বাংলায় এ-কার দু'টি, দৃশ্যত। শুরুতে মাত্রা ছাড়া এ-কার শব্দের প্রথমে এবং মাত্রাসহ এ-কার মাঝে বসে। বাংলার হরফযোজনার এ-ই নিয়ম। কম্পিউটারের বাংলা লেখার সময়ও এই হাত-কম্পোজ-এর যুগের একটি নিয়মই এখনও মানা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে ছাপানো তার লেখায়, বিশেষত গানে, একটি নিয়ম মানা হত, এ-র বিবৃত উচ্চারণের (অ্যা) জন্য শব্দের প্রথমে মাত্রাসহ এ-কার বসানো হত।
বুদ্ধদেব বসুর লেখায়ও তেমন দুয়েকটি ব্যাপার দেখা যায়। তার প্রচেষ্টা ছিল হ-এ য-ফলার দু'রকম ব্যবহারের: য-ফলা খানিকটা ছোট হয়ে হ-এর গায়ে লাগানো রূপটি ব্যবহৃত হত সংস্কৃত শব্দ যেখানে জ-ঝ-এর উচ্চারণ সেখানে, যেমন সহ্য শব্দে; আবার তদ্ভব বা বিদেশি শব্দ যেখানে য-ফলা অ্যা-কারের ভূমিকা পালন করে সেখানে য-ফলা একটু বড় হয়ে হ-এর থেকে একটু দূরত্বে বসত, যেমন হ্যাঁ, হ্যাপা বা হ্যালসিঅন শব্দে। তার আরও একটি ব্যবহার বেশ কাজের এবং চোখে পড়বার মত। যেহেতু বইয়ে প্রতি পাতায় উপরের সাদা প্রান্তের পরিমাপ একই, তাই সাধারণভাবে দুই স্তবকের মাঝে ফাঁক থাকলেও কখনও স্তবক নতুন পাতায় শুরু হলে তার প্রথম চরণটি ইন্ডেন্ট (একটু ডানে সরিয়ে) করে ছাপানো হত, যেন স্তবকের শুরু বুঝতে অসুবিধা না হয়।
বুদ্ধদেবের ইলেক চিহ্নের ব্যবহার এখন অনেকাংশে উঠে গেলেও, ব্যবহার অন্য জায়গায়ও দেখা গেছে। রবীন্দ্রনাথের দুই এ-কারের ব্যবহার বা বুদ্ধদেবের হ-এ য-ফলার ব্যবহার তাদের লেখার ছাপাতেই সীমাবদ্ধ। নতুন গজিয়ে ওঠা অনেক প্রকাশনা সংস্থার অনেকেই, বিশেষত কম্পিউটারের ভিড়ে ছাপাখানার অনেক ছোটখাট নিয়ম হারিয়ে যাওয়ার যুগে, হয়ত জানে না এরকম হরফের এরকম ব্যবহার কখনও ছিল।
Thursday, March 13, 2008
Tuesday, March 11, 2008
হরফের রেখা আর চতুষ্কোণ
হরফের চেহারা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কিছু বিশেষ শব্দের প্রয়োজন পড়ে। রোমক হরফ নিয়ে বিস্তর চর্চা হবার ফলে ইংরেজি বা অন্য ইউরোপীয় ভাষায় বিষয়-সম্পর্কিত শব্দও ঢের। বাংলায় হরফের চেহারার চর্চা যারা টাইপ বানাত তাদের মধ্যে থাকলেও তাদের ব্যবহৃত শব্দগুলো বাইরের জগতে এসে পড়তে পারে নি, বোধ করি তেমন লেখালেখি না হবার কারণে। ধরা হয় রোমক হরফ চার সরলরেখার একটি অদৃশ্য নকশার ওপর বসানো: একদম উপরের রেখাটির নাম অ্যাসেন্ডার লাইন (ascenderline), তারপর ক্যাপলাইন (capline), তারপর বেসলাইন (baseline) এবং শেষে ডিসেন্ডারলাইন (descenderline); ক্যাপলাইন এবং বেসলাইনের মাঝে আরও একটি রেখা টানা হয়, ছোটহাতের হরফের উচ্চতা (x-height) বরাবর, তার নাম মিনলাইন ((meanline) বা মিডলাইন midline)।
বাংলা হরফও তেমনি একটি অদৃশ্য নকশার উপর বসানো যায়। মাত্রার সাথে যে রেখাটি চলে যাবে তার নাম হতে পারে মাত্রারেখা (১) বা headline। আর মাত্রা থেকে ঝুলে নিচে বেশির ভাগ হরফের নিচ যেখানে ঠেকে যাবে তার নাম হতে পারে ভূমিরেখা (২) বা baseline। এই মাত্রারেখা থেকে ভূমিরেখার দূরত্বকে ধরা হবে হরফের মূল উচ্চতা বা base height। মাত্রারেখার উপর আরও একটি রেখা টানা যেতে পারে যা ছুঁয়ে থাকবে ই-কারের উড়াল বা রেফের মাথা আর এই রেখাটির নাম হতে পারে শিরোরেখা (৩) বা topline। ঠিক তেমনিভাবে সবচেয়ে নিচে একটি রেখা টানা হবে, উ-কারের নিচ ছুঁয়ে, যার নাম হতে পারে পাদরেখা (৪) বা dropline। ক বা ত এর মূল রূপ যেখান থেকে শুরু সেখানে আরও একটি রেখা টানা যেতে পারে যার নাম হতে পারে মধ্যরেখা (৫) বা meanline। ভূমিরেখা থেকে মাত্রারেখার উচ্চতাকে হরফরের সাধারণ উচ্চতা (height) বলে ধরা হবে। পাদরেখা থেকে শিরোরেখার দূরত্বকে সাধারণভাবে হরফের উচ্চতা (letter height বা corps size) বলে ধরা যেতে পারে। রোমক হরফ ভূমিরেখার উপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে; বাংলায় কিন্তু হরফগুলো মাত্রারেখা থেকে ঝুলে থাকে; এবং অনেকক্ষেত্রেই হরফের নিম্নাংশ ভূমিরেখা ছোঁয় না। এ কারণে বোধহয় ফিওনা জি ই রস (Fiona GE Ross) তার মুদ্রিত বাংলা হরফ ও তার বিবর্তন (The Printed Bengali Character and its Evolution) বইয়ে একে বেসলাইন না বলে নোশ্যনাল (notional) বেসলাইন বা ধারণাগত বা ধরে-নেওয়া ভূমিরেখা বলেছে।
হরফ সাধারণত একটি অদৃশ্য চতুষ্কোণের মধ্যে বসানো থাকে। এবং এই চতুষ্কোণের দু'পাশে খানিকটা জায়গা ছেড়ে তারপর হরফটি বসে। এই চতুষ্কোণটি ছবিতে লাল রঙে আঁকা হয়েছে। আর হরফটি বসানো আছে সবুজ দু'টি দাগের মাঝে। এই লাল দাগ থেকে সবুজ দাগের ইংরেজি নাম সাইডবেয়ারিং (sidebearing), বাংলায় হতে পারে পার্শ্বস্থান। দু'পাশের পার্শস্থান বাদ দিলে বাকি জায়গা যেখানে হরফ বসানো থাকে তাকে হরফের মূল প্রস্থ বলা যায়। পাশাপাশি দু'টি হরফের পার্শ্বস্থান মিলে ধরা হয় দু'টি হরফের মাঝে ফাঁক।
বাংলা হরফও তেমনি একটি অদৃশ্য নকশার উপর বসানো যায়। মাত্রার সাথে যে রেখাটি চলে যাবে তার নাম হতে পারে মাত্রারেখা (১) বা headline। আর মাত্রা থেকে ঝুলে নিচে বেশির ভাগ হরফের নিচ যেখানে ঠেকে যাবে তার নাম হতে পারে ভূমিরেখা (২) বা baseline। এই মাত্রারেখা থেকে ভূমিরেখার দূরত্বকে ধরা হবে হরফের মূল উচ্চতা বা base height। মাত্রারেখার উপর আরও একটি রেখা টানা যেতে পারে যা ছুঁয়ে থাকবে ই-কারের উড়াল বা রেফের মাথা আর এই রেখাটির নাম হতে পারে শিরোরেখা (৩) বা topline। ঠিক তেমনিভাবে সবচেয়ে নিচে একটি রেখা টানা হবে, উ-কারের নিচ ছুঁয়ে, যার নাম হতে পারে পাদরেখা (৪) বা dropline। ক বা ত এর মূল রূপ যেখান থেকে শুরু সেখানে আরও একটি রেখা টানা যেতে পারে যার নাম হতে পারে মধ্যরেখা (৫) বা meanline। ভূমিরেখা থেকে মাত্রারেখার উচ্চতাকে হরফরের সাধারণ উচ্চতা (height) বলে ধরা হবে। পাদরেখা থেকে শিরোরেখার দূরত্বকে সাধারণভাবে হরফের উচ্চতা (letter height বা corps size) বলে ধরা যেতে পারে। রোমক হরফ ভূমিরেখার উপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে; বাংলায় কিন্তু হরফগুলো মাত্রারেখা থেকে ঝুলে থাকে; এবং অনেকক্ষেত্রেই হরফের নিম্নাংশ ভূমিরেখা ছোঁয় না। এ কারণে বোধহয় ফিওনা জি ই রস (Fiona GE Ross) তার মুদ্রিত বাংলা হরফ ও তার বিবর্তন (The Printed Bengali Character and its Evolution) বইয়ে একে বেসলাইন না বলে নোশ্যনাল (notional) বেসলাইন বা ধারণাগত বা ধরে-নেওয়া ভূমিরেখা বলেছে।
হরফ সাধারণত একটি অদৃশ্য চতুষ্কোণের মধ্যে বসানো থাকে। এবং এই চতুষ্কোণের দু'পাশে খানিকটা জায়গা ছেড়ে তারপর হরফটি বসে। এই চতুষ্কোণটি ছবিতে লাল রঙে আঁকা হয়েছে। আর হরফটি বসানো আছে সবুজ দু'টি দাগের মাঝে। এই লাল দাগ থেকে সবুজ দাগের ইংরেজি নাম সাইডবেয়ারিং (sidebearing), বাংলায় হতে পারে পার্শ্বস্থান। দু'পাশের পার্শস্থান বাদ দিলে বাকি জায়গা যেখানে হরফ বসানো থাকে তাকে হরফের মূল প্রস্থ বলা যায়। পাশাপাশি দু'টি হরফের পার্শ্বস্থান মিলে ধরা হয় দু'টি হরফের মাঝে ফাঁক।
Monday, March 10, 2008
স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব নাকি স্বরাঘাত?
সাধারণভাবে বলা হয় স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব-হ্রস্বত্ব বা স্বরাঘাতে বাংলায় অর্থের পার্থক্য হয় না। একাক্ষর শব্দে স্বরধ্বনি সাধারণত কিঞ্চিৎ দীর্ঘ। যেমন, দিন বা দীন /diˑn/ বা /diːn/, কিন্তু দিনাবসান /dinɑboʃɑn/, এখানে হ্রস্ব। ১৯২০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যায়লয়ের ছাপানো বিজয়চন্দ্র মজুমদারের ইংরেজিতে লেখা বাংলা ভাষার ইতিহাস (The History of the Bengali Language) নামের বইয়ে তিন ধরণের স্বরাঘাতের উল্লেখ পাওয়া যায় — উচ্চ, মধ্যম এবং নীচ। বিজয়চন্দ্রের ভাষায়: যদি রাজপুত্রের রা-তে উচ্চ স্বরাঘাত দেওয়া হয় [/ˈrɑdʒputːro/], তবে তা হবে বহুব্রীহি এবং অর্থ পুত্র রাজা যার; আর যদি স্বরাঘাত পড়ে শেষ অক্ষর ত্র-তে [/rɑdʒputːˈro/], তবে তা হবে তৎপুরুষ এবং অর্থ রাজার পুত্র। এই পার্থক্য কেউ করে কি? জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটির অর্থ কিন্তু একটিই, রাজার পুত্র। একই রকমভাবে কলম /ˈkɔlom/ অর্থ লেখনী, আর কলম /kɔˈlom/ অর্থ গাছের জোড়। বইটিতে এরপর আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া আছে যেখানে স্বরাঘাতে অর্থ বদল হয়। যেমন, আটা /ˈɑʈɑ/ (গমচূর্ণ) ও আটা /ɑˈʈɑ/ (আঠা); কড়ি /ˈkoɽi/ (বরগা কাঠ) ও কড়ি /koˈɽi/ (টাকা); কানা /ˈkɑnɑ/ (অন্ধ) ও কানা /kɑˈnɑ/ (প্রান্ত); খোলা /ˈkʱolɑ/ (খুলে ফেলা) ও খোলা /kʱoˈlɑ/ (টালি); ছোঁড়া /ˈtʃoɽɑ/ (বালক) ও ছোঁড়া /tʃoˈɽɑ/ (ছুঁড়ে ফেলা); গেরো /ˈgero/ (বন্ধন) ও গেরো /geˈro/ (গ্রহ, মন্দভাগ্য), চান /ˈtʃɑn/ (গোসল) ও চান /tʃɑn/ (তিনি চান); ঘাট /ˈɡʱɑʈ/ (গোসলের চায়গা) ও ঘাট /ɡʱɑʈ/ (দায়িত্বে স্খলন)। বইতে আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালায় উচ্চারণগুলো দেখানো নেই। বিজয়চন্দ্রের ভাষায়, সুগন্ধ হলে স্বরাঘাত থাকে গন্ধের প্রথম অক্ষরে /ˈɡɔndʱo/, আর দুর্গন্ধ হলে থাকে পরের অক্ষরে /ɡɔnˈdʱo/। বিজয়চন্দ্রের উদাহরণে ব্যাপারটা কি স্বরাঘাতের নাকি স্বরধ্বনির দীর্ঘত্বের, বিশেষত যখন শব্দটি একাক্ষর, যেমন, চান এবং চান? বইতে শেষের গন্ধের উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে গন্ধ-অ-অ। নির্দেশ কিন্তু দীর্ঘত্বের দিকে।
বাংলায় চায়ের উচ্চারণ চা /tʃɑˑ/ বা /tʃɑː/, এবং একাক্ষর বলে খানিকটা দীর্ঘ। সাথে -টা যোগে 'চা টা নিয়ে এস' হলে চা-র উচ্চারণ খানিকটা দীর্ঘই থাকে, টা-এর উচ্চারণ হ্রস্ব হয়, /tʃɑˑ ʈɑ/। কিন্তু যদি চা এর সাথে টা-এর ব্যাপার থাকে, যেমন চা-টা, চা-পানি অর্থে, তাহলে টা-এ উচ্চারণ আবার দীর্ঘ হয়ে যায়, /tʃɑˑ ʈɑˑ/। আবার চেটে নেওয়া অর্থে চাটা হলে কোনও স্বরই দীর্ঘ অনুমিত হয় না, যেমন /tʃɑʈɑ/, নাকি /ˈtʃɑʈɑ/, প্রথম স্বরে আঘাত বলে মনে হচ্ছে। বাংলায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুটি অক্ষরের প্রথমটিতে খানিকটা স্বরাঘাত থাকে। এই স্বরাঘাত 'চা টা,' 'চা-টা,' এবং 'চাটা' সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে এই স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব বা হ্রস্বত্ব এবং স্বরাঘাত কোনওটিই বাংলার ধ্বনিমূলক (phonemic) বৈশিষ্ট্য নয়, উচ্চারণগত (phonological) বৈশিষ্ট্য।
বাংলায় চায়ের উচ্চারণ চা /tʃɑˑ/ বা /tʃɑː/, এবং একাক্ষর বলে খানিকটা দীর্ঘ। সাথে -টা যোগে 'চা টা নিয়ে এস' হলে চা-র উচ্চারণ খানিকটা দীর্ঘই থাকে, টা-এর উচ্চারণ হ্রস্ব হয়, /tʃɑˑ ʈɑ/। কিন্তু যদি চা এর সাথে টা-এর ব্যাপার থাকে, যেমন চা-টা, চা-পানি অর্থে, তাহলে টা-এ উচ্চারণ আবার দীর্ঘ হয়ে যায়, /tʃɑˑ ʈɑˑ/। আবার চেটে নেওয়া অর্থে চাটা হলে কোনও স্বরই দীর্ঘ অনুমিত হয় না, যেমন /tʃɑʈɑ/, নাকি /ˈtʃɑʈɑ/, প্রথম স্বরে আঘাত বলে মনে হচ্ছে। বাংলায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুটি অক্ষরের প্রথমটিতে খানিকটা স্বরাঘাত থাকে। এই স্বরাঘাত 'চা টা,' 'চা-টা,' এবং 'চাটা' সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে এই স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব বা হ্রস্বত্ব এবং স্বরাঘাত কোনওটিই বাংলার ধ্বনিমূলক (phonemic) বৈশিষ্ট্য নয়, উচ্চারণগত (phonological) বৈশিষ্ট্য।
Subscribe to:
Posts (Atom)