Wednesday, October 31, 2007

কেদারা ও চেয়ার এবং মেজ ও টেবিল

কেদারার একলা ভাগ্য বাংলায় তেমন একটা ভাল নয়। শব্দটি পর্তুগিজ কাদেইরা (cadeira) থেকে আগত। পরে ইংরেজির চেয়ার (chair) বেশি প্রাধান্য পায় এবং হয়ত এক সময় কেদারা কথ্য ভাষা থেকে ছিটকে পড়ে। তবে অন্য শব্দের সাথে এর ব্যবহার আগেও ছিল, এখনও আছে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের আরণ্যক-এ আছে 'ঘরে একখানা ভালো ছবি নাই, ভালো বই নাই, ভালো কৌচ-কেদারা দূরের কথা, ভালো তাকিয়া-বালিস-সাজানো বিছানাও নাই।' আর কলকাতার ভূমি নামের একটি দলের গানেও কেদারা পাওয়া যায় আরেকটি শব্দের সাথে, আরাম কেদারা (গান: বারান্দায় রোদ্দুর)। কেদারা একটু অ-বাংলা শোনালেও, আরাম কেদারা ইংরেজি armchair বা easy-chair থেকে অনেক বাংলা।

বাংলায় একই রকম আরেকটি পঙ্‍ক্তিচ্যুত শব্দ হল মেজ। টেবিল, ফারসি ميز থেকে। বাংলা অভিধানে শব্দটি বহাল তবিয়তে আছে, নেই কেবল তার ব্যবহার। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান মতে শব্দটি কুমিল্লার উপভাষায় প্রচলিত; অন্য রূপে, ম্যাজ়। অনেকের মতে শব্দটি পর্তুগিজ (mesa থেকে আগত। তবে বাংলা বেশিরভাগ অভিধানের অঙ্গুলিনির্দেশ ফারসির দিকে। জন টমসন প্ল্যাট‌্স-এর উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি এবং ইংরেজি অভিধানে শব্দটিকে ফারসি হিসেবে দেখানো হয়েছে। ফারসি মেজ এসেছে পহ‌্লবি mīj থেকে যা সংস্কৃত মহ (मह्) এর সমগোত্রীয়। সংস্কৃত শব্দটির অর্থ ভোজ বা বলিদান হলেও ফারসি শব্দটির অর্থ টেবিল। টেবিল, তথা বাসার, কর্তা বলেই মেজবান অর্থ অতিথি সৎকারক। শব্দটি পর্তুগিজ থেকে আগত মনে করার কারণ হয়ত এই যে ভারতবর্ষীয় বা কাছাকাছি অনেক ভাষাতেই পর্তুগিজ শব্দটি ঢুকে গেছে, অনেক ক্ষেত্রে একটু অন্য রূপে। যেহেতু পহ‌্লবিতেও শব্দটি আছে, তাই মধ্য এশিয়ায় ইন্দো-ইরানি কোনও ব্যাপার থেকে থাকতে পারে। ফারসিতে অর্থ টেবিল বা খাবার টেবিল; অতিথিও হয়। হিন্দুস্তানিতে মেজ লগানা (मेज़ लगाना, مير لگانا) বা মেজ বিছানা (मेज़ बिछाना, مير بچهانا) অর্থ টেবিলে খাবার দেওয়া। মেজ-কুর্সী (मेज़-कुर्सी, ميز-كرسى) অর্থ টেবিল-চেয়ার, শব্দ ভিন্ন, তবে ক্রমটা একই। হিন্দুস্তানিতে মেজ শব্দটি প্রচলিত হলেও, বাংলায় টেবিলের জনপ্রিয়তা এবং গ্রাহ্যতা বেশি।

Tuesday, October 30, 2007

লণ্ঠন

বাংলায় লণ্ঠন কথাটি বোধ করি ইংরেজি lanthorn থেকে এসেছে। ইংরেজিতে lantern শব্দটি লাতিন থেকে ফরাসির মাধ্যমে এলেও এক সময় অনেকের ধারণা ছিল শব্দটির ইংরেজি বানান হবে lanthorn, কারণ এটির পাশের ঢাকনা বানাতে শিঙের ব্যবহার করা হত। লোকব্যুৎপত্তির একটি উদাহরণ। ১৬৯৬তে ছাপানো এড্‌ওয়ার্ড ফিলিপ‌্স‌্-এর নতুন বিশ্বের ইংরেজি শব্দাবলি বা সাধারণ অভিধান-এ (The New World of English Words or a General Dictionary) পাওয়া যায় 'magick lanthorn'। ষোলশ' এবং সতেরশ' খ্রিস্টাব্দের দিকে এই বানান ইংল্যান্ডে প্রচলিত ছিল। প্রায় একই সময়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষে আসে। তাই মনে হয় lantern-এর চেয়ে lanthorn থেকেই লণ্ঠন আসার সম্ভাবনা বেশি। আবার নাও হতে পারে, কারণ হিন্দিতে শব্দটি लालटेन (লালটেন) যা lantern-এর কাছাকাছি। Lanthorn বানানটি আমেরিকায়ও প্রচলিত ছিল, ১৫৯০-এর আগে। বাংলাদেশে ব্যবহৃত লণ্ঠনকে বলা হয় hurricane lantern কারণ ঝড়েও এর আলো নিভে যায় না। এর আরেকটি নাম কেরোসিন লণ্ঠন। প্রচলন শুরু হয় ১৮০০ শেষের দিক থেকে।

ইংরেজির তদ্ভব শব্দ বলে বানানে ন্‌ + ঠ হওয়া উচিত। এদিবে আবার বহুদিনের সংস্কার এবং বাংলায় ঠ এর আগে ন যুক্ত না হওয়ার কারণে, ণ্ঠ-ই সই, রুগ্ন-র মত। প্রথমটিতে ধরে নিতে হবে ন, পরেরটিতে ণ, যদিও বানান উলটো।

Monday, October 29, 2007

বাংলায় শব্দসঙ্ক্ষেপন

বাংলায় শব্দসঙ্ক্ষেপনের জন্য একেক জায়গায় একেক কায়দা চোখে পড়ে। কেউ ডাক্তার, সে চিকিৎসকই হোক বা অচিকিৎসক, লেখে ডাঃ, কেউবা ডা. কেউ শুধু ডা (কোনও রকম চিহ্ন ছাড়া); অনেকে আবার চিকিৎসক হলে ডা, অচিকিৎসক হলে ড লেখে। কেউ কেউ ইংরেজির ফুল স্টপের পরিবর্তে কমা ব্যবহারের পক্ষপাতী। আনন্দবাজার পত্রিকার লেখনরীতি বিন্দুকেই প্রাধান্য দিয়েছে, যদিও বলা আছে অনেকে পঃ বঙ্গ লিখে পশ্চিম বঙ্গ বোঝায়।পুরনো দিন থেকে বাংলায় শব্দ সঙ্ক্ষেপনের জন্য হয় অনুস্বার (‍ঃ) নয় বিসর্গ (‍ং) ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অনেক পুরনো বাংলা দলিলপত্রে দেখা যায় ইং (ইংরেজি), কাং (কাছারি), গুঃ (গুজরত, মারফত), পঃ (পরগনা), ইত্যাদি। এখনও দেখা মেলে কোং (কোম্পানি), গং (গয়রহ), তাং (তারিখ), নং (নম্বর), বা মোঃ (মোহাম্মদ), মোসাঃ (মোসাম্মত), আঃ (আব্দুল), রেজিঃ (রেজিস্ট্রেশন), ইত্যাদি। যারা নামের শব্দ সঙ্ক্ষেপের জন্য ইংরেজির ফুল স্টপের ব্যবহার করে তাদেরই লেখায় আবার পাওয়া যায় কোং, তাং, নং, ইত্যাদি। এদের কেউই আবার ন. (নম্বর), মো. (মোহাম্মদ), তা. (তারিখ) ইত্যাদি লেখে না, যদিও লেখে ড. বা ডা.। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে পুরনো বাংলার অনুস্বারের আদলে একটি ছোট বৃত্ত, তবে মাত্রার বেশ নিচে, ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন,বা৹। রাজশেখর বসুর চলন্তিকায় দেখা যায় বিঃ অর্থ বিশেষ। চলন্তিকায় অবশ্য তু. বলতে তুর্কি শব্দ আর তুঃ বলতে তুলনীয় বোঝানো হয়েছে।

Saturday, October 27, 2007

বাংলার রোমক বর্ণমালার আরও কিছু কথা

রোমক হরফে বাংলা লেখার কায়দা ঠিক করার সময় আরও কিছু ব্যাপার আলোচনা করা হয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত 'আমাস ১৫৯১৯: দেবনাগরী এবং সম্পর্কিত ইন্দীয় লেখার লাতিন হরফে প্রতিবর্ণীকরণ' পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। তবে একটা খসড়া দাঁড় করানো হয়েছিল, বাংলা হরফে বিদেশি ধ্বনি, বিশেষত আরবি-ফারসি, লেখার জন্য। যেমন, s̱ (ث) _s, h̤ (ح) ,h, ḵ‍ẖ (خ) _kh, ẕ (ذ) _z, z (ز) z, ž (ژ) ^z, s̤ (ص) ,s, ż (ض) ;z, t̤ (ط) ,t, ẓ (ظ) .z, ‘ (ع) `, ġ (غ) ^g, f (ف) f, q (ق) q, এবং w (و) w। বন্ধনীর আগে ছাপানোর জন্য, বন্ধনীর মাঝে আরবি-ফারসি এবং বন্ধনীর পরে ASCII চিহ্ন দেওয়া হল। বাংলা হরফের সাথে বিভিন্ন সময়ে এবং বইয়ে বিভিন্ন বর্ণাশ্রয়ী চিহ্নের ব্যবহার করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি নিম্ন-বিন্দু বা পার্শ্ব-বিন্দুই নিয়ম। অন্ততপক্ষে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, নিম্ন-বিন্দু দিতে হবে, যেমন স়, হ়, খ়, জ়, জ়, ঝ় (জ̤), স়, দ় (ধ়), ত়, জ়, ‘অ, গ় (ঘ়), ফ়, ক় এবং ব় (ৱ); নিম্ন-বিন্দু না দেওয়া গেলে পার্শ্ব-বিন্দু দিতে হবে, যেমন ক., খ., বা গ.। কোথাও বা বিন্দুটি মাত্রার ঠিক পাশে বা উপরে বসানো হয়। তারপরেও যেহেতু একই পদ্ধতির মধ্যে একটাই কেবল নিয়ম থাকা উচিত, তাই যেকোনও একটি চিহ্নের ব্যবহার করলেই চলবে। বিন্দু দিয়ে হরফের পরিবর্ধন ইন্দীয় অন্যান্য ভাষাতেও আছে। তবে পুরো ব্যাপারটি কিন্তু বিশেষায়িত কাজের জন্য, আমজনতার লেখার জন্য নয়। জ্ঞানের যেমন ভার আছে, ঝামেলাও তেমনই বেশি।

Friday, October 26, 2007

বাংলার নুকতা

বাংলায় নুকতার ব্যবহার ইউনিকোডের অবদান, যদিও এই নুকতা (অভিধানে বা গবেষণা গ্রন্হে হয়ত নুক়ত়া লেখা উচিত কারণ আরবি, ফারসি বা উর্দুতে উচ্চারণ ভিন্ন হলেও, শব্দটির বানান نقطه, অর্থ, বিন্দু; ইংরেজিতে nuqta বা আরও শুদ্ধ করে nuḳt̤a বা nuqt̤a লেখা উচিত হলেও সাধারণত লেখা হয় nukta) ছাপায় দেখতে পাওয়া যায় অনেক দিন থেকেই। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, রাজশেখর বসুর চলন্তিকা, বা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় এই নুকতার ব্যবহার হয়ে আসছিল, কেবল এর নাম ছিল বিন্দু — পার্শ্ব বা নিম্ন। ইউনিকোডের ওপর ভারতীয় লিপির উপাত্ত বিনিময় নিয়মের (Indian Script Code for Information Interchange) প্রভাবে এর নাম বাংলা থেকে আরবি বা ফারসি হয়ে গেছে। এই নুকতার কারণে ইউনিকোডে তিনটি বাংলা হরফ লেখায় বিকল্প চালু হয়েছে — য়, ড় এবং ঢ়। এককভাবে লেখা ছাড়াও য, ড এবং ঢ এর সাথে নুকতা যোগ করেও লেখা যায়। এতে একটি ছোট অসুবিধা হয় বই কি। জানা না থাকলে কিংবা একই লেখায় দুই ধরণের হরফ থাকলে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। দুই নুকতা বা দ্বি-বিন্দুর উদাহরণও বাংলার ছাপায় পাওয়া যায়, যদিও ইউনিকোড সাধারণভাবে বাংলা লেখার নিয়মে তা পাওয়া যায় না। বাংলায় ফরাসি বা রুশ সাহিত্যের অনুবাদে ফরাসি j(e)-ধ্বনি, যা ইংরেজির (vi)s(ion)-ধ্বনিতুল্য, বা রুশ ж-ধ্বনি, যা ইংরেজিতে zh দিয়ে লেখা হয়, লেখার জন্য জ-এর নিচে দুই বিন্দুর ব্যবহার করা হয়। আদতে ফরাসি ধ্বনি (/ʒ/) এবং রুশ ধ্বনি (/ʐ/) এক না হলেও ইংরেজিতে একই ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ করা হয় বলে বাংলায়ও একই হরফের ব্যবহার করা হয় (ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনায় বোধ করি পার্থক্যটা বজায় রাখা উচিত)। ইউনিকোডে জ-এ দ্বি-বিন্দু লিখতে হলে জ-এর সাথে ব্যবহার করতে হবে যে ইউনিকোড ক্যারেক্টার তার নাম Combining Diaresis Below (̤) — জ̤।

বিন্দু ছাড়া আরও একটি অর্থে নুকতা শব্দের ব্যবহার অন্তত কথ্য বাংলায় দেখা যায় — নুকতা দিয়ে বলা, অর্থ জোর দিয়ে বলা। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে বা বাংলা একাডেমীর আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে এই অর্থটি নেই। হিন্দুস্তানিতে পাওয়া যায় নুকতা লগানা (नुकता लगाना, نقطه لگانا), অর্থ, গালাগালি করা, দোষ দেওয়া, দোষারোপ করা।

Thursday, October 25, 2007

বাংলায় বর্মি শব্দ

বাংলা ভাষায় বর্মি শব্দ কুল্লে দুই — লুঙ্গি আর ফুঙ্গি। প্রথমটির দেখা মেলে ঘরের বের হলেই, বিশেষ করে বাংলাদেশে। দ্বিতীয়টি কেবল অভিধানে আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতায় (আরও গোটাকতেক জায়গায় পাওয়া সম্ভব, ইতিহাস, ভূগোল বা ভ্রমণ কাহিনির বইয়ে)।

লুঙ্গি শব্দটি বর্মিতে လိုဈည္, রোমক হরফে longyi, উচ্চারণ /lòuɲdʒì/। বাংলার উচ্চারণ থেকে একটু আলাদা, তবে স্বগোত্রীয বলে চেনা যায়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসে শব্দটি বর্মি, তবে অভিধানটিতে ব্যুৎপত্তির জায়গায় সাথে ফারসি লুঙ্গি শব্দটি দেওয়া আছে। হিন্দিতে लुंगी, আর উর্দুতে لنگى। শব্দটি ফারসিতেও পাওয়া যায়, لنگی হিসেবেই। Chamber's-এ পাওয়া যায়, lungi, হিন্দি এবং ফারসি থেকে, অর্থ, নিম্নদেশে বা মাথায় পরিধেয় কাপড়। Concise Oxford Dictionary-তেও lungi, উর্দু থেকে, অর্থ, নিম্নদেশে পরিধেয় কাপড়। বাংলায় বাঙ্গালি পুরুষের নিম্নদেশে পরিধেয় বস্ত্র হলেও, ফারসিতে একসময় তা পাগড়ির কাপড়কেও বোঝাত। জন টমসন প্ল্যাট‌্স-এর উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি এবং ইংরেজি অভিধানের মতে মুসলমানদের ধুতি বা লাঙ্গ হিসেবে পরার জন্য রঙিন কাপড়, বা মাথার পাগড়ির জন্য চেক বা সোনালি কাপড়। শব্দটি ব্যুৎপন্ন হিন্দি লাঙ্গ (लांग) থেকে যার অর্থ পায়ের ভাঁজে পরার জন্য এক ধরণের ধুতি। জন শেক্সপিয়ারের হিন্দুস্তানি ও ইংরেজি অভিধানে অর্থ লাঙ্গ হিসেবে পরার জন্য এক ধরণের রঙিন কাপড়। জোসেফ ফ্রান্সিস স্টেইনগ্লাসের ১৮৯২ সালে ছাপানো ফারসি-ইংরেজি অভিধানের অর্থ, এক ধরণের কাপড় যা কোমরে দু'পায়ের মাঝখান দিয়ে পরতে হয়। হেনরি ইউল-এর ১৯০৩ সালে ছাপানো হবসন-জবসন-এ longhee, ব্যুৎপত্তি, হিন্দি লুঙ্গী < ফারসি লুঙ্গ বা লাঙ্গ, লুঙ্গী, অর্থ, গায়ে পেঁচিয়ে পরার কাপড়, ফরাসিরা যাকে pagne বলে, অর্থাৎ নিম্নদেশে এক বা দুইবার পেঁচিয়ে কোমরে গুঁজে দেওয়া। এ অভিধানেও লুঙ্গি বলতে পাগড়ির কাপড়কেও বোঝানো হয়েছে। এতকিছুর অর্থ হল, লুঙ্গি শব্দটি ফারসি থেকে হিন্দির মাধ্যমে বাংলায় ব্যুৎপন্ন হলেও হতে পারে। আবার তা না হলেও, ফারসি এবং হিন্দি শব্দের বানান এবং অর্থে যথেষ্ট প্রভাবিত বর্মি থেকে আগত এই লুঙ্গি শব্দটি।

দু'পায়ের ভাঁজে কোমরে পেঁচিয়ে পরার কাপড় অর্থে ফারসি আরেকটি শব্দ বাংলায় বিদ্যমান, যদিও এর দেখা মেলে বাংলার উপভাষায় — তবন, তহবন, তফন, তঅমান, ইত্যাদি বানানে। ফারসি তহ্-বন্দ্‌ (ته بند), তহ্‌ অর্থ নিম্নদেশ, আর বন্দ্‌ অর্থ যা পেঁচিয়ে পরা যায়, ইংরেজিতে loin cloth, অর্থাৎ লুঙ্গি।

ফুঙ্গির দেখা মেলে না সহজে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'শ্মশান-শয্যায় আচার্য্য হরিনাথ দে' কবিতার দ্বিতীয় স্তবকটি এ রকম —

একটি চিতায় পুড়ছে আজি আচার্য্য আর পুড়ছে লামা,
প্রোফেসার আর পুড়ছে ফুঙি, পুড়ছে শমস্‌-উল্‌-উলামা।
পুড়ছে ভট্ট সঙ্গে তারি মৌলবী সে যাচ্ছে পুড়ে,
ত্রিশটি ভাষার বাসাটি হায় ভস্ম হ'য়ে যাচ্ছে উড়ে।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে পাওয়া যায় ফুঙ্গি (-ঙ্গী) এসেছে বর্মি ফুঙ্গি থেকে, অর্থ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। চট্টলাদির উচ্চারণে শব্দটি দাঁড়ায় পুঙ্গি বা পুঙি-তে। গ্রাম্য উদাহরণ, পুঙির পুত, সন্ন্যাসীর পুত্র, জারজ অর্থে। সাধু বর্মি শব্দের বাংলা তদ্ভব গালি, অর্থ ও বানানে।

Tuesday, October 23, 2007

বাংলা-ইংরেজির ইয়ার-বক্সি

বাংলায় যাকে সমার্থক দ্বন্দ্ব সমাস এবং ইংরেজিতে (near-synonym) idiomatic binomials বা binomial idioms বলা হয় সেগুলোর গঠনে বেশ একটি মিল দেখতে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দু' ভাষাতেই শব্দ দুটির একটি এক ভাষার আরেকটি অন্য ভাষার। বাংলার ক্ষেত্রে হাট-বাজার (বাংলা-ফারসি); ইংরেজিতে home and hearth (দেশি ইংরেজি-নর্‌মান)। উদাহরণ আরও আছে: শাক-সবজি, দান-খয়রাত, দুখ-দরদ, ফাঁড়া-গর্দিশ, মান-ইজ্জত, লজ্জা-শরম, ভাই-বেরাদর, দেশ-মুল্লুক, ধন-দৌলত, রাজা-বাদশা, ঝড়-তুফান, হাসি-খুশি, মায়া-মহব্বত, জন্তু-জানোয়ার, সীমা-সরহদ, এবং খাতির-যত্ন। ইংরেজিতে: meek and humble, odd and strange, meet and proper, nook and corner, sorrow and grief, moil and toil, whims and caprices, weeds and brambles এবং kith and kin। আধুনিক বাংলায় বেশ কিছু শব্দ এরকম বাংলা আর ইংরেজি মিলে হয়েছে: উকিল-ব্যারিস্টার, বিড়ি-সিগারেট, ফ্ল্যাট-বাড়ি, এবং ডল-পুতুল। ইংরেজির time and tide এর সাথে wait হবে না waits হবে এ নিয়ে জেরবার থাকে বাংলা দেশের অনেক ছাত্রই। অনেকেরই (শিক্ষকদেরও) ধারণা এর অর্থ সময় এবং স্রোত, তাই সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না, অতএব wait। এদিকে ইংরেজি ব্যাকরণেই বলছে এরকম ক্ষেত্রে যদি যুগ্ম শব্দ একই বস্তু বা বিষয় বোঝায় তবে waits-ই হবে, অর্থাৎ প্রথমপুরুষে একবচন, ক্রিয়ার জন্য। ইংরেজিতে যে সময়ে এই শব্দ গুচ্ছ চালু হয় তখন tide বলতে সময়ই বোঝাত। শব্দটি পুরনো ইংরেজি tíd থেকে ব্যুৎপন্ন। প্রায় একই সময়ের ইংরেজিতে পাওয়া যায়, Fast falls the eventide (দ্রুত নামিছে সন্ধ্যা, বা সান্ধ্যকাল) — Henry Francis Lyte-এর 'Abide with Me' প্রার্থনা সঙ্গীতের শুরুর পঙ্‌ক্তি। অতএব, এ ক্ষেত্রে Time and tide waits for none

Monday, October 15, 2007

ফারসি শব্দের বাংলা তদ্ভব

বাংলায় সাধারণত বলা হয় কুকুর, বেড়াল বা হরিণ, আর স্ত্রীলিঙ্গ মাদি (মাদী কি লেখা উচিত, ফারসি তৎসমের বাংলা তদ্ভব, দীর্ঘ-স্বর পরিহার্য) কুকুর, মাদি বেড়াল আর মাদি হরিণ। পুরুষলিঙ্গে কখনও কখনও মদ্দা কথাটির ব্যবহার দেখা যায়, যেমন মদ্দা পশু, তবে বিরল। বাংলায় (সাধারণত) পশুর স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ মাদি এবং এই শব্দের ব্যবহার না করলেই তা পুরুষ প্রাণীটিকে বোঝাবে। এই মাদি (যদিও মাদী বেশি প্রচলিত, একে বিদেশি, তায় তার তদ্ভব, ই-কারই হওয়া উচিত) শব্দটি বাংলার অবদান, ফারসি মাদা (নারী) থেকে। ফারসিতে নর মানে পুরুষ, আর মাদা মানে নারী, যেমন, شير نر (শের নর, সিংহ) আর شير مده (শের মাদা, সিংহী)। হিন্দি এবং উর্দুতে নারী-পুরুষ অর্থে নর-মাদা দেখা যায়, যেমন नर-मादा का समागम (নর-মাদা কা সমাগম, নারী-পুরুষের সমাগম)।

Sunday, October 14, 2007

সংস্কৃতর লেবাসে তদ্ভব, বা বিদেশি, শব্দ

বাংলায় বেশ কটি শব্দ আছে আপাতদৃষ্টিতে যাদের সংস্কৃত না বলে ভাববার কোনও কারণ নেই। যেমন, রাণী (আধুনিক বানানে রানি), কাহিনী (কাহিনি), ভিখারিণী (ভিখারিনি), রূপসী (রূপসি) ইত্যাদি। বানানের নতুন নিয়ম মানতে গিয়ে বেশির ভাগ লোকই হিমশিম খেয়েছে এই সব শব্দ থেকে ঈ-কার পাল্টে ই-কার করতে গিয়ে; আর প্রায় সবাই একবার না একবার চিন্তা করেছে ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে কি না তা নিয়ে, যদিও এখন অনেকেই, বিশেষকরে পশ্চিম বঙ্গে, অবলীলায় ই-কার ব্যবহার করে। এবং সেটিই হওয়া উচিত। রানি শব্দটি ব্যুৎপন্ন হয়েছে রাজ্ঞী থেকে: রাজ্ঞী বা রাজনী> রণ্‌ণী > রানী > রানি। সংস্কৃত ব্যকরণের নিয়ম অনুযায়ী র-এর পরে মূর্ধন্য ণ ব্যবহারের নিয়ম, তাছাড়া অপভ্রংশে যেহেতু ণ তাই ব্যুৎপত্তির বিচারে মূর্ধন্য ণ-ই স্বাভাবিক। তবে বাংলা বানানের নিয়মে বলা আছে যে ণত্ব-বিধান কেবল তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে খাটে। এই ণ অনেক আগেই দন্ত্য ন-এ পরিণত হয়েছে। বেশ কিছু কাল ধরে অনেকে ঈ-কার পাল্টে ই-কারে এসেছে। বাংলা বানানের নিয়মেই: তৎসম শব্দে দীর্ঘ স্বর থাকলে তদ্ভব শব্দে দীর্ঘ এবং হ্রস্ব দুয়ের বিধান, তবে হ্রস্ব স্বর হলে বানানটা আধুনিক হয়। তাছাড়া নিয়মে বলা আছে কেবল তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে স্বরের দীর্ঘত্ব বা হ্রস্বত্ব রক্ষিত হবে। একইভাবে অর্বাচীন সংস্কৃত কথানিকা থেকে আগত কাহিনি তার স্বরের দীর্ঘত্ব হারিয়েছে: কথানিকা > অপভ্রংশ কহানিয়া > বাংলা কাহিনি। সংস্কৃত রূপস্‌ থেকে পুরুষ বিশেষণ রূপবান, স্ত্রী বিশেষণ রূপীয়সী। রূপসি শব্দটি পুরোপুরি বাংলার অবদান, আধুনিক বানানটিও তাই রুপসি হওয়া উচিত। প্রথমে -সী থেকে -সি হয়েছে। রূ- অনেকের জন্য রু- এখনও হয় নি, কারণটা সম্ভবত রূপসী রুপসি হলে তার সাথে রূপের সম্পর্কটি আর থাকে না। তবে সেটিও হয়ত হয় যাবে। নয়ত সংস্কৃত রূপ + বাংলা -সি ধরে নিতে হবে। সংস্কৃত ভিক্ষার্থী থেকে ভিখারী (সংস্কৃতের ক্ষ তদ্ভবে প্রায়ই খ এবং মূলের দীর্ঘস্বর পুরনো বানানে দীর্ঘই থেকে গেছে)। আধুনিক বানানটি ভিখারি হলেই ভাল। সে থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে স্ত্রীলিঙ্গে ভিখারিণী। আধুনিক বানানটি ভিখারিনি।

বাংলায় সংস্কৃতরূপী আরবি শব্দের মধ্যে নামকরা হল মফস্বল (বর্ণান্তরে মফঃস্বল বা মপস্বল) এবং মোক্ষম। প্রথমটির ক্ষেত্রে শব্দটি আরবি (مفصل, মফস্‌সল), তবে অর্থটি একান্তই ভারতবর্ষীয়। আর দ্বিতীয়টি পুরোপুরি আরবি (محكم, মহ্‌কম), বানানটি কেবল সংস্কৃত। পুরনো দিনে (পুথিতেও হামেশা দেখা যায়) হরফ দ্বিত্বে ব-ফলা বা বিসর্গের ব্যবহার, শব্দটি সেকারণেই মফস্বল। তবে আধুনিক কালে লেখা হয় মফস্‌সল। আরবিতে শব্দটির অর্থ স্পষ্ট, পরিপূর্ণ, বিশদ, ইত্যাদি। জন টমসন প্ল্যাট্‌স-এর ১৮৮৪-সালে ছাপানো উর্দু, ধ্রুপদী হিন্দি ও ইংরেজি অভিধান মতে একটি সদর এলাকা ছাড়া জেলার আর সব এলাকাকে বোঝায়; শহর ছেড়ে প্রামাঞ্চল, ইত্যাদি। অন্য অর্থের ব্যবহারও অভিধানটিতে আছে: মুফস্‌সল কহনা বা মুফস্‌সল বয়ান করনা, অর্থ বিশদভাবে বলা বা বর্ণনা করা। ১৮৩৪ সালে ছাপানো জন শেক্সস্পিয়ারের হিন্দুস্তানি এবং ইংরেজি অভিধানের মতে গ্রামাঞ্চল অর্থটি ভারতবর্ষের অবদান (peculiar to India)। শব্দটি আধুনিক হিন্দিতে আছে (मुफस्सल), উর্দুতেও (مفصل)। ১৯০৩ সালের হবসন-জবসনে শব্দটি আছে, mofussil বানানে। সংসদেও তাই। Chamber's Twentieth Century Dictionary-তেও একই বানানে। হবসন-জবসনের অর্থ 'জেলার সদর বা প্রধান এলাকা বাদ দিয়ে গ্রামাঞ্চল' সব জায়গাতেই বিদ্যমান। মফস্‌সল বানানটির পরিবর্তন ঘটলেও, মোক্ষম এতটাই বাংলা (নাকি সংস্কৃত)যে এটার পরিবর্তন বোধ করি সম্ভব নয়।

Friday, October 12, 2007

(পঁচিশে মার্চের) কালরাত

চারপাশে প্রায়ই শোনা যায় (পঁচিশে মার্চের) কালোরাত (আদতে বানানটি 'কালরাত,' ও-কারটি উচ্চারণ বোঝানোর জন্য দেওয়া)। এই উচ্চারণটি শোনা যায় রেডিও বা টেলিভিশনেও। যারা কালোরাত উচ্চারণ করে তারা ভুলে যায় যে বাংলায় কয়েকটি একই বানানের কাল শব্দের মাঝে একটির অর্থ যম, মৃত্যু, সর্বসংহারক ইত্যাদি, আর অন্য একটির অর্থ কৃষ্ণবর্ণ। প্রথমটির উচ্চারণ কাল্ এবং দ্বিতীয়টির কালো। আর বাংলায় কালরাত শব্দটি এসেছে সংস্কৃত কালরাত্রি থেকে যেখানে যম, মৃত্যু বা সর্বনাশ অর্থটি বিদ্যমান। মৃত্যুর রাত, বা ভয়ানক রাত অর্থে, যদিও রাত সাধারণত কৃষ্ণবর্ণের হয়। মনিয়ের মনিয়ের-উইলিয়ামস্‌-এর সংস্কৃত অভিধানে 'কালরাত্রি'র সংজ্ঞা দেওয়া আছে the night of all-destroying time। কৃষ্ণবর্ণের সাথে বা কোকিলের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালায় উচ্চারণটি /kɑlrɑt̪/, /kɑlorɑt̪/ নয়।

Wednesday, October 10, 2007

দেবনাগরী হরফে বাংলা

দেবনাগরী হরফে দুইভাবে বাংলা লেখা হয়। এক, হিন্দির উচ্চারণের নিয়ম মেনে, যেমন पथेर पांचाली (পথের পাঁচালী, पथ का गीत); আরেক, বর্ণের প্রতিবর্ণ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে, যেমন तव शुभ नामे जागे / तव शुभ आशिष मागे / गाहे तव जय गाथा (তব শুভ নামে জাগে / তব শুভ আশিস মাগে / গাহে তব জয়গাথা)। প্রথম পদ্ধতির ব্যবহার পত্রপত্রিকায় হরহামেশা দেখা যায়। তবে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ভারত থেকে বেশ কিছু বাংলা বই ছেপে বেরিয়েছে, ভারতবর্ষের অন্য ভাষী যারা বাংলা বোঝে বা বলতে পারে কিন্তু পড়তে বা লিখতে পারে না তাদের জন্য। যেমনটি হয়েছে ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের বেলায়। গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। লেখা বাংলায় হলেও ভারতের অন্য ভাষীলোকেদের জন্য সেটি লেখা হয় দেবনাগরী হরফে এবং গাওয়া হয় হিন্দি উচ্চারণের নিয়ম মেনে। তবে বাংলা থেকে হিন্দিতে প্রতিবর্ণীকরণের জন্য তিনটি দেবনাগরী হরফের পরিবর্তন করতে হয়েছে: य़ (য), ड़ (ড়), এবং ढ़ (ঢ়)। শেষের দুটি হরফ হিন্দিতে কৃতঋণ শব্দে ব্যবহারের জন্য হলেও, প্রথমটি ব্যবহৃত হয় বাংলা লেখার জন্য। ধরা হয় য-(ẏ)-य़ আর য়-(y)-य। আমাস ১৫৯১৯-তে কিন্তু রোমক,এমনকি দেবনাগরী, প্রতিবর্ণগুলো উল্টো: য-(y)-य এবং য়-(ẏ)-य़।

Saturday, October 06, 2007

উপভাষার লেখন

বার্নার্ড শ-এর পিগম্যালিঅন নাটকে প্রফেসর হিগিন্সকে দেখা যায় একটি খাতা থেকে পড়ছে — Cheer ap, Keptin; n' baw ya flahr orf a pore gel. লন্ডনের কক্‌নি ইংরেজিতে ফুলওয়ালির বলা কথা। আন্তর্জাতিক ধ্বনিমাত্রিক বর্ণমালা ছাড়া আসল উচ্চারণ বোঝানো দায়। তাই মান্য লেখ্য রীতি বেশ খানিকটা এদিক ওদিক করে সাধারণ বোধগম্যতার মধ্যে রেখে কক্‌নি ইংরেজির ধরণ বোঝানো হয়েছে। হার্পার লি'র To Kill a Mocking Bird-এ পাওয়া যায়: Mr. Nathan put cement in that tree, Atticus, an' he did it to stop us findin' things-he's crazy, I reckon, like they say, but Atticus, I sweat to God he ain't ever harmed us, he ain't ever hurt us, he coulda cut my throat from ear to ear that night but he tried to mend my pants instead.... তেমনটি আছে চালর্স ডিকেন্স কিংবা মার্ক টোয়েনে। সাহিত্যে উপভাষা বা লোকভাষা উঠে আসবেই। সব ভাষার সাহিত্যেই হয়। বাংলায়ও, হামেশাই। শওকত আলীর (হাতের কাছে আছে বলে, বিশেষ কোনও কারণ নেই) উত্তরের খেপ-এ পাওয়া যায় — 'আইবো, সাতটা বাজলেই আইয়া পড়বো। চিন্তা নাই। ... ওস্তাদ, একটা কথা কমু?' এ রকমটি পাওয়া যাবে মানিক বন্দ্যেপাধ্যায়, পরশুরাম (রাজশেখর বসু), তারাশঙ্কর বন্দ্যেপাধ্যায় থেকে শুরু করে হাল আমলের অনেকেরই লেখায়। সাহিত্যে কোনও একভাবে উচ্চারণের কাছাকাছি লিখেই পার পাওয়া যায়। যার ওই ভাষার সাথে পরিচিতি আছে সেই কেবল স্বাদটা নিতে পারে, বাকি সবাই কল্পনার রং মিশিয়ে নিজেদের মত বুঝে নেয়। এ ধরণের উপভাষার লেখন থেকে ভাষার উচ্চারণের প্রকৃতি বোঝা যায় না। কারণ উপভাষা কিভাবে লেখা হবে তার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। 'জোর' লিখলে বোঝা যায় না এটা জোর, যেমনটি দিনাজপুরের ভাষায়, নাকি জ়োর, যেমনটি বরিশালের ভাষায় বলা হয়, ইংরেজির z-এর মত করে। বাংলা একাডেমীর ফরমায়েশ অনুসারে য হরফটি দিয়ে ইংরেজির z বোঝানোর ব্যাপারটি অনেকেই মানে না। যুক্তিও দূর্বল। কারণ সেই য-ই তৎসম এবং তদ্ভব শব্দে ইংরেজির -ধ্বনির প্রতীক, আবার আরবি-ফারসি শব্দে ইংরেজির -ধ্বনির প্রতীক। একটু গোলমেলে ঠেকে। ইউনিকোডের জগতে বোধ করি জ-নিম্নবিন্দু (জ়) জায়গা করে নেবে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসেও একই রকম ব্যবহার। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতও প্রায় একই রকম। আর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাসহ যে কোনও প্রকাশনাতেই এই বিন্দুর ব্যবহার করে আসছে। তাই বোধ করি পরশুরামের গড্ডালিকায় পাওয়া যায় — 'অয়, অয়, z‍ানতি পার না।' এই অয়-এ শুরুতে জিহ্বামূলীয় স্পর্শ ধ্বনি (glottal stop) আছে কি না তা কিন্তু দেখানো হচ্ছে না, অথচ বাংলার অনেক উপভাষায় এর বিদ্যমানতা পরিলক্ষিত। শুদ্ধ বাংলার এ-ধ্বনি এ-র মতই, তবে ধ্বনিটি সিলেটের দিকে গেলেই, ভাষাতত্ত্বের ভাষায় একটু নিচের দিকে নেমে যায় — এ-ধ্বনি এবং অ্যা-ধ্বনির মাঝামাঝি। মেদিনিপুরের বাংলায়ও এই ধ্বনি বিদ্যমান। ফরাসি-জার্মানে ধ্বনিটি আছে। মার্কিনিদের ইংরেজি বুলিতেও আছে। ইংল্যান্ডে গৃহীত উচ্চারণ (Received Pronunciation) বলতে যা বোঝায়, তাতে এই ধ্বনি নেই। ভাষাতাত্ত্ববিদরা অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা বা এই বর্ণমালার কিছু হরফ ইংরেজির হরফের সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করে।