বাংলায় বেশ কটি শব্দ আছে আপাতদৃষ্টিতে যাদের সংস্কৃত না বলে ভাববার কোনও কারণ নেই। যেমন, রাণী (আধুনিক বানানে রানি), কাহিনী (কাহিনি), ভিখারিণী (ভিখারিনি), রূপসী (রূপসি) ইত্যাদি। বানানের নতুন নিয়ম মানতে গিয়ে বেশির ভাগ লোকই হিমশিম খেয়েছে এই সব শব্দ থেকে ঈ-কার পাল্টে ই-কার করতে গিয়ে; আর প্রায় সবাই একবার না একবার চিন্তা করেছে ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে কি না তা নিয়ে, যদিও এখন অনেকেই, বিশেষকরে পশ্চিম বঙ্গে, অবলীলায় ই-কার ব্যবহার করে। এবং সেটিই হওয়া উচিত। রানি শব্দটি ব্যুৎপন্ন হয়েছে রাজ্ঞী থেকে: রাজ্ঞী বা রাজনী> রণ্ণী > রানী > রানি। সংস্কৃত ব্যকরণের নিয়ম অনুযায়ী র-এর পরে মূর্ধন্য ণ ব্যবহারের নিয়ম, তাছাড়া অপভ্রংশে যেহেতু ণ তাই ব্যুৎপত্তির বিচারে মূর্ধন্য ণ-ই স্বাভাবিক। তবে বাংলা বানানের নিয়মে বলা আছে যে ণত্ব-বিধান কেবল তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে খাটে। এই ণ অনেক আগেই দন্ত্য ন-এ পরিণত হয়েছে। বেশ কিছু কাল ধরে অনেকে ঈ-কার পাল্টে ই-কারে এসেছে। বাংলা বানানের নিয়মেই: তৎসম শব্দে দীর্ঘ স্বর থাকলে তদ্ভব শব্দে দীর্ঘ এবং হ্রস্ব দুয়ের বিধান, তবে হ্রস্ব স্বর হলে বানানটা আধুনিক হয়। তাছাড়া নিয়মে বলা আছে কেবল তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে স্বরের দীর্ঘত্ব বা হ্রস্বত্ব রক্ষিত হবে। একইভাবে অর্বাচীন সংস্কৃত কথানিকা থেকে আগত কাহিনি তার স্বরের দীর্ঘত্ব হারিয়েছে: কথানিকা > অপভ্রংশ কহানিয়া > বাংলা কাহিনি। সংস্কৃত রূপস্ থেকে পুরুষ বিশেষণ রূপবান, স্ত্রী বিশেষণ রূপীয়সী। রূপসি শব্দটি পুরোপুরি বাংলার অবদান, আধুনিক বানানটিও তাই রুপসি হওয়া উচিত। প্রথমে -সী থেকে -সি হয়েছে। রূ- অনেকের জন্য রু- এখনও হয় নি, কারণটা সম্ভবত রূপসী রুপসি হলে তার সাথে রূপের সম্পর্কটি আর থাকে না। তবে সেটিও হয়ত হয় যাবে। নয়ত সংস্কৃত রূপ + বাংলা -সি ধরে নিতে হবে। সংস্কৃত ভিক্ষার্থী থেকে ভিখারী (সংস্কৃতের ক্ষ তদ্ভবে প্রায়ই খ এবং মূলের দীর্ঘস্বর পুরনো বানানে দীর্ঘই থেকে গেছে)। আধুনিক বানানটি ভিখারি হলেই ভাল। সে থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে স্ত্রীলিঙ্গে ভিখারিণী। আধুনিক বানানটি ভিখারিনি।
বাংলায় সংস্কৃতরূপী আরবি শব্দের মধ্যে নামকরা হল মফস্বল (বর্ণান্তরে মফঃস্বল বা মপস্বল) এবং মোক্ষম। প্রথমটির ক্ষেত্রে শব্দটি আরবি (مفصل, মফস্সল), তবে অর্থটি একান্তই ভারতবর্ষীয়। আর দ্বিতীয়টি পুরোপুরি আরবি (محكم, মহ্কম), বানানটি কেবল সংস্কৃত। পুরনো দিনে (পুথিতেও হামেশা দেখা যায়) হরফ দ্বিত্বে ব-ফলা বা বিসর্গের ব্যবহার, শব্দটি সেকারণেই মফস্বল। তবে আধুনিক কালে লেখা হয় মফস্সল। আরবিতে শব্দটির অর্থ স্পষ্ট, পরিপূর্ণ, বিশদ, ইত্যাদি। জন টমসন প্ল্যাট্স-এর ১৮৮৪-সালে ছাপানো উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি ও ইংরেজি অভিধান মতে একটি সদর এলাকা ছাড়া জেলার আর সব এলাকাকে বোঝায়; শহর ছেড়ে প্রামাঞ্চল, ইত্যাদি। অন্য অর্থের ব্যবহারও অভিধানটিতে আছে: মুফস্সল কহনা বা মুফস্সল বয়ান করনা, অর্থ বিশদভাবে বলা বা বর্ণনা করা। ১৮৩৪ সালে ছাপানো জন শেক্সস্পিয়ারের হিন্দুস্তানি এবং ইংরেজি অভিধানের মতে গ্রামাঞ্চল অর্থটি ভারতবর্ষের অবদান (peculiar to India)। শব্দটি আধুনিক হিন্দিতে আছে (मुफस्सल), উর্দুতেও (مفصل)। ১৯০৩ সালের হবসন-জবসনে শব্দটি আছে, mofussil বানানে। সংসদেও তাই। Chamber's Twentieth Century Dictionary-তেও একই বানানে। হবসন-জবসনের অর্থ 'জেলার সদর বা প্রধান এলাকা বাদ দিয়ে গ্রামাঞ্চল' সব জায়গাতেই বিদ্যমান। মফস্সল বানানটির পরিবর্তন ঘটলেও, মোক্ষম এতটাই বাংলা (নাকি সংস্কৃত)যে এটার পরিবর্তন বোধ করি সম্ভব নয়।
1 comment:
বাংলা হলে বুঝি ঈ-কার, ঊ-কার দেওয়া যাবে না? বিশ্রী !
Post a Comment