ফারসি মোঘল সাম্রাজ্যের ভাষা থাকার কারণে এবং পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহানের সময়ে সেনাদের মধ্যে উর্দুর ব্যবহারের ফলে ইংরেজদের হাতে পড়ার আগেই বাংলায় অনেক আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে, পোশাক-ধর্ম পাল্টে, কিংবা আরবি-ফারসি হিসেবেই। আঠারশ' শতাব্দীর প্রথমদিকের লেখা --- 'হোমাঙু বাদসাহের ওফাত হইলে হিন্দোস্তানে বাদসাহ হইতে ব্যাজ হইল, আপনারদের মধ্যে আত্মকলহ কইয়া বিস্তর২ লড়াই কাজিয়া হইল।' পরে বাংলা ভাষায় এই আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার কমে যায়। সাধু ভাষা হয় সাহিত্যের বাহন আর সরল ভাষা, যা গেল শতাব্দীর প্রায় দেড় দশক পরে বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষা নামে পরিচিত হয়, চলতে থাকে মুখের ভাষায়। ভারত ভাগের পরে, খানিকটা ধর্মীয় কারণে সংস্কৃতায়িত বাংলা (যা অনেকে হিন্দুয়ানি বাংলা বলে মনে করে) ছেড়ে আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্যে এক ধরণের (এসলামি) বাংলার প্রচলন ঘটে বা ঘটানো হয়। এসময় এরকম ধরণের প্রস্তাবও ছিল যে 'অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট' না লিখে 'অনেক পীরে মাজেজা নষ্ট' বলা হোক। দু-একটি উদাহরণ --- 'ফজরের আউয়াল ওয়াকতে উঠিয়া ফুফু-আম্মা চাচাজীকে কহিলেন, আমাকে জলদি এক বদনা পানি দাও। আমি পায়াখানা ফিরিয়া গোসল করিয়া নামাজ পড়িয়া নাশতা খাইব।' বা 'গোজশ্তা এশায়াতে আমরা অতীতে বাংলা ভাষার নানা মোড় পরিবর্তনের কথা মোখ্তাসার ভাবে উল্লেখ করেছিলাম।' অথবা 'শহর কলকাত্তায় শেফাউল মুল্ক্ তশরিফ রাখিতেছেন না বহুত রোজের কথা। আর তশরিফ রাখিলেই ফায়দাই বা কি? সে ছিল এক জামানা। ওজারতের তেজারত আর তেজারতের ওজারতে সুবে বাঙ্গলা ছিল সরগরম।' সংস্কৃত, আরবি-ফারসি, ফরাসি, পর্তুগিজ, তুর্কি, বর্মি সব ভাষার শব্দ নিয়েই বাংলা ভাষার, তার হিন্দুয়ানিও নেই মুসলমানিও নেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আগের বাংলায় যেমন আরবি-ফারসি ও সংস্কৃত শব্দ পাওয়া যায়, তার পরেও ঠিক তেমনই পাওয়া যায়। বাংলার ভাষার প্রকৃতি বজায় রেখে সহজে খাপ যায় এমন ভাবে বিদেশি শব্দের ব্যবহার বাংলায় ঢের সাহিত্যিকের লেখায় পাওয়া যায়। যদি কোনও ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণে লেখায় বা বাচনে সংস্কৃত বা আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য দেখা দেয়, তাহলে তা ভাষাপ্রকার (register) হিসেবে চিহ্নিত হবে।
No comments:
Post a Comment