt̪o kore dʒɑmɑ ɡɑĕe dʒɔɽɑt̪e t̪ʰɑklo. ɔboʃeʃe bɑt̪ɑʃ ɦɑl tʃʰɑɽlo. ebɑr surdʒo probol t̪edʒd tʃʰɔɽɑt̪e lɑɡlo. ʃei ʃat̪ʰe pot̪ʰik t̪ɑr ɡɔrom dʒɑmɑ khule phelːo. ɑr ut̪t̪ure bɑt̪ɑʃ mene nilo dʒe surdʒo beʃi ʃokt̪iʃɑli./ কোনও রকম স্বরাঘাত চিহ্নের ব্যবহার করা হয়নি।

Monday, September 10, 2007

মান্য বাংলা, লেখায় এবং বাচনে

ভাষা পাল্টায় বিভিন্ন সময়ে আর ভাষা একই সময়ে পাল্টায় বাধায় — নদীই হোক, পাহাড়, জনপদের অভাব কিংবা রাজনৈতিক সীমরেখা। সময়ের রেখায় পাল্টানো ভাষার পরিচিতি পুরনো, মধ্যযুগীয় বা আধুনিক বাংলার মাঝে। ভিন্ন শতাব্দীর ভিন্ন বাংলাও এর নিদর্শন। আর একই সময়ে অবস্থানগত পাল্টানো বাংলার আরেক নাম আঞ্চলিকতা, ঢাকার বাংলা বা বীরভূমের বাংলা। এধরণের বাংলায় আবার সময়ে পাল্টানো বাংলার ছাপ থেকে যায়। তারপরেও, অত্যুৎসাহী কিছুলোকের ভাবাদর্শী মতের বাহুল্য বাদ দিলে, বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের মান্য চলতি বাংলা একই, লেখক বা ক্ষেত্রবিশেষে আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য বা সংস্কৃত শব্দের বাড়তি ওজন, এটুকুই যা বিবেচ্য। সাধারণভাবে কেবল কাকা-চাচা, মাসি-খালা, নমস্কার-সালাম বা জল-পানি ইত্যাদিই চোখে পড়ে বা সাধারণ আলোচনায় উঠে আসে। কারণ বোঝা বা বোঝানোর সুবিধা। কার্যসূচী-কার্যক্রম, জলহাওয়া-আবহাওয়া, কুড়ি-বিশ বা আরও অনেক শব্দের কথা নিয়ে আলোচনা দেখা যায় না। কলকাতায় মান্য বাংলায় প্রথম পুরুষের একবচনে সাধারণ অতীত কালে ক্রিয়ার শেষে -এ যোগ করা হয় (চলন্তিকা-রও তাই মত), ও কি বললে? ঢাকায় মান্য বাংলায় তেমনটি দেখা যায় না। কলকাতার 'ও কি বললে?'-র জায়গায় ঢাকায় হয়ত বলা হয় 'সে কি বলল?' এই 'ও' এবং 'সে' — সেও খানিকটা বিভদই। বাংলাদেশে একটা, দুইটা, তিনটা, চারটা এবং পাঁচটা, কিন্তু কলকাতায় একটি, দুটো, তিনটে, চারটে এবং পাঁচটা। সচেষ্ট বাচন ছাড়া বাংলাদেশে বাংলার চন্দ্রবিন্দুর দেখা পাওয়া (নাকি শোনা?) ভার। উচ্চারণেও কিছুটা গরমিল বর্তমান, যদিও মান্য বাচনে তা ধরা হয় না। কলকাতার লোকেরা আজকে /̍ɑdʒke/ উচ্চারণে জ-এর ঘোষতা বজায় রাখতে গিয়ে পরের ক-কে খানিকটা ঘোষতা প্রদান করে /̍ɑdʒk̬e/, আর ঢাকার লোকেরা ক-এর অঘোষতা বজায় রাখতে গিয়ে জ-কে ঘোষতারহিত করে ফেলে /̍ɑdʒ̊ke/। দুটোই সমীভবন, সামনে এবং পিছনে। একই রকমভাবে (চুল) আঁচড়ে /̍ɑ͂tʃɽe/ কলকাতায় /̍ɑ͂t̬ʃɽe/ আর ঢাকায় /̍ɑtʃre/। হয়ত অনেক অনেক দিন পর বাংলার দু'টি রূপ জন্ম নেবে — সময়ে, রাজনৈতিক সীমারেখায়। হয়ত তেমনটি ঘটবেই না, দুই রাজনৈতিক ভূখণ্ডের নৈকট্যের কারণে। তবে এখনও পর্যন্ত বাংলার মান্যরূপ হরেদরে একটিই, ঢাকায়ই হোক, কলকাতায় বা লন্ডনে।

Thursday, August 09, 2007

জাদু এবং যাদু

জাদু না যাদু, কোনটি শুদ্ধ বানান? প্রশ্ন এক সহকর্মীর। কারণ বাংলা একাডেমীর বাংলা অভিধানে প্রথমে যাদু, পরে জাদু। বাংলা-ইংরেজি অভিধানে অবশ্য ক্রমটি উল্টো। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে জাদু ও যাদু দুই'ই আছে, আলাদা মূখ্যভুক্তি হিসেবে। সাথে নিষ্পন্ন শব্দ --- জা(যা)দুক(গ)র, জা(যা)দুক(গ)রী, জা(যা)দুঘর, ইত্যাদি। হরিচরণে জা(যা)দুকর, জা(যা)দুকরী, জাদুগিরী, জাদুঘর এবং যাদুগীর, আবারও আলাদা ভুক্তি। যোগেশচন্দ্রে জাদুগ(ক)র, জাদুগরি, জাদুঘর এবং যাদু (আলাদা ভুক্তি)। চলন্তিকায় জাদু, জাদুকর, জাদুঘর এবং যাদু (জাদু-দেখ হিসেবে)। শেখ গুলাম মাকসুদ হিলালি'র Perso-Arabic Elements in Bengali-তে জাদু, জাদুক(গ)র, জাদুক(গ)রী, জাদুঘর। যাদুও বিদ্যমান, জাদু-দ্রষ্টব্য হিসেবে। উইলিয়াম গোল্ডস্যাকের A Mussalmani Bengali-English Dictionary-তে জাদু, জাদুকর/রী, এবং জাদুঘর। কাজি রফিকুল হকের বাংলা ভাষায় আরবী ফার্‌­সী তুর্কী হিন্দী উর্দু শব্দের অভিধানে, জাদু, যাদু, জাদুকর/যাদুকর/জাদুগর, জা(যা)দুকরী, এবং জা(যা)দুঘর।

চলন্তিকা দেখলে বোঝা যায় জাদু, জাদুকর এবং জাদুঘরই প্রচলিত, কারণ ব্যবহারিক অভিধান প্রচলন নির্দেশ করে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত ১৯৩৬ সালের বানানের নিয়মে বলা আছে অসংস্কৃত (অর্থাৎ তদ্‌ভব, দেশজ ও বিদেশী) শব্দে 'য না লিখিয়া জ লেখা বিধেয় --- "কাজ, জাউ..."।' বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম-এ লেখা আছে অতৎসম 'শব্দ বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি-অনুযায়ী লিখতে হবে। যেমন: কাগজ, জাহাজ... জেব্রা।... ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে... য ব্যবহৃত হতে পারে।... তবে কেউ ইচ্ছা করলে ... জ ব্যবহার করতে পারেন।' পরের একবাক্যের অনুচ্ছেদে বলা: 'জাদু, জোয়াল, জো, ইত্যাদি শব্দ জ দিয়ে লেখা বাঞ্ছনীয়।'

বাংলার প্রায় সব অভিধান মতে জাদু শব্দটির আগমন ফারসি জাদূ (جادو) (ফারসিতে শেষের স্বরটি দীর্ঘ) থেকে। ফারসিতে জাদূ থেকে বাংলায় প্রচলিত নিষ্পন্ন শব্দগুলি হল জাদূগর (جادوگر), জাদূ কর্‌দন্‌ (جادوکردن) যা থেকে হিন্দি বা উর্দুতে জাদূ করনা (जादू करना, جادوکرنا)। জাদূবী (অন্তস্থ ব দিয়ে, جادویی), ঐন্দ্রজালিক। জাদূগর (جادوگر) বা জাদূকার (جادو کار)। তবে জাদুঘর শব্দটি বাংলার নিজস্ব অবদান। ফারসিতে আজাইব খানেহ (عجائب خانه) বা মুজে অথবা মুজে খানেহ (موزه বা موزه خانه, ফরাসি ম্যুজে থেকে)। উর্দুতে অজাইব খানা (عجائب خانه), অজাইব ঘর বা জাদুঘরও চলে। হিন্দিতে জাদূঘর (जादूघर)।

আঠারশ' চুরাশিতে প্রকাশিত জন টি প্ল্যাট্‌স্‌-এর উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি এবং ইংরেজি অভিধানে ফারসি জাদূর বুৎপত্তি দেখানো হয়েছে: P jadu [Old P. yadu, yatu; Pehl. yatuk; Zend yatu; S. yatu]। তবে আর বাকি যা সব যা হোক, শব্দটি অসংস্কৃত বা অতৎসম, এবং জ দিয়ে লেখাই বিধেয়।

Monday, August 06, 2007

ভিত্তি যেখানে রোমক হরফ

বাংলা কম্পিউটিং-এ ফোনেটিক কি-বোর্ড (শুরুতে বাংলায় যোজকপাটাও বলা হত) বলে একটি কথা চালু আছে। যারা ইংরেজি (QWERTY) কি-বোর্ডে টাইপ করে অভ্যস্ত তারা রোমক প্রায়-সমোচ্চারিত হরফ চেপে বাংলা লিখতে পারে। শব্দটি অনেক দিন ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে তার কোনও অর্থ দাঁড়ায় না। ভাষাতত্ত্বে ফোনেটিক অর্থ ধ্বনিগত, যার ব্যাখ্যা হতে পারে যেমন উচ্চারণ তেমন বানান। ভাষার আঞ্চলিকতার কারণে যদি পুষ্প-কে কেউ হুইশ্‌শো বলে তাহলে তাই, আবার কেউ ফুশফো বললেও তাই। এভাবে তো আর বাংলা লেখা হয় না। হলেও তা আর মান্য বাংলা থাকে না। আসলে ফোনেটিক কি-বোর্ড বলতে যা বোঝানো হয় তা হল রোমক হরফভিত্তিক বাংলা কি-বোর্ড, ইংরেজিতে Roman Bangla keyboard (layout), QWERTY-based Bangla keyboard (layout), অথবা Dvorak layout-based Bangla keyboard (layout) বলা যেতে পারে। একটু লম্বা, অর্থটি কিন্তু পরিস্কার ধরা পরে।

Tuesday, July 31, 2007

মান্য বাংলার ধ্বনিমূল

সাধারণত যা মান্য বাংলা, চলিতই হোক বা সাধু, তার ধ্বনিমূলের সংখ্যা প্রধানত ৪৫ --- ৮টি স্পৃষ্ট (/p b t d ʈ ɖ k ɡ/), ২টি ঘৃষ্ট (/tʃ dʒ/), ১টি তাড়িত (/ɽ/), ১১টি মহাপ্রাণ (/ pʰ bʱ t̪ʰ d̪ʱ ʈʰ ɖʱ kʰ ɡʱ tʃʰ dʒʱ ɽʱ/), ৩টি নাসিক্য (/ m n ŋ/), ২টি উষ্ম (/ʃ ɦ/), ১টি কম্পিত (/r/), ১টি পার্শ্বিক(/l/), ২টি নৈকট্যক (/ĕ ŏ/), ৭টি সাধারণ স্বরধ্বনি (/i e æ ɑ ɔ o u/), এবং ৭টি অনুনাসিক স্বরধ্বনি (/ɪ̃ ẽ æ̃ ɑ̃ ɔ̃ õ ũ/)।

উষ্ম /s/ ধ্বনিকে মান্য বাংলার /ʃ/ ধ্বনিমূলের সহধ্বনি হিসেবে ধরা হয়। এছাড়াও ৫টি ধ্বনিমূলকে /f v ɸ β z/ গৌণ ধ্বনিমূল হিসেবে ধরা হয়। সাধারণভাবে এগুলো লোকের প্রচলিত বুলিতে না শোনা গেলেও, শিক্ষিত বুলি বা সচেষ্ট উচ্চারণে প্রায়ই শোনা যায়। বাংলায় আরও ৬টি বিদেশি ধ্বনিমূলের /q ʕ ʒ x ɣ ħ/ সাক্ষাত পাওয়া যায়, একটি ইংরেজি শিক্ষিত লোকের বুলিতে, আর বাকিগুলো ভাল আরবি-ফারসি জানা লোকের বাচনে।

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলায় ধ্বনিমূল ৩৫টি, সাথে ৫টি গৌণ ধ্বনিমূল। উষ্ম /s/ একটি আলাদা ধ্বনিমূল, এবং মহাপ্রাণতা আলাদা ধ্বনিমূলতার দাবি রাখে না। রামেশ্বর শ'র মতে ধ্বনিমূল ৪৪টি, ২টি উষ্মধ্বনি সহ। পবিত্র সরকারের মতে ধ্বনিমূলের সংখ্যা ৪৭। চার্লস্‌ ফার্গুসন ও মুনীর চৌধুরীর মতে ধ্বনিমূলের সংখ্যা ৪৭। রফিকুল ইসলামের মতেও তাই। তবে কারও কারও মতে বাংলায় নৈকট্যকের সংখ্যা চার, কারও মতে /s/ আলাদা ধ্বনিমূল।

Saturday, July 28, 2007

জিহ্বা, বিহ্বল, আহ্বান

জিহ্বা, বিহ্বল আর আহ্বান। বাংলার হ-এ ব-ফলার উচ্চারণ কেমন? সাধারণভাবে মান্য চলিত উচ্চারণ হল জিউভা (dʒiu̯bʱɑ), বিউভল্‌ (biu̯bʱɔl), আর আওভান্‌ (ɑo̯bʱɑn)। যদিও অনেকই জিহ্অব্‌বা, বিহ্‌অব্‌বল্‌ বা আহ্‌অব্‌বান্‌ অথবা জিহোবা, বিহোবল্‌ বা আহো‌বান্‌ উচ্চারণ করে থাকে, যা কোনও এক সময় মান্য বলে গৃহীত হলেও হতে পারে, তবে এখনও অপাঙ্ক্তেয়। ছোটবেলায় ইশ্‌কুলের (দিনাজপুর জিলা স্কুল) পণ্ডিতমশায়ের ভাষ্যে এগুলোর উচ্চারণ জিব্‌ভা (dʒibʱːɑ), বিব্‌ভল (bibʱːɔl) বা আব্‌ভান (ɑbʱːɑn)-ও সম্ভব। সংসদের উচ্চারণ অভিধানে আছে বহ্বারম্ভ-এর উচ্চারণ বব্‌ভারম্‌ভো (bɔbʱːɑrɔmbʱo), পরে বওভারম্‌ভো (bɔo̯bʱɑrɔmbʱo)। সুভাষ ভট্টাচার্যের বাংলাভাষা চর্চা-য় ও তাই। বোঝা যায় আদিতে ব্‌ভ-দিয়েই উচ্চারিত হত। কালে বহুল প্রচলিত শব্দে ব্‌ভ বওভ-এ রূপ নেয়।

Tuesday, July 17, 2007

আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক/ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা

আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা, ধ্বনি বর্ণমালা, নাকি ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা? হিন্দিতে অন্তর্রাষ্ট্রীয় ধ্বন্যাত্মক লিপি (अन्तर्राष्ट्रीय ध्वन्यात्मक लिपि)। আদিতে ফরাসি আলফাবে ফোনেতিক অ্যাঁত্যারনাসিওনাল (Alphabet phonétique international), এবং তারই ইংরেজি রূপ ইন্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যালফাবেট (International Phonetic Alphabet)এর অনুবাদ বাকি সব; জর্মনে, ইন্টারনাট্‌সিওনালেস ফোনেটিশ্যস আলফাবেট (Internationales Phonetisches Alphabet), রুশে, মেঝ্‌দুনারোদ্‌নিই ফোনেতিচেস্কিই আলফাবিত (Международный фонетический алфавит), ইত্যাদি। বর্ণমালায় ধ্বনিমূলক সংকেত থাকলেও তা দিয়ে বাচনের ধ্বনিগত রূপও লেখা যায় এবং একারণে কোন ভাষার ধ্বনিমূলক (phonemic) এবং ধ্বনিগত (phonetic) উচ্চারণ লেখার জন্য এই বর্ণমালা। এই বিচার থেকে এর নাম ফরাসিতে phonétique বা ইংরেজিতে phonetic হলে এর বাংলা হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক ধ্বনিগত বর্ণমালা, ধ্বনিমূলক নয়। আর যদিবা ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে কারবার বলে সংস্থার নাম phonetic association থেকে phonetic হয়ে থাকে, তাহলে তার বাংলা নাম হওয়া উচিত, ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা। ধ্বনিতত্ত্ব থেকে ধ্বনিতাত্ত্বিক। বেশিরভাগ বইতেই ধ্বনিমূলক বর্ণমালা কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। উইকিপেডিয়াতেও। দু'য়েক জন ঝামেলা এড়াতেই বোধ করি একে ধ্বনি বর্ণমালা বলেছে। বাংলা একাডেমীর ১৯৯০-এর 'ভাষাতত্ত্ব পরিভাষাকোষ'-এ ধ্বনিমূলক বর্ণমালা এবং পরে ধ্বনি বর্ণমালা লেখা আছে। কেউ কেউ আবার ধ্বনি লিপি বা লিপিমালাও বলেছে।

Saturday, July 07, 2007

বাংলা লিখনের নতুন হরফ, নববাংলা

নববাংলা বলে একটা ব্যাপার বেশ কিছুদিন ধরে নীরবে থেকে হঠাৎ করেই জ্বলে উঠে নিভে গেল। নিভে গেল কারণ, এর ওয়েব সাইটে এখন আর ঢোকা যায় না। কারণটি অবশ্য জানা নেই। তবে অনেক ব্লগে এর বিরুদ্ধে বক্তব্য আছে বেশ, কিঞ্চিৎ স্তুতিও, বুঝে বা না বুঝে। নববাংলা হল বাংলা লেখার নতুন হরফ এবং লিখন পদ্ধতি, মোটামুটি ধ্বনিমূলক এবং উচ্চারণ ভিত্তিক (মোটামুটি, কারণ এর ধ্বনিমূলতা এবং উচ্চারণের ভিত্তিতে স্পষ্টত গলদ লক্ষ্যণীয়)। উদ্ভাবক বা উদ্যোক্তা হল শাহ এম মুসা, ইন্টেল কর্পোরেশনের একজন মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইনার। তবে নববাংলার ওয়েব সাইটে আর ঢোকা না গেলেও ভারতীয় ভাষাবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা 'ল্যাঙ্গুয়েজ ইন ইন্ডিয়া'-র ষষ্ঠ সঙ্খ্যায় (পহেলা জানুআরি ২০০৬) একটি লেখা ছিল --- "এ সিম্প্‌ল স্ক্রিপ্ট ফর বাংলা অ্যান্ড দি আইপিএ ম্যাপিং দেয়ারঅব।" ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে ঢাকায় সঙ্ঘটিত একটি অনুষ্ঠানে পেশ করা একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টশনও (নববাংলা অ্যান্ড দি ফনেটিক্‌স দেয়ারঅব) ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, এক সময় অন্তত যেত। ২০০৬-এর মাঝামাঝি ঢাকার পত্রিকাগুলোতে এ সম্পর্কে লেখাও ছাপা হয়। এই লিপি উদ্ভাবনের কাজ ২০০৪-এর আগে থেকেই সম্ভবত হয়ে আসছে। এইসব লেখার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে নববাংলার সমস্ত ব্যঞ্জন ধ্বনিমূলক, স্বরচিহ্ন ব্যঞ্জনের পরে বসে, লেখার রীতি অ্যালফাবেটিক, এবং যুক্তবর্ণ বিযুক্ত, অন্তত উদ্ভাবকের তাই ধারণা। লেখাটিতে বাংলা ধ্বনিমূলের আলোচনার দিকে যত কম দৃষ্টি দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।

তবে উদ্ভাবকের ধ্বনিমূলকতা ধারণা একেবারেই ভুল। কারণ নববাংলার লেখার রীতিতে প্রকাশ পায় যে প্রতিটি ব্যঞ্জনই হলন্ত, অনেকটা রোমান হরফের মত, বাংলা অন্তর্নিহিত অ সেখানে অনুপস্থিত। বাংলায় ক অর্থ ক্‌ + অ; কিন্তু নববাংলায় ক অর্থ ক্‌, বাংলার ক লিখতে একটি অ-দ্যেতক হরফ ব্যবহার করতে হবে, আর তাই অজগর-এর র-এর অ-কে লেখা হয় না। ধরে নিতেই হয় উচ্চারণানুগ বানান। মজার ব্যাপার হল বাংলায় সাধারণ উচ্চারণ হল অজোগর্‌, তবে নববাংলায় লেখা হয় অজ্‌অগ্‌অর। উদ্ভাবকের পূর্ণিমা বানান ধ্বনিমূল থেকে সরে গিয়ে অনেকটা বাংলার অক্ষরানুগ। কারণ নববাংলায় শব্দটির দীর্ঘ ঊ লেখা হয়, আবার মূর্ধন্য ণ-ও লেখা হয়। বাংলায় ধ্বনিমূলতার দিক দিয়ে হ্রস্ব উ এবং দীর্ঘ ঊ-র মাঝে কোনও প্রভেদ নেই। তেমনি মূর্ধন্য ণ এবং দন্ত্য ন-এর উচ্চারণও এক। সাধারণভাবে বাংলায় ঞ-এর উচ্চারণ য়ঁ এবং যুক্তবর্ণে ন, তাহলে ঝঞ্ঝাট বানানে নববাংলায় ঞ-এর ব্যবহার কেন? অ-তিরোহিত ত দিয়ে যদি 'হঠাত' লেখাই যায়, তাহলে বর্ণমালায় খণ্ড-ত রাখা কেন? নববাংলায় দুঃখ বানান 'ক্‌খ' দিয়ে লেখা হয়, আবার বিসর্গ দিয়েও লেখা যায়। এখানে বিসর্গের উচ্চারণ কোথায়? যেহেতু হরফ-পশ্চাৎ হ্রস্ব-ইকে দু'বার লিখে দীর্ঘ-ঈ লেখা হয় নববাংলায়, (আমি) দিই-কে কিভাবে লেখা হবে? নববাংলার হিসেবে তাকে কি 'দী' পড়বার অবকাশ থাকবে না?

উদ্ভাবক বাংলার উচ্চারণ বা প্রতিলিপিকরণ বা লিপ্যন্তরীকরণ (transcription) বানানো হরফে লিখতে গিয়ে প্রতিবর্ণীকরণ (transliteration) দ্বারা অজান্তেই প্রভাবিত। পৃথিবীতে প্রচলিত যে কোনও হরফে বাংলার প্রতিবর্ণীকরণ হলে তা কখনই ধ্বনিমূলক হবে না। কারণ বানান (প্রতিবর্ণীকরণ) এবং উচ্চারণ (প্রতিলিপিকরণ) দুটো দুই বস্তু।

শেষে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে উচ্চ-প্রযুক্তির যুগে গণকযন্ত্রে বৈদ্যুতিন বার্তা আর মুঠোফোনে সংক্ষিপ্ত বার্তা লিখতে গিয়ে বাংলায় লিখতে পারার যোগ্যতা বা সুযোগের অভাবে চ্যাংড়ার দল রোমান হরফে এক ধরণের বাংলা লিখে থাকে, তা যতই দৃষ্টিকটু এবং অবোধ্য হোক না কেন নববাংলার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বনিমূলক। নববাংলা হয়ত বাংলার ইতিহাসে উটকো বানানো লিখনপদ্ধতি (constructed script) হিসেবে অত্যুৎসাহী-অবোধ্যতাগামী গুটি কয়েক লোকের মাঝে টিকে থাকবে। আর ব্যক্তিগত বা বিশেষ কোন কাজে ব্যবহারের জন্য লিখন পদ্ধতি যে কেউই বানাতে পারে। তাতে বাধা দেবার কিছু নেই।

Friday, July 06, 2007

উচ্চারণের উপসর্গ

বাংলা ভাষায় বানান দেখে উচ্চারণের (ইংরেজিতে যাকে phonics বলে) একটি নিয়মে বলা হয় যে তিন অক্ষরের কোন শব্দের আদিতে অ, আ, এ বা ও থাকলে এবং মাঝে অ থাকলে, মাঝের অ-এর উচ্চারণ হয় ও-এর (/o/) মত। যেমন, ফসল (ফশোল), ছাগল (ছাগোল), বেতন (বেতোন), ভোজন (ভোজোন), ইত্যাদি। এর প্রথম ব্যতিক্রমটি হল যদি প্রথম অক্ষরটি অ(না-বোধক)- বা স(সাথে-বোধক)- উপসর্গ হয়, তাহলে মাঝের অ-এ উচ্চারণের কোনও হেরফের হবে না। সাধারণভাবে বলা যায় উচ্চারণ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উপসর্গের কোনও দাম নেই। অথচ আমরা হামেশাই অজর (অজোর), সজল (শজোল), সফল (শফোল) বা অমর (অমোর) উচ্চারণ করে আসছি। সচেতন বাচন ছাড়া আর কোথাও নিয়মমাফিক উচ্চারণটি শোনা যায় না, তবে একেবারেই যে না তাও নয়।

Thursday, July 05, 2007

সম্মার্জিত গালাগাল

ইংরেজিতে আপত্তিকর, অশ্লীল গালাগাল লেখার নিয়ম একেক জায়গায় একেক রকম। কোনও কোনও প্রকাশন সংস্থা শব্দটির শুরুর হরফের পরে বাকি হরফের জায়গার তারকা চিহ্ন বসিয়ে দেয়। যেমন, f***ing । কেউ কেউ শুরুর হরফটিও তারকার চিহ্নে প্রকাশ করে, যেমন, ****ing। অনেকে আপত্তিকর শব্দের সব হরফের জন্য কেবল একটি তারকা চিহ্নের ব্যবহার করে, যেমন, f*ing। অনেক জায়গায় বন্ধনীর মধ্য লেখা থাকে expletives deleted। বেশ আপত্তিকর, উচ্চারণ করা বা লেখা যাচ্ছে না। অনেকে আবার এত বায়ানাক্কা না করে পুরো শব্দটি লিখে ফেলে।

এই তারকা চিহ্নের ইংরেজি রীতি অনুসারে (হনুসারে কি হওয়া উচিত, অনুকরণ আর হ[নুমানের মত অ]নুকরণের পার্থক্যটুকু বোঝাতে), বাংলা ব্লগের কয়েকটি পোস্টে পাওয়া যাচ্ছে চো*না। বোকা*োদা-ও কি? গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথা উঠতেই পারে। তবে ব্যবহারটাও বাংলায় খানিকটা অভিনব। ইংরেজির আদলে তারকা চিহ্ন ব্যবহার না করে বাংলার তারকা চিহ্ন, যা কিনা মাত্রা ছাড়িয়ে উপরে উঠে না, বা কাকপদ, যা দেখতে খানিকটা গুণ চিহ্নের মত, ব্যবহার করলে দেখতে ভাল হত। আবার ড্যাশের ব্যবহারও খারাপ লাগবে না। যেমন, চো-না, বোকা-দা, ইত্যাদি।

বাংলা ভাষায় অক্ষরের ব্যবহার এ ধরণের গালাগাল সম্মার্জন দেখতে পাওয়া যায়। বাংলা অভিধানে আছে 'শকার-বকার করা,' অর্থ শালা-বাঞ্চোত বলে গালি দেওয়া বা অশ্লীল গালি দেওয়া। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দ্রষ্টব্য।

Wednesday, July 04, 2007

উদ্যোগ, উদ‌্‌যোগ

কয়েকদিন আগের ঘটনা। এক টেলিভিশন সাংবাদিক বন্ধুর প্রশ্ন উদ্যোগ-এর উচ্চারণ উদ‌্‌যোগ আদতেই ঠিক কি না? হাল আমলে টেলিভশন চ্যানেলগুলো লিখছে উদ্যোগ আর বলছে উদ্‌যোগ‌। উদ্‌যোগ হল উদ্যোগের ভেঙ্গে লেখা রূপ। দ্‌ + য দু'ভাবেই লেখা যায়। প্রাকৃত ভাষায় সংস্কৃত শব্দটি ভেঙ্গে উজ্জোগ হয়েছিল। চৈতন্যচরিতকার এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের সংস্কৃতায়নের কারণে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত রূপটি ফিরে আসে। তবে উচ্চারণ দুটি শব্দের দু'রকমই হওয়া উচিত। সংসদের অভিধানে দু'টির উচ্চারণ দু'রকম --- উদ্যোগ (উদ্‌দোগ) আর উদ্‌যোগ (উদ্‌জোগ)। জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউটের অভিধানে --- উদ্যোগ (উদ্‌জোগ)। এভাবে সাধারণ লোকেরা কেউ বলে না। যারা কবিতা আবৃত্তি করে, তার হয়ত করে। কিংবা যারা গান করে, যদিও এরকম একটি শব্দ গানে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। আর বাংলা একাডেমীর অভিধানে --- উদ্যোগ (প্রথমে উদ্‌দোগ, পরে উদ্‌জোগ)। এ বাংলার উচ্চারণ অভিধান এখনও লোকেদের কথার উপর ভিত্তি করে লেখা হয় না।

Tuesday, July 03, 2007

ডেঙ্গুর নাম হাড়ভাঙ্গা জ্বর

ইংরেজিতে যা dengue, বাংলা তা ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু জ্বর। ২০০০ সালে জ্বরের প্রকোপ নতুন করে দেখা দেয় ঢাকায়। এরও অনেক আগে ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে ঢাকায় ডেঙ্গু বা একই রকম জ্বর ধরা পড়ে। তখন নাকি ঢাকার স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তারা একে 'ঢাকা জ্বর' বা 'ঢাকার জ্বর' বলত। বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে শব্দটি আছে 'ডেঙ্গু' এবং 'ডেঙ্গো' রূপে, অর্থ বিশ্লেষণে বলা আছে এটি 'হাড়ভাঙ্গা জ্বর'। ২০০৫-এর সেপ্টেম্বরের শুরুতে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক স্বাস্থ্য পাতায় লেখা হয়েছিল একে আগে লোকেরা break-bone fever বলে জানত। অর্থাৎ কিনা, হাড়ভাঙ্গা জ্বর। ইংরেজি অভিধান Concise Oxford English Dictionary-র মতে ইংরেজিতে যা ডেঙ্গি তা breakbone fever বা dandy fever নামেও পরিচিত। শব্দটি এসেছে সোয়াহিলি denga বা dinga থেকে হিস্পানি dengue হয়ে। ইংরেজিতে, তারপরে বাংলায়।

Monday, July 02, 2007

দশের পাতা, পাঁচদিনের দিন

বাংলায় দু'ধরণের ক্রমবাচকশব্দের প্রচলন। তৎসম ও তদ্ভব। তৎসম বা সংস্কৃত থেকে নেওয়া ক্রমবাচক শব্দের ব্যবহার সব ক্ষেত্রে করা গেলেও, গুনতে থাকলে খানিক পরেই অন্তত চলতি ভাষায় বড় বেমানান ঠেকে। সাধু রীতিতে খানিকটা বিপত্তি বিদ্যমান। সংস্কৃতের লিঙ্গের জের ধরে প্রথম বালক এবং প্রথমা বালিকা লেখা কতখানি গ্রহণযোগ্য হবে তা প্রায়ই ঠিক বোঝা যায় না। আবার তদ্ভব বা প্রাকৃত বা অপভ্রংশ হয়ে বাংলায় আসা ক্রমবাচক শব্দ মাসের তারিখের চেয়ে খুব বেশি নেই। কারণ মাসের তারিখ বোঝানোর কাজেই তা ব্যবহৃত হয়। যেমন, পয়লা মার্চ, পনেরই মে, বা ত্রিশে ডিসেম্বর, এমনকি বত্রিশে বৈশাখ (বাংলাদেশে যেমনটি আগে ছিল, আদি বাংলা মাস ব্যবহার করে এমন জায়গায় এখনও আছে)। তৎসম ক্রমবাচক শব্দের ব্যবহার করে 'প্রথম পরীক্ষা' এবং তদ্ভব শব্দের ব্যবহার করে বাইশে জুলাই বেশ বলা যায়। তবে কোন বইয়ের বিশেষ পাতাকে
একশ' পচিশে, তদ্ভব নিয়মে, বা পঞ্চবিংশত্যাধিকতম, তৎসম নিয়মে, বলা কোনভাবেই যায় না। ইংরেজিত এই বিশেষপাতাটির নাম page 225। দশক গণনার সময় বলা হয় একের বা ছয়ের দশক। শব্দ সঙ্ঘটনও খুবই সহজ। বাংলা সঙ্খ্যা, শেষে বাংলা সম্বন্ধপদ বিভক্তি, -এর। আমরা অনেকেই বলি একশ' পচিশ নম্বর পাতা। তা না বলে একশ' পচিশের পাতা বললেই ভাল শোনায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে যা গোনা হচ্ছে সে শব্দের আগে সঙ্খ্যা এবং পরে -এর বসালে শ্রুতিকটু হয় না, যেমন, পাঁচদিনের দিন।

Tuesday, June 26, 2007

সব হরফের বাক্য

খানিকটা আড়ষ্ট বাক্যকে (গেল পোস্টিং দ্রষ্টব্য) সোজা করে অনুজ বন্ধু লিখে পাঠাল --- 'আকবর ঊষাকালে বৃহত্‍ ঐরাবতে দিল্লীর অর্ধেক প্রদক্ষিণ করতঃ হঠাত্‍ স্বগোতক্তি করিলেন এই ঢোল‌ পাখোয়াজ সঙ্গীত আর সৌরভ মন্দ্রিত আড়ম্বরপূর্ন রঙিন জীবনের ছত্রতলে যে বিষণ্ণ দারিদ্র তাহা কি মোগল সাম্রাজ্যের ঈষত্‍ ঔদাসীন্য, প্রচলিত বৈদেশিক নীতি নাকি বারভুঁইঞার সহিত পুরাণো এবং আত্মঘাতী যুদ্ধের ফসল?' সাধু রীতির বাংলা, সব হরফ নেই। পরের দিন খানিকটা পরিবর্তন --- 'আকবর ঊষাকালে বৃহত্‍ ঐরাবতে দিল্লীর অর্ধেক প্রদক্ষিণ করতঃ হঠাত্‍ স্বগোতক্তি করিলেন এই ঢোল‌ পাখোয়াজ সঙ্গীত আর সৌরভ মন্দ্রিত আড়ম্বরপূর্ন রঙিন জীবনের ছত্রতলে যে বিষণ্ণ দারিদ্র তাহা কি মোগল সাম্রাজ্যের ঈষত্‍ ঔদাসীন্য, প্রচলিত বৈদেশিক নীতি নাকি বারভুঁইঞার সহিত পুরাণো এবং আত্মঘাতী যুদ্ধের ফসল?'

চলতি বাংলায় লিখতে গিয়ে খানিকটা আড়ষ্টতা আর এড়ানোই যায় না। --- 'আষাঢ়ের এক সকালে ঈষান কোণে মেঘের আড়ম্বর এবং সবুজে ঋদ্ধ এই বনভূমির নির্জনতা চিরে ঐরাবতের ডাকে মনে হল ঔদাসীন্যে ঝরে পড়া মাটির উপর শুকনো পাতার ফাঁকে জমে থাকা ঢের পুরনো যত গভীর দুঃখ হঠাৎ বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে অন্ধকার, ঊষর ও নঞর্থক জীবনে রঙধনু এনে দেবে।' সব হরফই আছে। হয়ত আর কয়েকবার এদিক ওদিক করলে একটু ভাল হতে পারে। খুব একটা না। কারণ বাংলায় শুদ্ধ ঞ দিয়ে গুটি কতক শব্দ আছে --- ভুইঞা বা ভুঞা, মিঞা, ডেঞে আর নঞর্থক। বাকি আরও শ' খানেক শব্দ পাওয়া যাবে যার ব্যবহার প্রচলিত বর্তমান বাংলায় নেই। সেগুলো মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সম্পদ।

Sunday, June 17, 2007

সব হরফসমেত বাংলা বাক্য

ইংরেজিতে সব হরফসমেত এক বাক্যের সঙ্খ্যা অনেক, এবং সব চেয়ে প্রচলিত বাক্যটি হল A quick brown fox jumps over the lazy dog । বাংলায়ও এমন একটি বাক্য আছে, খুব প্রচলিত নয়। 'বিষণ্ণ ঔদাসীন্যে ঊষাবৌদি বাংলাভাষায় প্রচলিত নিখুঁত গল্পটি অর্ধেক বলতেই ঋতু ভুঁইঞা আর ঐন্দ্রিলা হৈ-হৈ করে উঠল --- ওঃ, থামো বুঝেছি বড্‌ডো পুরাণো ঢঙের গল্প --- মূঢ় আড়ম্বর ও আত্মশ্লাঘার ফল জীবনে বিঘ্ন ও বৃহৎ ক্ষতি --- এ নীতি যার না?' বাক্যটিতে বাংলা বর্ণমালার প্রায় সব হরফই আছে, যদিও রচনাটা একটু আড়ষ্ট। বাক্যটি পাওয়া যাবে মনোজকুমার মিত্রের লেখা প্রবন্ধ "বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা"-য়। লেখাটি ছাপা হয়েছিল কলকাতা থেকে ১৯৯৩ সালে বের হওয়া পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বই 'প্রসঙ্গ বাংলাভাষা'-য়। রোমান হরফে লেখা হয় এমন ভাষায়, বিশেষত ইংরেজিতে, হরফযোজনা বা বর্ণবিন্যাসের উদাহরণে একটি লাতিন বাক্যের ব্যবহার করা হয় --- Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur. Excepteur sint occaecat cupidatat non proident, sunt in culpa qui officia deserunt mollit anim id est laborum। প্রায় পনেরশ' খ্রিস্টাব্দ থেকে ছাপার উদাহরণে ইউরোপে এই বাক্যের ব্যবহার করা হতে থাকে। এতে করে বাক্যের বিষয়ের চেয়ে হরফের চেহারার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়, কারণ ভাষাটা লাতিন। এই বিবেচনায় বাংলায় এমন একটি বাক্য বা অনুচ্ছেদের ব্যবহার করতে হলে তা সংস্কৃত, প্রাকৃত অথবা পালি থেকে নেওয়া উচিত। কয়েকদিন আগে অনুজ এক বন্ধুর প্রশ্ন ছিল, বাংলার হরফযোজনার উদাহরণ হিসেবে এমন কোনও বাক্য বা অনুচ্ছেদের ব্যবহার করা হয়, বা যায়, কি না? এখনও পর্যন্ত এমন কোনও কিছু চোখে পড়ে নি। বাংলা টাইপ ফাউন্ড্রির নমুনা বইয়ে দেখা যায় তারা বিভিন্ন লেখার অংশ হরফের চেহারা দেখাতে ব্যবহার করেছে।

Friday, June 15, 2007

সহসা জ্যৈষ্ঠে মধুমাস

লিচু এবং আম বাজারে আসতে না আসতেই, ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি লেখার শুরুটা ছিল মোটামুটি এরকম যে যদিও মধুমাস মানে চৈত্র মাস, আমরা মধুমাস বলতে জ্যৈষ্ঠকেই বুঝব। অনেকটা গায়ের জোরেই। দিন কয়েক পরেই ঢাকার বাকি বাংলা দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও মৌসুমী ফলের উপর লেখায় অবলীলায় পাওয়া যেতে থাকল, এবং এখনও যাচ্ছে, যে জ্যৈষ্ঠ মাসকেই নাকি বাংলায় মধুমাস বলা হয় কারণ এমাসে মধুরসে পরিপূর্ণ ফলের সমাহার দেখা যায়। প্রথম আলো কেবল একদিন দায়সারা গোছের সাফাইমত গেয়ে যা শুরু করে দিল তা দিন সাতেকের মধ্যেই বাংলা ভাষার হাজার বছরের সম্ভার বলে মনে হতে লাগল। অনেকটা পত্রিকাগুলোর 'শীঘ্র' অর্থে 'সহসা'র ব্যবহারের মত। ভাষার ব্যবহারে রক্ষণশীল এবং উদারপন্থীদের মধ্যে টানাটানির মাঝেই ভাষার পরিবর্তন। তবুও লেখকদের একটু দায়িত্ববোধ বোধ করি থাকা উচিত।

Thursday, June 14, 2007

প্রোশ্‌নো না প্রোস্‌নো

বাংলা ব্যাকরণে পড়ানো হয় শ-এর (শ-উচ্চারণের) সাথে ত, থ, ন, র এবং ল যুক্ত হলে তার উচ্চারণ সংস্কৃত স-এর (যা কিনা ইংরেজি -এর) মত হবে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, চালর্স ফারগুসন এবং আরও অনেকের অন্তত তাই মত। বেশিরভাগ বাংলা শব্দের ক্ষেত্রে তাই দেখা যায়। আর একারণেই বাংলায় সংস্কৃত স-এর উচ্চারণকে আলাদা ধ্বনিমূল হিসেবে না ধরে শ-উচ্চারণ ধ্বনিমূলের প্রকারভেদ হিসেবে ধরা হয়, যা কিনা তার পারিপার্শ্বিকতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যদিও একালের কয়েকজনের মতে সংস্কৃত স-উচ্চারণকে আলাদা ধ্বনিমূল হিসেবে ধরাই ভাল (বোধ করি তাই ভাল, বাংলায় বিদেশি ধ্বনিমূল হিসেবে হলেও)। অর্থাৎ বাংলা শব্দে স-উচ্চারণ এবং শ-উচ্চারণ একই, শ-এর মত, কেবল পরে ত, থ, ন, র এবং ল থাকলে তার উচ্চারণ স-এর মত হবে। যেমন, সকল, সকাল, শালিক, শীষ, আসল, আসর, বিশাল, কুশল, মাস, রাস, রাশ, কুশ, ইত্যাদি।

যুক্ত বর্ণের ক্ষেত্রে পাশাপাশি ধ্বনি থাকলেও তাই, যেমন, অস্ত, স্থিত, স্নান, শ্রী, শ্লীল (যদিও অনেকেই এখন এর নঞ‌্‌র্থক শব্দটিকে অ-শ্-লিল্ উচ্চারণ করে, যা তাদের মতে শ্লীল শোনালেও অনেকের মতে খানিকটা অশ্লীল)। নাস্তা (বিকল্প বানানে নাশতা) অনেক আগে রাস্তার মত করে না-স্-তা উচ্চারিত হলেও, অনেকেই না-শ্-তা উচ্চারণ করে (কার যেন লেখায় পড়েছিলাম এই উচ্চারণ উর্দু প্রভাবিত, বিশেষ করে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হবার পরের পূর্ব পাকিস্তানেই এটি বেশি ঘটত এবং এখনও বাংলাদেশে, হয়ত উর্দু অধ্যুষিত কলকাতাতেও, কিছুটা ঘটে)। বেশ পুরনো বাংলা সিনেমায় শোনা যায় প্রো-স্-নো, আবার এখন বেশির ভাগই শোনা যায় প্রো-শ্-নো। বাংলা ভাষার উচ্চারণ-ভিত্তিক নিরীক্ষা কখনই হয়নি, তবে হওয়া উচিত, অন্তত কয়েক দশক পর পর। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত উচ্চারণ অভিধানে দেওয়া আছে প্রো-স্-নো। ভারতের অভিধানে প্রো-শ্-নো এবং প্রো-স্-নো দু'ই।

Monday, June 11, 2007

বাংলা দুই ব, বর্গ্য এবং অন্তস্থ

বাংলার এক ব কালের স্রোতে হারিয়ে যায়, সাধারণ লেখায়, তবে ব্যাকরণের আলোচনায় নয়; কারণ দুই ব দেখতে একই রকম। সিদ্ধান্ত : হয় একটি ব লুপ্ত হয়েছে, অথবা দুই ব একীভূত হয়েছে। প্রথমটি সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঠিক, তবে দ্বিতীয়টি ব্যাকরণের লেখায় বা দেখায় ঠিক, কিন্তু ধারণায় ভুল, কারণ এখনও সন্ধিতে দুই ব-এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। একারণেই চলন্তিকা অন্তস্থ ব-আদি শব্দ তারকা চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করেছে। যে ব-টি লুপ্ত হয়েছে তার একটা ব্যবহার এখনও কারও কারও লেখায় দেখা যায়।

অনেকে পুরনো দিনের মত এখনও লেখে নবেম্বর (November) বা অব (of)। ইংরেজি v-এর বাংলা সগোত্র হল সেই হারিয়ে যাওয়া অন্তস্থ ব। আর এ কারণেই নবেম্বর। কিন্তু অব কেন? অফ না হয়ে। ইংরেজি of-এর মার্জিত উচ্চারণ হল প্রায় ov-এর মত, যা বাংলায় অব দিয়ে প্রকাশ করা ভাল। আর বাংলা ভ-এর ইংরেজি সগোত্র হল bh, v নয়। অনেকেই এখন ভাষা ইংরেজি বানানে লেখেন vasha; পরিশীলিত মনের মার্জিত বানান bhasha-ই বোধ করি ভাল হবে।

Tuesday, April 17, 2007

পয়লা জানুআরি না এক জানুআরি

চলতি বাংলায় রেডিও এবং টেলিভিশনে এবং গুরুগম্ভীর ভাষায় বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, কেবল বাংলাদেশে, বেশ কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে --- ১ (এক) জানুআরি এবং ১৩ (তের) ডিসেম্বর ইত্যাদি, পহেলা জানুআরি বা তেরই ডিসেম্বরের বদলে। ব্যাপারটা বাংলাবাচনসম্মত নয়, বিরক্তিকরও বটে। বোধ করি ইংরেজির, বিশেষ করে বিলেতি ইংরেজির, নিয়মে লেখা তারিখের সরাসরি বাংলাপঠন এইসব আপদবাচ্য শব্দসমাহার। মার্কিনি ইংরেজিতে লেখা হয় December 25 (ডিসেম্বর ২৫), বলা হয় December twenty-fifth (ডিসেম্বর টুয়েন্টি-ফিফ‌্থ), সংখ্যাটাকে ক্রমবাচক করে নিয়ে। আর বিলেতি ইংরেজিতে লেখা হয় 25 December আর বলা হয় the twenty-fifth of December (দি টুয়েন্টি-ফিফথ অব ডিসেম্বর) বা December the twenty-fifth (ডিসেম্বর দি টুয়েন্টি-ফিফথ)। যারা দুই মার্চ বা নয় এপ্রিল বলে তারা এরকম কেন বলে তাদের অনেকেরই তার জবাব জানা নেই।

বাংলা ভাষায় ক্রমবাচক বা ক্রমপর্যায়সূচক সঙ্খ্যা দু'ধরণের --- তৎসম এবং তদ্ভব। সরাসরি সংস্কৃত থেকে গৃহীত ক্রমবাচক শব্দের ব্যবহার প্রায় সব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলেও, তদ্ভব ক্রমবাচক শব্দের ব্যবহার তারিখের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, এবং এর দৌড় এক থেকে কেবল বত্রিশ পর্যন্ত, কারণ বাংলা মাসে কোনওদিনই বত্রিশের বেশি দিন ছিল না। এক থেকে হয় পহেলা বা পয়লা, শব্দটিকে বাংলায় হিন্দি থেকে নব্য আমদানি ভাবার কোনও কারণ নেই, কারণ চর্যাপদের অন্তত দুই জায়গায় শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়; এরপর -রা, দোসরা এবং তেসরা; -ঠা, চৌঠা; -উই, পাঁচুই, ছউই, এভাবে আঠারই; এবং ঊনিশ থেকে বত্রিশ পর্যন্ত -শে, ঊনিশে, বিশে ইত্যাদি। এটিই বাংলার নিয়ম।

তদ্ভব ক্রমবাচক সংখ্যার বদলে তৎসম শব্দও ব্যবহার করা যায়, যেমন প্রথম জানুআরি, দ্বিতীয় ফেব্রুআরি ইত্যাদি, পরের দিকে হবে দ্বাবিংশতিতম (বাইশে) মার্চ। কানের এবং চোখের বারো টা, শুনতে এবং পড়তে ও বানান করতে। আরেকটা সোজা রাস্তা আছে, মার্চের তিন তারিখ, বা মে'র পনের তারিখ লেখা এবং বলা।

Wednesday, April 11, 2007

নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জো

বাংলায় গঞ্জ, হাট বা কোনও জায়গার নামের শেষাংশ হিসেবে, বেশ অনেকদিন ধরেই টেলিভিশন এবং রেডিও চ্যানেলগুলোতে অ-কারান্ত উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে। যদিও দুই বাংলা থেকে প্রকাশিত অভিধানে উচ্চারণটি তাই দেখানো হয়েছে, খটকা থেকেই যায়, এটি প্রচলিত না আরোপিত উচ্চারণ। কারণ অ-কারান্ত উচ্চারণ হলে শব্দের শেষে -য় বা -তে বসবে, -এ নয়, হবার কথা গঞ্জয় বা গঞ্জতে, গঞ্জে নয়; হবার কথা গঞ্জর, গঞ্জের নয়, যেমন পশ্চিম বঙ্গের বাংলায়, নাম হিসাবে, অমিতাভর, অথচ বাংলাদেশে অমিতাভের। কিন্তু এই চ্যানেলগুলোই আবার গঞ্জে (যেমন নারায়ণগঞ্জে) বা গঞ্জের ব্যবহার করে, নারায়ণগঞ্জতে, নারায়ণগঞ্জয় বা নারায়ণগঞ্জর নয়। বাংলাদেশে এবং ভারতে বিভিন্ন নামের ইংরেজি বানানে পাওয়া যায় -ganj অথবা -gunge। বোঝা যায় সে সময় অন্তত অ-কারান্ত উচ্চারণ প্রচলিত ছিল না। বাঙ্গালা ভাষার অভিধানের উচ্চারণ দেখানোর রীতিতে মনে হয় শব্দটির উচ্চারণ অ-কারান্ত নয়।

Thursday, April 05, 2007

গর্দভ ও গর্ধব

অনন্যার প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণে গর্দভের উচ্চারণ দেওয়া আছে 'গর্‌দ্‌দোভ' (/gɔrd:obʱ/) খুব কম লোকই শব্দটি এভাবে উচ্চারণ করে। প্রায় একই বইয়ের পরবর্তী বাংলা একাডেমীর বর্ধিত সংস্করণে বলা আছে গর্‌দোভ > গর্‌ধোব ( /gɔrdobʱ/ > /gɔrdʱob/ )। সাহিত্য সংসদের বাংলা উচ্চারণ অভিধানে দেখতে পাই সচেষ্ট উচ্চারণ হিসেবে /gɔrdɔb(ɦ)/ যেখানে অন্ত্য অ লোপ পাবার কারণে শেষ ব্যঞ্জনের মহাপ্রাণতা লোপ পাচ্ছে; এবং দ্রুত উচ্চারণে /gɔrdɦob/। শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ রূপ গর্দভীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে মূল সংস্কৃতে বোধ করি এই সমস্যা ছিলই না, কারণ শব্দের অন্ত্য অ, गर्दभ। ইংরেজি ভাষার উচ্চারণ অভিধানে প্রচলিত উচ্চারণ আগে এবং কম কিংবা অপ্রচলিত উচ্চারণ পরে দেওয়া হয়। এরকম বাংলা অভিধানে ঠিক তার উল্টোটি দেখা যায়।

Sunday, April 01, 2007

একটি জোড়াহরফের নতুন রূপ

বাংলা লেখায় ষ + ্ + ণ যে যুক্ত রূপ (ষ্ণ, ছবির প্রথম রূপ) নেয় তাকে ষ + ্ + ঞ বলে ভুল করা স্বাভাবিক, বাচ্চাদের পক্ষে তো বটেই। তারই বোধ করি অত্যন্ত হালকা প্রতিফলন ঘটেছে বেশ কয়েকটি বাংলা ব্লগে। 'কৃষ্ণ' লেখা হয়েছে 'কৃষ্ঞ'। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি বেশ আগেই ঠিক করেছে যে এখন থেকে তাদের প্রকাশিত বইয়ে ষ-এর নিচে ণ, যা কি না হলফের নিচে বসলে ন-এর মত দেখায়, তা ব্যবহৃত হবে (ছবির দ্বিতীয় রূপ)। প্রশ্ন উঠতে পারে ন- এবং ণ-ফলা একই রকম দেখালে কি করে হবে? হক কথা। রুগ্ন শব্দে গ-এর নিচে কিন্তু ণ-ই, ন নয়। এর জন্য আলাদা কোনও ফলা চিহ্ন নেই। বাংলা আকাদেমির অনেক বইয়ে আবার ছোট ষ-এর নিচে-পাশে ণ দেখা যায় (ছবির তৃতীয় রূপ)। অনেক পুরনো অ-আ-ক-খ বইতে ছবির চতুর্থ রূপটিও দেখা যায়। এর আগে অনেকেই যুক্ত হরফের নতুন রূপের প্রস্তাব করে চালু করতে পারে নি। বাংলা আকাদেমি সমালোচনার মুখেও নতুন রূপের হরফ দিয়ে বই ছাপিয়ে যাচ্ছে। পুরো বাংলায় চালু হতে সময় লাগলেও, একে অগ্রাহ্য করার কোন কারণ বোধ করি আর থাকবে না?

Tuesday, March 27, 2007

যুক্তাক্ষর: ল-এ ফ

শহীদ কাদরীর কবিতায় আছে 'শেল্ফের ভেতরে বইগুলো...'। শব্দটিকে ভেঙ্গে শেল্‌ফও লেখা যেতে পারে, লেখা ও উচ্চারণের ব্যাকরণ ঠিক রেখেই। বিদেশি ভাষার কয়েকটি শব্দ বাংলা হরফে লেখার জন্য ল্ফ ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন, গল্ফ (ইংরেজি, খেলা বিশেষ), জুল্ফ (ফারসি, জুলফি বা চূর্ণ কুন্তল)। কিন্তু কেবল এই গুটি কয়েক শব্দের জন্য আরেকটি যুক্তাক্ষর রাখা চলে, নাকি ভেঙ্গে লেখাটাই ভাল?