Tuesday, November 09, 2010

উত্তুরে বাতাস আর সূর্য: সিলেটের উপভাষা

সিলেটের উপভাষা এখন পৃথক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত স্বে মহিম্নি — নিজের মহিমায়, অন্তত এথনোলগের মতে, বেশ কিছুদিন ধরেই। এই সিলেটির সাথে বাংলার আভিধানিক সাদৃশ্য প্রায় সত্তর শতাংশ। একই রকম মর্যাদা চট্টগ্রামের উপভাষারও; তবে এ ক্ষেত্রে বাংলার সাথে আভিধানিক সাদৃশ্য তেতাল্লিশ থেকে চৌষট্টি শতাংশের মধ্যে। জায়গা বদলালেই ভাষা হঠাৎ করে পালটায় না; অনেক জায়গা জুড়ে একটু একটু করে পালটায়; আর তাই এই তেতাল্লিশ থেকে চৌষট্টি শতাংশ। এর একটা অর্থ সিলেটি বাংলা বেশ খানিকটা কাছের, অন্তত চট্টগ্রামের উপভাষা সাপেক্ষে।

সিলেটির একটি ধ্বনিমূলের সহধ্বনি বাংলার আর কোনও উপভাষায় চোখে পড়ে না — /q/, আরবির ق। মান্য বাংলায় যা /k/, সিলেটিতে তা হয় /q/ বা /x/। সাধারণত পূর্ণ-বিবৃত স্বরধ্বনির আগে মান্য /x/; অন্যত্র /q/। /e/-স্বরধ্বনি অনেকটা বিবৃত হয়ে /ɛ/; মহাপ্রাণতা প্রায় লুপ্ত; /r/ এবং /ɽ/-এ পার্থক্য নেই; মান্য বাংলার উত্তরদন্তমূলীয় ঘৃষ্ট // এবং // ধ্বনি হয় উষ্ম /s/ এবং /z/ নয়ত অনেকটা সামনে এগিয়ে দন্তমূলীয় ঘৃষ্ট ধ্বনি /ts/ কিংবা /dz/। মান্য বাংলার /ɦ/ কখনও /ɦ/ এবং কখনও /ʔ/.

উতরর বাতাস আর সুরুজ ঝগড়া করের, তারার মাঝে কে বেশি শক্তিমান, অখটা নিয়া। অউ সময় এখ পথিক গরম পুষাক গাত দিয়া অউ পথ দিয়া জার । বাতাস আর সুরুজ দুইজনেউ রাজি অইল তারার মাজ থাকি যে পথিকরে তার পুশাক খুলাইতে বাইদ্য করাইত পারব, হেউ অইব বেশি শক্তিমান। এরপর উতরর বাতাস তার বিশন জোরে বইতে শুরু করল। বাতাসর জোর যত বাড়তে লাগল পথিকও তত শক্তি করি পুশাক শরিরর লগে জড়াইতে থাকের। হেশকালো বাতাস আল ছাড়তে বাইদ্য অইল । ইবার সুরুজ পরবল তেজ ছড়াইতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে পথিকও তার জামা খুলি ফালাইল। আর উতরর বাতাস মানিয়া নিল যে সুরুজ বেশি শক্তিমান।

/ut̪rɔr bɑt̪ɑʃ ɑr suruz zɔɡrɑ xɔrɛr, t̪ɑrɑr mɑze qɛ bɛʃi ʃoqt̪imɑn, ɔxtɑ niɑ. ou ʃɔmɔĕ æx ɸot̪iq ɡɔrɔm puʃɑq ɡɑt d̪iɑ ou pɔt d̪iɑ zɑr. bɑt̪ɑʃ ɑr suruz d̪uizonɛu rɑzi ʔoilo t̪ɑrɑr mɑz t̪ɑqi zɛ ɸot̪iqrɛ t̪ɑr puʃɑq xulɑit̪ɛ bɑid̪ːo xɔrɑit̪ɛ ɸarbo, ɛu ʔoibo bɛʃi ʃoqt̪imɑn. ɛrɸɔr ut̪rɔr bɑt̪ɑʃ t̪ɑr biʃɔn zorɛ boit̪ɛ ʃuru xorlo. bɑt̪ɑʃɔr zor zɔt̪o bɑrt̪ɛ lɑɡlo ɸot̪iqo t̪ɔt̪o ʃɔqt̪i xori puʃɑq ʃoriror lɔɡɛ zorɑit̪ɛ t̪ɑxɛr. ɦɛʃxɑlo bɑt̪ɑʃ ʔɑl sɑrt̪ɛ bɑid̪ːo ʔoilo. ibɑr suruj ɸɔrbol t̪ɛz sɔrɑit̪ɛ ʃuru xɔlro. ʃɔŋɡɛ ʃɔŋɡɛ ɸot̪iqo t̪ɑr zɑmɑ xuli ɸɑlɑilo. ɑr ut̪ror bɑt̪ɑʃ maniɑ nilo zɛ suruz bɛʃi ʃoqt̪imɑn/

আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালায় সিলেটের উপভাষার উচ্চারণের উদাহরণ দিতে গিয়ে ঈশপের এই গল্পটিতে কোনও রকম স্বরাঘাত চিহ্নের ব্যবহার করা হয় নি।

Monday, November 08, 2010

মর্দামির রকমফের

রাস্তাঘাটে যানবাহনে একটু ভীড়ে বা ধীরে চলার সময় বাহনের জানালা গলে টুক করে কোলে পড়ে ছোট ছাপানো কাগজ, কখনও বা দুই বা তিন ভাঁজের। তেমন কিছুই নয়। বিভিন্ন কবিরাজি ঔষধের, বিশেষত যৌন রোগ নিরাময়ের, বিজ্ঞাপন। তবে ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা করার মত। তারই মাঝে একটি শব্দ মর্দামি (বিজ্ঞাপনের কাগজগুলোয় কিন্তু মর্দামী লেখা হয়)। মান্য বাংলায় শব্দটি খুব একটা নজরে পড়ে না। তারপরও সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর রায় নন্দিনীতে পাওয়া যায়: ‘আমি ত একটু তীর ও তরবারি চালনার অভ্যাস ক'রেছি। কিন্তু বাবা ব্যতীত আর সকলেই তার জন্য আমাকে ঠাট্রা বিদ্রূপ করে-বলে যে, “মর্দামী শিখছে।”’ (২য় পরিচ্ছেদ)।

ফারসি মর্দমী (مرد থেকে مردمي); অর্থ, পৌরূষ, বীর্যবত্তা, সাহস, ইত্যাদি। হিন্দিতে मर्दानगी, অর্থ সাহস, শৌর্যবীর্য, পুরুষত্ব ইত্যাদি।বাংলায় অভিধানে শব্দটিকে মর্দানি (মর্দ্দানী, মরদানি, মরদানী, মর্দাঙ্গি, মদ্দানি ইত্যাদি) রূপেও পাওয়া যায়। কিন্তু উদাহরণের প্রথমটিতে শব্দটির অর্থ পুরুষত্ব, বিশেষত যৌনক্রিয়া বা সন্তানোৎপাদন কর্ম সংক্রান্ত বাহাদুরি; আবার দ্বিতীয়টিতে বাহাদুরি অর্থে নেওয়া যায়, তবে বীরত্ব বা মেয়েদের ক্ষেত্রে পুরুষালি ভাব অর্থে নেওয়াটা ভাল।

Tuesday, February 02, 2010

বৈঠকের সভ্য

বাংলায় প্রয়োগসিদ্ধ কিন্তু (সংস্কৃত) ব্যাকরণানুগ নয় এমন অনেক তৎসম (?) শব্দ প্রচলিত। সন্দেহটা এ কারণে যে সংস্কৃতের লেবাস, কিন্তু সংস্কৃতে ব্যবহার নেই এমন শব্দকে কি তৎসম (তার, অর্থাৎ সংস্কৃতের, সমান) বলা যাবে? সাংসদ এমনই একটি শব্দ। মনিয়ের-মনিয়ের উইলিয়ামস্‌-এ সাংসদ বলে কোনও শব্দ নেই। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে সংসদ শব্দের ভুক্তিতে সাংসদ, সংসদ বা পরিষদ সদস্য হিসেবে, আছে বটে, কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রমোহন, হরিচরণ, রাজশেখর, ওদুদ কোনওটাতেই শব্দটি নেই। প্রায় সব অভিধানেই সংসদ (আদতে সংসৎ বা সংসদ্‌, সম্‌ — √সদ্‌ + ক্বিপ্‌) অর্থ সভা, পরিষৎ, সমিতি, গোষ্ঠী, সমাজ, এবং পরিভাষা হিসেবে ইংরেজির parliament; কেবল হরিচরণেই দ্বিতীয় অর্থ সামাজিকবর্গ। মনিয়ের-মনিয়ের উইলিয়ামস্‌-এ সংসদ (संसद्) অর্থ sitting together, একসাথে বসা অর্থাৎ সভা, সমিতি, আসর ইত্যাদি। আবার সেই একই শব্দের অর্থ one who sits together, যারা এক সাথে বসে, অর্থাৎ একই সভায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি। তবে শব্দাভিধানে না থাকলেও সাংসদ শব্দটি কিন্তু বাংলা একাডেমি, সাহিত্য সংসদ এবং বাংলা আকাদেমির বানান অভিধানে আছে, সংসদ-সদস্য অর্থে। আকাদেমির বানান অভিধানে আবার সামনে বিন্দু দিয়ে সংস্কৃত হিসেবে চিহ্নিত শব্দটি।

সাংসদ শব্দটি বাংলায়, দুই বঙ্গেই, যথেষ্ট প্রচলিত শব্দ। হিন্দিতেও তাই; এবং সংসদ-সদস্য অর্থেই। কিন্তু শ্যামসুন্দরের হিন্দী শব্দসাগরে সাংসদ নেই। সংসদ অর্থ দেওয়া আছে একসাথে বসে এমন কেউ (साथ साथ बैठनेवाला, সাথ সাথ বৈঠনেৱালা) এবং পার্লামেন্ট (पार्लामेंट)। মহেন্দ্র চতুর্বেদীর ইংরেজিতে লেখা ব্যবহারিক হিন্দি-ইংরেজি অভিধানে সাংসদের দেখা মেলে, সংসদীয় বা parliamentary অর্থে; দেখা মেলে সাংসদিক (सांसदिक) বলে একটি শব্দের; এটিও বিশেষণ, যেমন সাংসদিক চুনাৱ (सांसदिक चुनाव) অর্থাৎ সংসদ নির্বাচন।

সংসদ-সদস্য বললে খানিকটা পুনরুক্তির দোষ হয় কি? সংসদ অর্থ যারা এক সাথে বসে। আবার সদস্‌ অর্থ আসন, বাস, বাসস্থান, আবাসন, সভা, সাথে য (সদস্‌ + য), অর্থ সভ্য।

Monday, January 25, 2010

অনু পূর্বক স্থা ধাতু যোগ তব্য

গুগলে খোঁজ করলেই অনুষ্ঠিতব্য শব্দটির হাজার তিরিশেকের বেশি উদাহরণ পাওয়া যাবে। খেয়াল করলে পত্রিকায় এবং বইয়ের পাতায়ও চোখে পড়বে। কিন্তু এর দেখা মিলবে না কোনও অভিধানে। কোনও অভিধানই একে শব্দ বলে মানে না। কারণও আছে। অনুষ্ঠিত নিজেই অনু-স্থা + ত (ক্ত) হিসেবে সাধিত ক্রিয়া বিশেষণ; অর্থ আচরিত, সম্পাদিত, নিষ্পাদিত, কৃত, সঙ্ঘটিত, আরব্ধ, আয়োজিত, নির্বাহিত ইত্যাদি। -তব্য সংস্কৃত কৃৎপ্রত্যয়, ঔচিত্য বা আবশ্যকতা বোঝানোর জন্য, ব্যবহৃত হয় সাধারণত তৎসম ধাতুর সঙ্গে যেমন, — √ জ্ঞা + তব্য = জ্ঞাতব্য বা √ গ্রহ্‌ + তব্য = গ্রহীতব্য। বাংলা দুয়েকটা ধাতুর সঙ্গেও -তব্য বসে পড়তে পারে, যেমন √ কহ্‌ + তব্য = কহতব্য। অনুষ্ঠিত ক্রিয়া বিশেষণটির তাই -তব্য প্রত্যয়ের ভারটা সয় না। তা ছাড়া যে কর্ম ইতিমধ্যে সম্পাদিত তার সম্পাদন হওয়ার ভবিষ্যত কোনও ঔচিত্য বা আবশ্যকতার প্রয়োজন না থাকাই ভাল।

তারপরও যদি এরকম একটি ভাবের প্রয়োজন পড়ে তৎসম শব্দেই তার সমাধান আছে — অনুষ্ঠাতব্য কিংবা অনুষ্ঠেয়; গুগল খোঁজে প্রথমটি পাওয়া যায় গুটিকয়েক বার আর পরেরটির চল্লিশ হাজারের বেশি। অনুষ্ঠাতব্য শব্দটি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ আর মিলন দত্ত আর অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শব্দ সঞ্চয়িতা বাংলা অভিধানেই মিলবে; অর্থ অনুষ্ঠেয়, আচরণীয়, কার্য, অনুষ্ঠানের যোগ্য বা করণীয়; মনিয়ে-মনিয়ের উইলিয়ামসে তো অবশ্যই — अनुष्ठातव्य, অর্থ to be accomplished; ১৮২৭-এ ছাপা কেরির বাংলা অভিধানেও আছে অনুষ্ঠাতব্য। অনুষ্ঠেয় শব্দটি দুই বাংলার পরিচিত সব অভিধানেই আছে, অর্থ অনুষ্ঠানযোগ্য, যার অনুষ্ঠান করতে হবে, সম্পাদ্য, আচরণীয়, সাধ্য, কার্য, করণীয়, অনুষ্ঠানযোগ্য, কর্তব্য, সম্পাদন-যোগ্য ইত্যাদি; আছে সংস্কৃতেও, अनुष्ठेय, অর্থ to be effected, done or accomplished

Saturday, January 02, 2010

প্রতিবর্ণন এবং লিপ্যন্তর

ইংরেজিতে Romanisation বলতে বোঝায় (যা সাধারণত রোমক হরফে লেখা হয় না তেমন কিছু) রোমক হরফে লেখা; এই রোমক হরফে লেখাটাকে বাংলায় হয়ত রোমকায়ন বলা যেতে পারে। আবার সে ব্যাপারটাও দু’রকমের। ইংরেজিতে এদের বলা হয় transcription এবং transliteration। ইংরেজি শব্দ দু’টির জন্য বাংলায় দেখা মেলে বেশ কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছের: প্রতিবর্ণীকরণ, লিপ্যন্তরীকরণ, অক্ষরান্তরীকরণ, প্রতিবর্ণিত করণ, বর্ণান্তরিত করণ, লিপ্যন্তরিত করণ, অক্ষরান্তরিত করণ, ইত্যাদি। যদিও transcription-এর জন্য নকল করা অর্থে প্রতিলিপিকরণ এবং অনুলিখন দুটোই চলে। ইংরেজিতে দুটো শব্দের দু’রকম মানে থাকলে বাংলা শব্দগুলোর যে কোনও একটি ইংরেজি শব্দ দুটির জন্য নির্বিচারে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রে, অন্তত পরিভাষা হিসেবে, ইংরেজি শব্দ দু’টির আলাদা দু’টি বাংলা থাকা উচিত, না হলে বিষয় বোঝানোর ক্ষেত্রে ঝামেলা হবে।

ক্রিয়াজাত বিশেষ্য হিসেবে বোধ করি transliteration-এর জন্য প্রতিবর্ণীকরণ এবং transcription-এর জন্য লিপ্যন্তরীকরণ ব্যবহার করা উচিত। কারণ transliteration-এ একটি ভাষার শব্দ সে ভাষার বানান অনুযায়ী অন্য একটি ভাষার মান্য হরফ বা পরিবর্ধিত হরফে লেখা হয়, মূল এবং দ্বিতীয় ভাষার উচ্চারণের দিকে লক্ষ্য না রেখে। আর সে কারণেই কেবল বর্ণান্তর (বর্ণের অন্তর) ঘটে বলে তাকে প্রতিবর্ণীকরণ, বা প্রতিবর্ণনও, বলা যেতে পারে। প্রতিবর্ণীকরণে বানান অর্থাৎ বর্ণন মেনে চলা হয়; তাছাড়া এই পরিবর্তনে এক ভাষার হরফের সাথে অন্য ভাষার হরফের এক ধরণের প্রতিসাম্য থাকে। এবং সে কারণে প্রতিবর্ণিত শব্দ থেকে মূল শব্দে আবার ফিরে যাওয়া যায়। আর transcription-এ প্রচেষ্টা থাকে একটি ভাষার শব্দকে আরেকটি ভাষার উচ্চারণনীতি মেনে দ্বিতীয় ভাষার হরফ ব্যবহার করে মূল ভাষার উচ্চারণের যতটা কাছাকাছি যাওয়া যেতে পারে তার। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মুল ভাষার উচ্চারণকে দ্বিতীয় ভাষার উচ্চারণের কাছাকাছি নিয়ে সে ভাষার হরফে লিখে যাওয়া। এ ধরণের সঙ্ঘটনকে লিপ্যন্তরীকরণ, বা অক্ষরান্তর, বলা যেতে পারে। এখানে থাকে প্রতিসাম্যের অভাব এবং পুরো ব্যাপারটা উচ্চারণ-সংবেদী বলে হরফের চিন্তা না করে বরং অক্ষরের (syllable) চিন্তা করা হয়। লিপির একটি অর্থ একটি অর্থ অক্ষর বা লিখন, অর্থাৎ অক্ষরবিন্যাস, আর তাই দ্বিতীয় ভাষার উচ্চারণনীতি এবং অক্ষরবিন্যাসের প্রাধান্যের কারণে একে লিপ্যন্তর বলাই ভাল।

গুরুগম্ভীর কাজের জন্য যেমন গবেষণায় সাধারণত প্রতিবর্ণীকরণ, যেমন নিঃশব্দ থেকে niḥśabda। সাধারণ কাজের জন্য লিপ্যন্তরীকরণ, যেমন নিঃশব্দ থেকে ইংরেজি-ভাষীদের জন্য nishshobdo, nishshabdo, nishshawbdo বা nishshaubdo, ফরাসি-ভাষীদের জন্য nichchaubdo কিংবা জর্মন-ভাষীদের জন্য nicshobdo, তেমনি আরও অনেক। যারা শব্দটির উচ্চারণ মূল ভাষায় ভুল করে তাদের করা লিপ্যন্তর আরেকটু অন্য রকমের হবে। প্রতিবর্ণীকরণের যেমন আছে ঋজুতা, লিপ্যন্তরীকরণে তেমনি লঘুতা। একটিতে নিয়মের বাড়বাড়ি, বানানের দার্ঢ্য। অন্যটিতে নিয়মের বালাই নেই, উচ্চারণের প্রাণান্তকর চেষ্টা। সংস্কৃত শব্দ নিঃশব্দের দেবনাগরীতে প্রতিবর্ণন হবে निःशब्द, সেই একই বানান, তৎসম। দেবনাগরীতে হিন্দি-ভাষীদের জন্য হবে निश‌्शौब्दो (নিশ্‌শৌব্দো); মরাঠি বা নেপালিতে অন্য কিছু।

Saturday, August 08, 2009

বাংলার বাড়তি ধ্বনিমূল

বাংলার ভূখণ্ডে অনেক দিন ধরে ফারসি আর ইংরেজি রাজভাষা থাকবার কারণে বাংলায় বিদেশি ধ্বনিমূলের দেখা মেলে। মান্য বাংলার ধ্বনিভাণ্ডারের বাইরে এই রকম পাঁচটি ধ্বনিমূল আছে – অঘোষ দ্বি-ঔষ্ঠ্য উষ্ম ধ্বনি /f/, ঘোষ দ্বি-ঔষ্ঠ্য উষ্ম ধ্বনি /v/, অঘোষ দ্বি-ঔষ্ঠ্য নৈকট্যক /ɸ/, ঘোষ দ্বি-ঔষ্ঠ্য নৈকট্যক /β/, আর ঘোষ দন্তমূলীয় শিস ধ্বনি /z/। এবং প্রায়ই /f/ ও /ɸ/ গিয়ে ঠেকে //-এ, /v/ ও /β/ গিয়ে ঠেকে //-এ, এবং /z/ গিয়ে ঠেকে //-এ। /f/ ও /ɸ/ এবং /v/ ও /β/ প্রায়ই শোনা যায় ইংরেজি শিক্ষিত এবং বাংলায় সতর্ক উচ্চারণে অভ্যস্ত নয় এমন লোকের বুলিতে, কারণটা হল ইংরেজির /f/ ও /v/। আপিস /ɑpiʃ/ কথাটা বাংলায় শোনা যায় বটে, কিন্তু অফিস বলাই দস্তুর। কিন্তু উচ্চারণটা কি? সাহিত্য সংসদের উচ্চারণ অভিধান এবং কলিকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির অবাঙালিদের জন্য আধুনিক বাংলা অভিধান মতে /ɔpʰiʃ/, বাংলা একাডেমির উচ্চারণ অভিধানে /ɔfis/। অনেকের কাছে মাঝামাঝি /ɔpʰis/ গোছের কিছু একটা। দাঁড়ালটা কি? পশ্চিমবঙ্গের বাংলায় /ɔpʰiʃ/; আর পূর্ববঙ্গের বাংলায় /ɔfis/। অনেকে এই /f/-টা ঠিকমত উচ্চারণ করতে না পেরে উচ্চারণ করে /ɸ/। তেমনি অনেকের কাছেই ভুল /bʱul/ হয়ে যাচ্ছে /vul/ বা /βul/।

আরবি, ফারসি বা উর্দু থেকে আসা /z/-ধ্বনির শব্দগুলো বাংলায় সাধারণত // – জাহাজ (জহাজ়, جـﮩ‍از) /dʒɑɦɑdʒ/, মেজাজ (মিজ়াজ, مزاج) /medʒɑdʒ/, সাজা (সজ়া, سزا) /ʃɑdʒɑ/, কিংবা উজির (ব়জ়ীর, وزير) /udʒir/। অসাধারণত জ় /z/, কারণ নাটকে উজিরে আজম ( ব়জ়ীর-এ-‘আজ়ম, وزير اعظم)-কে /udʒireɑdʒom/ বললে কেমন যেন একটু ঠেকে, তাই /uzireʔɑzɔm/ শোনা যায়। অন্যান্য ভাষা থেকে আসা অল্প-প্রচলিত শব্দে, শিক্ষিতের বুলিতে /z/ প্রায়শই /z/, // নয়। তবে মান্য বাংলার // অনেক উপভাষায় /z/, পরশুরামের z‍ানতি-র মত।

শতাংশের হিসেবে বাংলায় অনেক কম ব্যবহৃত একটি ধ্বনিমূল হল /ʕ/। আস্‌সালামু ‘আলাইকুম (السلام عليكم, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) বাংলাদেশে এবং এ অঞ্চলের অনেক দেশে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত সম্ভাষণ বাক্য। অনেকেই সাধারণভাবে /asalaːmʊ alaɪkʊm/ বললেও, আরবির শুদ্ধ উচ্চারণ হল /ʔasːaˈlaːmʊ ʕaˈlaɪkʊm/। এবং আরবি এবং আরবি-পঠনে শিক্ষিত লোকের বুলিতে শুদ্ধ উচ্চারণটি শোনা যায়।

Wednesday, August 05, 2009

পত্রিকায় সাধু ভাষা-রীতি

পত্রিকায় এখন সাধু ভাষার দেখা মেলে কেবল সম্পাদকীয় নিবন্ধে। পশ্চিম বঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকায় আর বাংলাদেশে দৈনিক ইত্তেফাকে। আগে দু’টি পত্রিকাতেই সাধু ভাষায় সংবাদ ছাপা হত। আনন্দবাজার পত্রিকা খবরের পাতা থেকে সাধু ভাষা গুটিয়ে নিয়েছে ১৯৬৫ সালের ২২শে মার্চে। তার দেখাদেখি অন্যান্য পত্রিকাও সংবাদ পরিবেশনে সাধু ভাষার ইতি টানে। দৈনিক ইত্তেফাক সংবাদ পরিবেশনে সাধু ভাষা ছেড়ে চলতি ভাষার ব্যবহার শুরু করে ২০০১ সালের ১৪ই নভেম্বর। তার আগের দিন অর্থাৎ ১৩ই নভেম্বর ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ঘোষণা ছাপা হয়–
‘একটি ঘোষণা–
ভাষা-বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, তরুণ প্রজন্ম, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, পাঠক-পাঠিকা এবং শুভানুধ্যায়ীদের সুচিন্তিত মতামত অনুযায়ী আগামীকাল বুধবার থেকে দৈনিক ইত্তেফাকে সাধু ভাষা-রীতির বদলে চলতি ভাষা-রীতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের গত ৫০ বছরের ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে সম্পাদকীয় নিবন্ধ আগের মতই সাধু-রীতিতে প্রকাশিত হবে। – ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।’
ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় নিবন্ধের সাধু ভাষা কিন্তু কেবল সর্বনামে আর ক্রিয়াপদে; বিশেষণ, ক্রিয়া-বিশেষণ আর সমাসবদ্ধ পদের বড়ই অভাব। আর সংস্কৃতাগত তৎসম শব্দের চেয়ে আরবি-ফারসির তদ্ভব বা তৎসম শব্দের ব্যবহার বেশি।