আপনি কি পড়ছেন? মানে, পড়ছেন কি? বা পড়ছেন? সাদামাটা প্রশ্ন: এ মুহূর্তে পড়ার কাজটা চলছে কি না? উত্তর হয় হ্যাঁ বা না। এখানে কি-এর কাজ প্রশ্ন করা, প্রশ্নবাচক অব্যয় (interrogative particle)। আবার আপনি কী পড়ছেন? মানে পড়ছেন টা কী? বা কোন বই বা লেখা পড়ছেন? এ মুহূর্তে কোন বই পড়ার কাজ চলছে? উত্তর হ্যাঁ-ও নয়, আবার না-ও নয়। অন্য কোনও কিছু। এখানে কী-এর কাজ সর্বনামের, সর্বনামবাচক অব্যয় (interrogative pronoun)। কি-এর ক্ষেত্রে স্বরাঘাত পড়ে ক্রিয়ার উপর, আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কী-এর উপর। প্রথম ক্ষেত্রে ‘কি’ বাদ দেওয়া যায়, লেখায় এবং কথায়। লেখায় প্রশ্নসূচক চিহ্ন বলে দেবে এটি প্রশ্ন, কথায় (ধ্বনিতত্ত্বের ভাষায়) সাধারণ আরোহী স্বরাঘাতের দরকার পড়বে, অর্থাৎ শেষের অক্ষর (হরফ নয়) প্রথমটির চেয়ে জোরালো উচ্চারিত হবে। ‘কি’ হল প্রশ্ন, বিস্ময় বা সংশয়বোধক; আর ‘কী’ হল সর্বনামবাচক, ক্রিয়া বিশেষণ বা বিশেষণের বিশেষণ। কী আশ্চর্য! আশ্চর্য কি?
সংস্কৃত কিম্ থেকে প্রাকৃত হয়ে বাংলায় কি। তবে প্রাকৃতে ‘কি’ এবং ‘কী’ নির্বিশেষে ব্যবহৃত হয়। মধ্য বাংলা সাহিত্যে, এমনি উনিশ শতাব্দ, পর্যন্ত অবশ্য কী-এর ব্যবহার তেমন একটা নেই। কারণ ততদিনে বাংলা প্রাকৃতের বলয় থেকে বের হয়ে সংস্কৃতায়িত হয়েছে। কারণ সংস্কৃতের চর্চা এবং সংস্কৃতের মূল অনুযায়ী বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা। মধ্য বাংলা সাহিত্যের শুরুর দিকে, শিক্ষিত বাঙালি অনেকের ঘরে তখন পাণ্ডুলিপি, যার অধিকাংশই সংস্কৃত। অনেক পরে এসে ‘কি’ এবং ‘কী’ আলাদা শব্দ হিসেবে অর্থভেদের প্রচেষ্টা পায়। কি, সংস্কৃত কিম্ (किम्) থেকে; আর কী, সংস্কৃত কীদৃক্ (कीदृक्) এর তুলনায়, যার অর্থ কিপ্রকার, কেমন বা কি রকম। সুভাষ ভট্টাচার্যের মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম অর্থভেদের সপক্ষতা করেছেন। শব্দতত্ত্বে আছে —‘অব্যয় শব্দ “কি” এবং সর্বনাম শব্দ “কী” এই দুইটি শব্দের সার্থকতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাদের ভিন্ন বানান না থাকলে অনেক স্থলেই অর্থ বুঝতে বাধা ঘটে। এমন-কি, প্রসঙ্গ বিচার করেও বাধা দূর হয় না। “তুমি কি জানো সে আমার কত প্রিয়” আর “তুমি কী জানো সে আমার কত প্রিয়”, এই দুই বাক্যের একটাতে জানা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হচ্ছে আর একটাতে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে জানার প্রকৃতি বা পরিমাণ সম্বন্ধে...।’
এই বিচারে প্রশ্নসূচক সর্বনাম হিসেবে কিভাবে না লিখে কীভাবে এবং কিসের না লিখে কীসের লেখা উচিত। চলন্তিকায় কী-এর কদর তেমন একটা নয়: ‘কী (কি দেখ)।’ কি-এর উদাহরণে, কি জিনিস; আর ‘বেশী জোর দিতে (“কী সুন্দর! তোমার কী হয়েছে?”’ জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং হরিচরণে ‘কী সর্বনাশ!’ পাওয়া যায়, তবে কি এবং কী এর অর্থভেদের ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। জ্যোতিভূষণ চাকীর বাংলা ভাষার ব্যাকরণ এবং হায়াৎ মামুদের বাংলা লেখার নিয়মকানুনে অর্থভেদ সংরক্ষিত। অনেকেই পার্থক্য করে না, আবার অনেকে মেনে চলে।
No comments:
Post a Comment