জীবনানন্দ দাশের ‘বেদিয়া’য় — তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা,/তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা! গোধূলিতে দীর্ঘ ঊ। হ্রস্ব উ দিলেও অশুদ্ধ হবে না। জ্ঞানেন্দ্রমোহনেও -ঊ-, -উ-। মনিয়ের মনিয়ের-উইলিয়াম্সের সংস্কৃত অভিধান মতেও দুটি বানানই শুদ্ধ। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দের ব্যুৎপত্তিতে বলা আছে ‘গোর (গোরুর) ধূলি (ক্ষুরাঘাতে উত্থিত রজঃ) হয় যে সময়ে,’ যেমনটি ছোটবেলায় ইশকুলে পড়ানো হত। তবুও অনেকেরই ধারণা ব্যুৎপত্তিটি ঠিক নয়। কারণ জ্ঞানেন্দ্রমোহনেই গো শব্দটির সংজ্ঞার্থ দেওয়া আছে ২০টি, যার একটি অর্থ কিরণ।শেষে টীকা — দ্রঃ-সকল অর্থ বাঙ্গালায় প্রচলিত নাই। বৈদিক সংস্কৃতে গো-এর অর্থ ছিল আলো এবং ধূলি-র অর্থ অন্ধকার,দুয়ে মিলে গো এবং ধূলির সন্ধিকাল, অর্থাৎ সন্ধ্যা। মনিয়ের-উইলিয়াম্সেও গো-এর একটি অর্থ আলোর কিরণ (rays of light), যদিও ধূলির আঁধার অর্থ নেই। গো আলো বোঝালেই গোধুলি শুনতে ভাল লাগে।
দিল্লি থেকে মতিলাল বানারসিদাসের প্রকাশিত কিরীট জোশির The Veda and Indian Culture: An Introducory Essay-র প্রথম অধ্যায়ে আছে গো বলতে গরু বোঝায় এক অর্থে, অন্য অর্থে আলো। যদি বেদের পঠনে গো অর্থ গরু ধরা হয় তবে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত কাজ চলে যায়, কিন্তু অনেক জায়গায় কোনও অর্থ দাঁড়ায় না (... the word go means a cow, in one sence, but it also means light, in another sense. Now it is found that if the word go is interpreted to mean cow in the Veda, it serves well up to a certain point, but this interpretation breaks down at some most crucial points ...)। মার্কিন লোটাস লাইট পাবলিকেশন্স্-এর প্রকাশিত শ্রী অরবিন্দ ঘোষের The Secret of the Veda-য়, গো শব্দটির দেখা মেলে এক হাজারেরও বেশি জায়গায় এবং বত্রিশ অর্থে যেমন গরু, পানি, আলো, শব্দ, ইত্যাদি (The word go which occurs in more than one thousand verses is given thirty two different meanings ranging from cow, water, ray, sound etc.)। ঋগ্বেদে আছে गोभिरद्रिमैरयत् বা গোভিরদ্রিমৈরয়ৎ, অর্থাৎ (ইন্দ্র) আলো দিয়ে পাহাড় ভেদ করল। এখানে আলো দিয়ে না হয়ে, গরু দিয়ে হয় না। অনেকে পাহাড়কে অজ্ঞানতার প্রতীক হিসেবে দেখে।
এরপরও মনিয়ের-উইলিয়াম্সের অভিধানে গোধূলি অর্থ পৃথিবীর ধূলি (earth-dust), যখন মনে হয় পৃথিবী থেকে কুয়াশা উঠছে, যেমন গরম কালে যখন সূর্য অর্ধেক উঠে থাকে আর শীতকালে যখন পূর্ণ সূর্যের তেজ কম থাকে, বা সন্ধ্যা। পৃথিবী অর্থেও গো-এর প্রচলন বেদেই আছে – पदे गौः (পদে গৌঃ, পৃথিবীর চলা পথে, ইংরেজিতে in the footsteps of the earth। এ অর্থে শব্দটি বোধ করি গ্রিক γεος (geos) এর সমার্থক। গবাক্ষ শব্দের ব্যুৎপত্তিতে জ্ঞানেন্দ্রমোহনে লেখা আছে — গো (কিরণ) অক্ষ্ (বিস্তৃত কর) + অ (কর্তৃকারক), যে গৃহাদির মধ্যে কিরণ বিস্তার করে, বা গো-গোরু অক্ষি (চক্ষু) যে গোরুর চক্ষুর ন্যায় গোলাকার। এখানে গো অর্থ হয় আলো, নয়ত গরু, ফরাসি থেকে আসা ইংরেজি শব্দ œil-de-bœuf এর মত, bull's eye বা গরুর চোখ, সেই ছোট গোল জানালা বা bullseye window অর্থেই। কাকতালীয় কি? সংস্কৃতে অর্থ ষাঁড়ের চোখ, গোল জানালা, ইত্যাদি।
গবেষণা শব্দটি জ্ঞানেন্দ্রমোহনের মতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান। সংস্কৃতে গবেষণ, মনিয়ের-উইলিয়াম্সে অর্থ চাওয়া বা খোঁজা। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে গো+এষণ-ইম্ (অন্বেষণকরা) + অন। অর্থ অন্বেষণ। ছোটবেলায় দুষ্টামি করে বলা হত গো অন্বেষণ বা গরু খোঁজা। গো-এর অর্থ আলো ধরে নিলে অর্থটা বেশ খেলে, আলো খোঁজা।
No comments:
Post a Comment