নববাংলা বলে একটা ব্যাপার বেশ কিছুদিন ধরে নীরবে থেকে হঠাৎ করেই জ্বলে উঠে নিভে গেল। নিভে গেল কারণ, এর ওয়েব সাইটে এখন আর ঢোকা যায় না। কারণটি অবশ্য জানা নেই। তবে অনেক ব্লগে এর বিরুদ্ধে বক্তব্য আছে বেশ, কিঞ্চিৎ স্তুতিও, বুঝে বা না বুঝে। নববাংলা হল বাংলা লেখার নতুন হরফ এবং লিখন পদ্ধতি, মোটামুটি ধ্বনিমূলক এবং উচ্চারণ ভিত্তিক (মোটামুটি, কারণ এর ধ্বনিমূলতা এবং উচ্চারণের ভিত্তিতে স্পষ্টত গলদ লক্ষ্যণীয়)। উদ্ভাবক বা উদ্যোক্তা হল শাহ এম মুসা, ইন্টেল কর্পোরেশনের একজন মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইনার। তবে নববাংলার ওয়েব সাইটে আর ঢোকা না গেলেও ভারতীয় ভাষাবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা 'ল্যাঙ্গুয়েজ ইন ইন্ডিয়া'-র ষষ্ঠ সঙ্খ্যায় (পহেলা জানুআরি ২০০৬) একটি লেখা ছিল --- "এ সিম্প্ল স্ক্রিপ্ট ফর বাংলা অ্যান্ড দি আইপিএ ম্যাপিং দেয়ারঅব।" ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে ঢাকায় সঙ্ঘটিত একটি অনুষ্ঠানে পেশ করা একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টশনও (নববাংলা অ্যান্ড দি ফনেটিক্স দেয়ারঅব) ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, এক সময় অন্তত যেত। ২০০৬-এর মাঝামাঝি ঢাকার পত্রিকাগুলোতে এ সম্পর্কে লেখাও ছাপা হয়। এই লিপি উদ্ভাবনের কাজ ২০০৪-এর আগে থেকেই সম্ভবত হয়ে আসছে। এইসব লেখার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে নববাংলার সমস্ত ব্যঞ্জন ধ্বনিমূলক, স্বরচিহ্ন ব্যঞ্জনের পরে বসে, লেখার রীতি অ্যালফাবেটিক, এবং যুক্তবর্ণ বিযুক্ত, অন্তত উদ্ভাবকের তাই ধারণা। লেখাটিতে বাংলা ধ্বনিমূলের আলোচনার দিকে যত কম দৃষ্টি দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।
তবে উদ্ভাবকের ধ্বনিমূলকতা ধারণা একেবারেই ভুল। কারণ নববাংলার লেখার রীতিতে প্রকাশ পায় যে প্রতিটি ব্যঞ্জনই হলন্ত, অনেকটা রোমান হরফের মত, বাংলা অন্তর্নিহিত অ সেখানে অনুপস্থিত। বাংলায় ক অর্থ ক্ + অ; কিন্তু নববাংলায় ক অর্থ ক্, বাংলার ক লিখতে একটি অ-দ্যেতক হরফ ব্যবহার করতে হবে, আর তাই অজগর-এর র-এর অ-কে লেখা হয় না। ধরে নিতেই হয় উচ্চারণানুগ বানান। মজার ব্যাপার হল বাংলায় সাধারণ উচ্চারণ হল অজোগর্, তবে নববাংলায় লেখা হয় অজ্অগ্অর। উদ্ভাবকের পূর্ণিমা বানান ধ্বনিমূল থেকে সরে গিয়ে অনেকটা বাংলার অক্ষরানুগ। কারণ নববাংলায় শব্দটির দীর্ঘ ঊ লেখা হয়, আবার মূর্ধন্য ণ-ও লেখা হয়। বাংলায় ধ্বনিমূলতার দিক দিয়ে হ্রস্ব উ এবং দীর্ঘ ঊ-র মাঝে কোনও প্রভেদ নেই। তেমনি মূর্ধন্য ণ এবং দন্ত্য ন-এর উচ্চারণও এক। সাধারণভাবে বাংলায় ঞ-এর উচ্চারণ য়ঁ এবং যুক্তবর্ণে ন, তাহলে ঝঞ্ঝাট বানানে নববাংলায় ঞ-এর ব্যবহার কেন? অ-তিরোহিত ত দিয়ে যদি 'হঠাত' লেখাই যায়, তাহলে বর্ণমালায় খণ্ড-ত রাখা কেন? নববাংলায় দুঃখ বানান 'ক্খ' দিয়ে লেখা হয়, আবার বিসর্গ দিয়েও লেখা যায়। এখানে বিসর্গের উচ্চারণ কোথায়? যেহেতু হরফ-পশ্চাৎ হ্রস্ব-ইকে দু'বার লিখে দীর্ঘ-ঈ লেখা হয় নববাংলায়, (আমি) দিই-কে কিভাবে লেখা হবে? নববাংলার হিসেবে তাকে কি 'দী' পড়বার অবকাশ থাকবে না?
উদ্ভাবক বাংলার উচ্চারণ বা প্রতিলিপিকরণ বা লিপ্যন্তরীকরণ (transcription) বানানো হরফে লিখতে গিয়ে প্রতিবর্ণীকরণ (transliteration) দ্বারা অজান্তেই প্রভাবিত। পৃথিবীতে প্রচলিত যে কোনও হরফে বাংলার প্রতিবর্ণীকরণ হলে তা কখনই ধ্বনিমূলক হবে না। কারণ বানান (প্রতিবর্ণীকরণ) এবং উচ্চারণ (প্রতিলিপিকরণ) দুটো দুই বস্তু।
শেষে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে উচ্চ-প্রযুক্তির যুগে গণকযন্ত্রে বৈদ্যুতিন বার্তা আর মুঠোফোনে সংক্ষিপ্ত বার্তা লিখতে গিয়ে বাংলায় লিখতে পারার যোগ্যতা বা সুযোগের অভাবে চ্যাংড়ার দল রোমান হরফে এক ধরণের বাংলা লিখে থাকে, তা যতই দৃষ্টিকটু এবং অবোধ্য হোক না কেন নববাংলার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বনিমূলক। নববাংলা হয়ত বাংলার ইতিহাসে উটকো বানানো লিখনপদ্ধতি (constructed script) হিসেবে অত্যুৎসাহী-অবোধ্যতাগামী গুটি কয়েক লোকের মাঝে টিকে থাকবে। আর ব্যক্তিগত বা বিশেষ কোন কাজে ব্যবহারের জন্য লিখন পদ্ধতি যে কেউই বানাতে পারে। তাতে বাধা দেবার কিছু নেই।
No comments:
Post a Comment