সাধু আর চলিত,বা চলতি, বাংলা ভাষার প্রধান দুই মান্য রীতি। শান্তিপুর আর নদিয়ার হলেও, চলিত ভাষা এখন কোন অঞ্চলের ভাষা নয়। বরং সর্বগ্রাহ্য মান্য ভাষা। আর সাধু ভাষার ব্যবহার এখন বেশ পড়ে গেছে, প্রায় লেখাই হয় না, দুয়েকটি দৈনিকের সম্পাদকীয় ছাড়া। আগে ছিল লেখায় সাধু, আর বচনে চলিত। ভাষাতত্ত্বে একেই বলে দ্বিবাচনভঙ্গি বা দ্বিবিধ ভাষারীতি। এই অবস্থাটা অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে আর নেই। সাধু ভাষা নতুন করে আর ব্যবহৃত হয় না। সাধু ভাষা এখন পুরনো সাহিত্যের অঙ্গ। তাই এই দ্বিবাচনভঙ্গির ব্যাপারটা এখন আর আছে বলা বোধ করি চলে না। গ্রিসেও বোধ হয় ব্যাপারটা একই রকম। ১৮২০-এর পর থেকে লেখার ভাষাকে বলা হত কাথারেভুসা বা পরিশীলিত অর্থাৎ সংস্কৃত গ্রিক, আর মুখের বুলি ছিল দিমোতিকি বা দেহাতি অর্থাৎ চলতি গ্রিক। গেল শতাব্দীর সাতের দশকের খানিক পরে মান্য ভাষার তকমা দেওয়াতে দিমোতিকি-ই গ্রিসে এখন মান্য প্রচলিত বুলি।
এখন চলিত বাংলার সময়। ভবিষ্যতে হয়ত নতুন কিছু আসবে। এখনই আঞ্চলিকতা ছাড়াও শহর-নগরে যা বলা হয় এবং যা লেখা হয় তার মধ্যে বেশ ফারাক দেখা যায়। ভাষাতত্ত্বের বুকনিতে এগুলো অ্যাক্রেলেক্ট, মেসোলেক্ট, ব্যাসিলেক্ট (acrolect, mesolect এবং basilect)-এর পর্যায়ে পড়বে। অ্যাক্রোলেক্ট হল শীর্ষভাষা, মান্য চলিত রূপ যা আমরা লিখে থাকি এবং দপ্তর বা আদালতে এবং গণমাধ্যমে ব্যবহারের চেষ্টা করি। শিক্ষিত দুই অঞ্চলের লোকের মাঝেও এর ব্যবহার দেখা যায়, বোঝার সুবিধার জন্য, বিলেতে যেমন একসময় গৃহীত উচ্চারণ (received pronunciation) ব্যবহৃত হত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, খাইয়াছি (সাধু), খেয়েছি (মান্য চলিত, অ্যাক্রোলেক্ট), এবং খাইছি বা খাইসি (মেসো- বা ব্যাসিলেক্ট)। এক্ষেত্রে খাইছু বা খাইসু কিংবা খাউসু হবে আঞ্চলিকতা (ডায়ালেক্ট, dialect)।
মধ্য যুগে আলাওলদের ভাষাই ছিল আদর্শ। পরে ষোলশ' খ্রিস্টাব্দের দিকে ভাষা পালটে সাধু ভাষার রূপ নেয়। সাধু ভাষা হয় সাহিত্যের ভাষা, শিক্ষিতের ভাষা, অনুষ্ঠানের ভাষা। সাধু কথাটির অর্থ সাধারণভাবে এখন পরিশীলিত, মার্জিত বা ভদ্র ধরা হলেও, সেসময় এর অর্থ ছিল বণিক। সমাজভাষা বিশেষজ্ঞ মনসুর মুসার এই মত। অর্থটির দ্যোতনা এখনও ‘সাধু সাবধান’ কথাটির মধ্যে বিদ্যমান। অর্থাৎ সাধু ভাষা ছিল আমির-সাধুদের ভাষা। পরে ইংরেজদের হাতে পরে প্রাকৃত প্রভাব মুক্ত হয়; এবং সংস্কৃত প্রভাব যুক্ত হয়ে তৈরি মান্য সাধু ভাষা, খানিকটা যেন সংস্কৃতের ব্যাসিলেক্ট। ১৮০১ সালে মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের লেখা থেকে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে – ‘এতদরূপে প্রবর্তমান সকল ভাষা হইতে সংস্কৃত ভাষা উত্তমা বহু বর্ণময়ত্ব প্রযুক্ত এক দ্ব্যক্ষর পশুপক্ষি ভাষা হইতে বহুতরাক্ষর মনুষ্য ভাষার মত ইত্যনুমানে সংস্কৃত ভাষা সর্বোত্তমা এই নিশ্চয়।’ সেসময় দ্বিভাষারীতির ব্যাপারটা আমলে নেওয়া যেত। এরও প্রায় একশ বছরের বেশ কিছু সময় পরে, ১৯১৩ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমথ চৌধুরী সাধু ভাষার জায়গায় সাহিত্যে চলিত ভাষা চালানোর চেষ্টা করে। তাই পরে মান্য ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। একই লেখায় সাধু আর চলিতের মিশ্রণকে গুরুচণ্ডালী বলে অভিহিত করা হত, পরীক্ষার খাতায় তো বটেই।
No comments:
Post a Comment