বাংলা ভাষায় বর্মি শব্দ কুল্লে দুই — লুঙ্গি আর ফুঙ্গি। প্রথমটির দেখা মেলে ঘরের বের হলেই, বিশেষ করে বাংলাদেশে। দ্বিতীয়টি কেবল অভিধানে আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতায় (আরও গোটাকতেক জায়গায় পাওয়া সম্ভব, ইতিহাস, ভূগোল বা ভ্রমণ কাহিনির বইয়ে)।
লুঙ্গি শব্দটি বর্মিতে လိုဈည္, রোমক হরফে longyi, উচ্চারণ /lòuɲdʒì/। বাংলার উচ্চারণ থেকে একটু আলাদা, তবে স্বগোত্রীয বলে চেনা যায়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসে শব্দটি বর্মি, তবে অভিধানটিতে ব্যুৎপত্তির জায়গায় সাথে ফারসি লুঙ্গি শব্দটি দেওয়া আছে। হিন্দিতে लुंगी, আর উর্দুতে لنگى। শব্দটি ফারসিতেও পাওয়া যায়, لنگی হিসেবেই। Chamber's-এ পাওয়া যায়, lungi, হিন্দি এবং ফারসি থেকে, অর্থ, নিম্নদেশে বা মাথায় পরিধেয় কাপড়। Concise Oxford Dictionary-তেও lungi, উর্দু থেকে, অর্থ, নিম্নদেশে পরিধেয় কাপড়। বাংলায় বাঙ্গালি পুরুষের নিম্নদেশে পরিধেয় বস্ত্র হলেও, ফারসিতে একসময় তা পাগড়ির কাপড়কেও বোঝাত। জন টমসন প্ল্যাট্স-এর উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি এবং ইংরেজি অভিধানের মতে মুসলমানদের ধুতি বা লাঙ্গ হিসেবে পরার জন্য রঙিন কাপড়, বা মাথার পাগড়ির জন্য চেক বা সোনালি কাপড়। শব্দটি ব্যুৎপন্ন হিন্দি লাঙ্গ (लांग) থেকে যার অর্থ পায়ের ভাঁজে পরার জন্য এক ধরণের ধুতি। জন শেক্সপিয়ারের হিন্দুস্তানি ও ইংরেজি অভিধানে অর্থ লাঙ্গ হিসেবে পরার জন্য এক ধরণের রঙিন কাপড়। জোসেফ ফ্রান্সিস স্টেইনগ্লাসের ১৮৯২ সালে ছাপানো ফারসি-ইংরেজি অভিধানের অর্থ, এক ধরণের কাপড় যা কোমরে দু'পায়ের মাঝখান দিয়ে পরতে হয়। হেনরি ইউল-এর ১৯০৩ সালে ছাপানো হবসন-জবসন-এ longhee, ব্যুৎপত্তি, হিন্দি লুঙ্গী < ফারসি লুঙ্গ বা লাঙ্গ, লুঙ্গী, অর্থ, গায়ে পেঁচিয়ে পরার কাপড়, ফরাসিরা যাকে pagne বলে, অর্থাৎ নিম্নদেশে এক বা দুইবার পেঁচিয়ে কোমরে গুঁজে দেওয়া। এ অভিধানেও লুঙ্গি বলতে পাগড়ির কাপড়কেও বোঝানো হয়েছে। এতকিছুর অর্থ হল, লুঙ্গি শব্দটি ফারসি থেকে হিন্দির মাধ্যমে বাংলায় ব্যুৎপন্ন হলেও হতে পারে। আবার তা না হলেও, ফারসি এবং হিন্দি শব্দের বানান এবং অর্থে যথেষ্ট প্রভাবিত বর্মি থেকে আগত এই লুঙ্গি শব্দটি।
দু'পায়ের ভাঁজে কোমরে পেঁচিয়ে পরার কাপড় অর্থে ফারসি আরেকটি শব্দ বাংলায় বিদ্যমান, যদিও এর দেখা মেলে বাংলার উপভাষায় — তবন, তহবন, তফন, তঅমান, ইত্যাদি বানানে। ফারসি তহ্-বন্দ্ (ته بند), তহ্ অর্থ নিম্নদেশ, আর বন্দ্ অর্থ যা পেঁচিয়ে পরা যায়, ইংরেজিতে loin cloth, অর্থাৎ লুঙ্গি।
ফুঙ্গির দেখা মেলে না সহজে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'শ্মশান-শয্যায় আচার্য্য হরিনাথ দে' কবিতার দ্বিতীয় স্তবকটি এ রকম —
একটি চিতায় পুড়ছে আজি আচার্য্য আর পুড়ছে লামা,
প্রোফেসার আর পুড়ছে ফুঙি, পুড়ছে শমস্-উল্-উলামা।
পুড়ছে ভট্ট সঙ্গে তারি মৌলবী সে যাচ্ছে পুড়ে,
ত্রিশটি ভাষার বাসাটি হায় ভস্ম হ'য়ে যাচ্ছে উড়ে।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে পাওয়া যায় ফুঙ্গি (-ঙ্গী) এসেছে বর্মি ফুঙ্গি থেকে, অর্থ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। চট্টলাদির উচ্চারণে শব্দটি দাঁড়ায় পুঙ্গি বা পুঙি-তে। গ্রাম্য উদাহরণ, পুঙির পুত, সন্ন্যাসীর পুত্র, জারজ অর্থে। সাধু বর্মি শব্দের বাংলা তদ্ভব গালি, অর্থ ও বানানে।
No comments:
Post a Comment