সাধারণভাবে বলা হয় স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব-হ্রস্বত্ব বা স্বরাঘাতে বাংলায় অর্থের পার্থক্য হয় না। একাক্ষর শব্দে স্বরধ্বনি সাধারণত কিঞ্চিৎ দীর্ঘ। যেমন, দিন বা দীন /diˑn/ বা /diːn/, কিন্তু দিনাবসান /dinɑboʃɑn/, এখানে হ্রস্ব। ১৯২০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যায়লয়ের ছাপানো বিজয়চন্দ্র মজুমদারের ইংরেজিতে লেখা বাংলা ভাষার ইতিহাস (The History of the Bengali Language) নামের বইয়ে তিন ধরণের স্বরাঘাতের উল্লেখ পাওয়া যায় — উচ্চ, মধ্যম এবং নীচ। বিজয়চন্দ্রের ভাষায়: যদি রাজপুত্রের রা-তে উচ্চ স্বরাঘাত দেওয়া হয় [/ˈrɑdʒputːro/], তবে তা হবে বহুব্রীহি এবং অর্থ পুত্র রাজা যার; আর যদি স্বরাঘাত পড়ে শেষ অক্ষর ত্র-তে [/rɑdʒputːˈro/], তবে তা হবে তৎপুরুষ এবং অর্থ রাজার পুত্র। এই পার্থক্য কেউ করে কি? জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটির অর্থ কিন্তু একটিই, রাজার পুত্র। একই রকমভাবে কলম /ˈkɔlom/ অর্থ লেখনী, আর কলম /kɔˈlom/ অর্থ গাছের জোড়। বইটিতে এরপর আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া আছে যেখানে স্বরাঘাতে অর্থ বদল হয়। যেমন, আটা /ˈɑʈɑ/ (গমচূর্ণ) ও আটা /ɑˈʈɑ/ (আঠা); কড়ি /ˈkoɽi/ (বরগা কাঠ) ও কড়ি /koˈɽi/ (টাকা); কানা /ˈkɑnɑ/ (অন্ধ) ও কানা /kɑˈnɑ/ (প্রান্ত); খোলা /ˈkʱolɑ/ (খুলে ফেলা) ও খোলা /kʱoˈlɑ/ (টালি); ছোঁড়া /ˈtʃoɽɑ/ (বালক) ও ছোঁড়া /tʃoˈɽɑ/ (ছুঁড়ে ফেলা); গেরো /ˈgero/ (বন্ধন) ও গেরো /geˈro/ (গ্রহ, মন্দভাগ্য), চান /ˈtʃɑn/ (গোসল) ও চান /tʃɑn/ (তিনি চান); ঘাট /ˈɡʱɑʈ/ (গোসলের চায়গা) ও ঘাট /ɡʱɑʈ/ (দায়িত্বে স্খলন)। বইতে আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালায় উচ্চারণগুলো দেখানো নেই। বিজয়চন্দ্রের ভাষায়, সুগন্ধ হলে স্বরাঘাত থাকে গন্ধের প্রথম অক্ষরে /ˈɡɔndʱo/, আর দুর্গন্ধ হলে থাকে পরের অক্ষরে /ɡɔnˈdʱo/। বিজয়চন্দ্রের উদাহরণে ব্যাপারটা কি স্বরাঘাতের নাকি স্বরধ্বনির দীর্ঘত্বের, বিশেষত যখন শব্দটি একাক্ষর, যেমন, চান এবং চান? বইতে শেষের গন্ধের উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে গন্ধ-অ-অ। নির্দেশ কিন্তু দীর্ঘত্বের দিকে।
বাংলায় চায়ের উচ্চারণ চা /tʃɑˑ/ বা /tʃɑː/, এবং একাক্ষর বলে খানিকটা দীর্ঘ। সাথে -টা যোগে 'চা টা নিয়ে এস' হলে চা-র উচ্চারণ খানিকটা দীর্ঘই থাকে, টা-এর উচ্চারণ হ্রস্ব হয়, /tʃɑˑ ʈɑ/। কিন্তু যদি চা এর সাথে টা-এর ব্যাপার থাকে, যেমন চা-টা, চা-পানি অর্থে, তাহলে টা-এ উচ্চারণ আবার দীর্ঘ হয়ে যায়, /tʃɑˑ ʈɑˑ/। আবার চেটে নেওয়া অর্থে চাটা হলে কোনও স্বরই দীর্ঘ অনুমিত হয় না, যেমন /tʃɑʈɑ/, নাকি /ˈtʃɑʈɑ/, প্রথম স্বরে আঘাত বলে মনে হচ্ছে। বাংলায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুটি অক্ষরের প্রথমটিতে খানিকটা স্বরাঘাত থাকে। এই স্বরাঘাত 'চা টা,' 'চা-টা,' এবং 'চাটা' সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে এই স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব বা হ্রস্বত্ব এবং স্বরাঘাত কোনওটিই বাংলার ধ্বনিমূলক (phonemic) বৈশিষ্ট্য নয়, উচ্চারণগত (phonological) বৈশিষ্ট্য।
1 comment:
ধুর, আমার ওই "গন্ধ" ছাড়া বিজয়চন্দ্রের বাকি সমস্ত উদাহরণই মনগড়া বলে মনে হয়েছে, অন্ততঃ আজকের বাংলায় আর ওইসব পার্থক্যের কোনও অস্তিত্ব নেই - সে স্বরাঘাতজনিত পার্থক্যই হ'ক, বা স্বরের দৈর্ঘ্যজনিত।
Post a Comment