কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২২ সালে ছাপানো শিব রতন মিত্রের পুরনো বাঙলা গদ্যের ধরণ (Types of Early Bengali Prose) বইয়ে দেখা যায় ‘সাহ গোলাম আহম্মদ খাতির জমাতে বাগের সাবিক দস্তুরে ভোগ করিবেন’ কিংবা ‘এখন শ্রীযুক্ত আমিন্দী এক ইঙ্গরেজী সনন্দ হুকুম হয় তবে খাতির জমাতে জমি আবাদ করিয়া শ্রী৺ সেবা পূজা করি।’ পুরনো বাংলা গদ্যের নমুনা, প্রথমটির লিপিকাল বঙ্গাব্দ ১১৭২ বা ইংরেজি ১৭৬৫ সাল, পরেরটির ঠিক বিশ বছর পর। ‘খাতির জমা,’ যদিও বর্তমানে প্রায় সব অভিধানেই ‘খাতিরজমা।’ অর্থ কিন্তু তিন ধরণের পদের মাঝে ঘুরপাক খায়।
জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটি বিশেষ্য হিসেবে নিশ্চয়তা আর বিশেষণ হিসেবে নিশ্চিন্ত, পাশে বন্ধনীস্থ টীকা [এই শব্দ ক্রমে বঙ্গভাষায় ব্যবহারে আসিতেছে]। বাঙ্গালা ভাষার অভিধানের প্রথম প্রকাশ ১৯১৬ সালে! উইলিয়াম কেরির অভিধানেও কিন্তু শব্দটি আছে, বিশেষ্য এবং বিশেষণে; অর্থ আরামপ্রাপ্ত, শান্ত, খুশি, মনের স্থিরতা, সন্তুষ্টি, নিশ্চয়তা। কেরির অভিধান বেরিয়েছিল ১৮২৭ সালে। হরিচরণে বিশেষ্য হিসেবে অর্থ মনের শান্তি বা সুখ বা দৃঢ়বিশ্বাস; উদাহরণ, দাশরথি রায়ের পাঁচালি থেকে ‘ক্ষুদ্র বেটাকে খাতির ক’রে, খাতির জমায় ছিলাম ভুলে।’ রাজশেখরে বিশেষ্য দৃঢ়বিশ্বাস, বিশেষণ নিশ্চিন্ত। বাংলা একাডেমির অভিধানে ক্রিয়া বিশেষণ হিসেবে অর্থ নিশ্চিন্তে, নিরুদ্বেগে; উদাহরণ আবুল মনসুর আহমদ থেকে ‘যান, খাতিরজমা থাকুন গিয়া, কিছুই হইব না’ আর সৈয়দ হামজা থেকে ‘চলিল খাতেরজমা ডর নাহি আর।’ শব্দ সঞ্চয়িতায় বিশেষ্য নির্ভীকতা, নিশ্চিন্তভাব আর বিশেষণ নিশ্চিন্ত, যার উপর নির্ভর করা যায় এমন। ব্যুৎপত্তি সিদ্ধার্থে বিশেষণ আরামপ্রাপ্ত, খুশি, তৃপ্ত; উদাহরণ রাধাকান্তের গসপেল থেকে, ‘থাকিহ খাতিরজমা কাল যায় নাই।’ কাজী আব্দুল ওদুদে বিশেষণ, নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন; উদাহরণ ‘বিরুদ্ধপক্ষ কিছুই করতে পারবে না, আপনি খাতিরজমা থাকুন।’ সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধানে, ক্রিয়া বিশেষণ, নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়, আর উদাহরণ সেই সৈয়দ হামজা থেকে। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে অবশ্য শব্দটিকে ঢাকার বুলি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অর্থ ধীরে সুস্থে, অর্থাৎ ক্রিয়া বিশেষণ। আর কলিকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি’র অবাঙালিদের জন্য আধুনিক বাংলা অভিধান (Modern Bengali Dictionary for Non-Bengali Readers)-এ, যেখানে উচ্চারণ দেওয়া আছে /kʰɑtirdʒɔmɑ/, অর্থ বিশেষ্য হিসেবে নিরুদ্বেগ, নিশ্চিন্ত আর বিশেষণ হিসেবে নিশ্চিন্ত, তৃপ্ত, আত্মস্থ। উইলিয়াম গোল্ডস্যাকেও শব্দটির দেখা মেলে বিশেষ্য এবং বিশেষণ হিসেবে।
খাতিরজমা, বা খ়াত়িরজমা‘, শব্দটি ফারসি خاطرجمع থেকে এসেছে। সব অভিধানের তাই মত। জন শেক্সপিয়ারে খাতির অর্থ হৃদয়, চিত্ত, মন, ঝোঁক, স্মৃতি, বর্ণনা, পক্ষ, ইচ্ছা, ইত্যাদি। বাংলায় খাতির শব্দে এর বেশির ভাগ অর্থই বোঝায়। এই ফারসি খাতির এসেছে আরবি خطر থেকে। আর জমার অর্থ ফারসিতে সমাবেশ, যুক্তি, সংগ্রহ, পরিমাণ, যোগফল, সমগ্র এবং বহুবচন। আলাদা ভাবে এই শব্দও বাংলায় প্রচলিত। এরও আগমন আরবি থেকে। তবে খাতিরজমা পূর্ণাঙ্গ শব্দবন্ধ হিসেবে ফারসিতে বিশেষ্য এবং বিশেষণ। ক্রিয়া বিশেষণ বোধ করি বাংলার অবদান। হিন্দিতেও এই শব্দের দেখা মেলে – खातिरजमा (বানানটা বাংলার মতই), বা ख़ातिरजमा, তবে সাথে বাংলার মত থাকা না হয়ে ক্রিয়াপদটা সাধারণত হয় রখনা (रखना, রাখা)। হিন্দিতে বলে গাঁঠ মেঁ জমা রহে তো খাতির জমা (गाँठ में जमा रहे तो खातिरजमा, পয়সা থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়)। সকালে ‘খাতিরজমা’ ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে গিয়ে অপরিচিত লোকের সাথে ‘খাতির জমানো’ পুরোদস্তুর ভিন্ন জিনিস।
4 comments:
Visit http://www.lalsabuj.com/ for Bangladeshi Web Community.
খ়াত়িরজমা - এখানে খ, ত-য়ের পাশে নোকতা কেন ? এগুলো দিয়ে কি বোঝায় ?
আর আগে কালে কি চন্দ্রবিন্দু অক্ষরের উপরে না লিখে পাশে লেখা হতো ?
- হাসিব, নীড়পাতা.কম ।
http://www.nirpata.com
দারুণ ব্লগতো। আমি বাংলা ভাষার শিক্ষক। ভাষা নিয়ে কাজ করবার ইচ্ছে আছে। বিশেষ করে পূব বাংলার ভাষা ও অসমিয়ার তুলনামূল্ক অধ্যয়ন। আপনার থেকে সাহায্য লাগবে। আপনার ব্লগে ফোলোয়ার গেজেট থাকলে ভাল্লাগতো।এই লেখাটা দেখবেনতোঃ
http://sushantakar40.blogspot.com/2009/08/oxomiya-bhaxar-ek-bisex-prekkhapot.html
হাসিব, এখানে খ এবং ত দুটোর কোনওটাই শুদ্ধ বাংলা খ এবং ত নয়, হরফের এই পরিবর্ধনকে বোঝানোর জন্য এই নুকতা, ফুটকি বা নিম্ন বিন্দু। জ-এর নিচে ফুটকি চালু করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৬-এ। বুদ্ধদেব বসু জ-এর নিচে দুই-ফুটকি চালু করে ফরাসি j(e), ইংরেজি (vi)si(on) কিংবা রুশ ж লেখার জন্য (যদিও রুশ ж আসলে মূর্ধন্য জ় বা z। তবে ১৯৮৫ সালে জন মেন্ডিস নামের এক অভিধানকার জ-এর নিচে দুই-ফুটকি ব্যবহার করেছিল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন-ফুটকি জ-এর জায়গায়।
Post a Comment