এলাকাভেদে বর্ণমালার পঠনও ভিন্ন। অনেকে বাচ্চাদের মনে রাখার সুবিধার জন্য দ না ব'লে বলে হাঁটু-ভাঙ্গা দ কিংবা মূর্ধন্য ষ না ব'লে বলে পেট-কাটা মুর্ধন্য ষ। ক-এ ষ যুক্ত অনেক জায়গায় পুরনো রীতি অনুযায়ী ক্ষিয়; অনেকের কাছে ঙ হল উম্অ আর ঞ হল নিয়্অ। তবে বাংলার বর্ণমালার স্বরবর্ণের প্রথম দুই হরফের নাম নিয়ে বেশ মতভেদ আছে। সাধারণ ভাবে এগুলো স্বরে অ বা স্বরে আ; অন্তত ছোটদের তাই শেখানো হয়। ফারসি বা উর্দুর নিয়মে স্বর-এ-অ আ স্বর-এ-আ কিন্তু নয়। তাই ধারণা করা হয় ‘স্বরের অ’ এবং ‘স্বরের আ’-র বিকৃত রূপ স্বরে অ এবং আ। কেবল অ এবং আ বললেই চলে যদিও।
স্বর হরফ সাথে উচ্চারণ: অ বা স্বরের অ (/ɔ/ বা /ʃɔrer ɔ/); আ বা স্বরের আ (/ɑ/ বা /ʃɔrer ɑ/); হ্রস্ব ই (/rɔʃːo i/); দীর্ঘ ঈ (/dirgʱo i/); হ্রস্ব উ (/rɔʃːo u/); দীর্ঘ ঊ (/dirgʱo u/); ঋ (/ri/); ঌ (/li/); এ (/e/); ঐ (/oi/); ও (/o/); এবং ঔ (/ou/)। আর ব্যঞ্জন হরফ: ক (/kɔ/); খ (/kʰɔ/); গ (/gɔ/); ঘ (/gʱɔ/); ঙ (/uɔ̃/ বা /ũɔ̃/); চ (/tʃɔ/); ছ (/tʃʰɔ/); বর্গীয় বা বর্গ্য জ (/borgio/ বা /bɔrgo dʒɔ/); ঝ (/dʒʱɔ/); ঞ (/iɔ̃/ বা /ɪ̃ɔ̃/); ট (/ʈɔ/); ঠ (/ʈʰɔ/); ড (/ɖɔ/); ঢ (/ɖʱɔ/); মূর্ধন্য ণ (/murd̪ʱonːo nɔ/); ত (/t̪ɔ/); থ (/t̪ʰɔ/); দ (/d̪ɔ/); ধ (/d̪ʱɔ/); দন্ত্য ন (/d̪ɔnt̪o nɔ/); প (/pɔ/); ফ (/pʰɔ/); বর্গীয় বা বর্গ্য ব (/borgio/ বা /bɔrgo bɔ/); ভ (/bʱɔ/); ম (/mɔ/); অন্তঃস্থ য (/ ɔnt̪ɔst̪ʰo dʒɔ/); র (/rɔ/); ল (/lɔ/); তালব্য শ (/t̪ɑlobːo ʃɔ/); মূর্ধন্য ষ (/murd̪ʱonːo ʃɔ/); দন্ত্য স (/d̪ɔnt̪o ʃɔ/); হ (/ɦɔ/); ড-এ শূন্য বা বিন্দু ড় (/ɖɔ-e ʃunːo/ বা /bind̪u ɽɔ/); ঢ-এ শূন্য বা বিন্দু ঢ় (/ɖʱɔ-e ʃunːo/ বা /bind̪u ɽʱɔ/); অন্তঃস্থ য় (/ɔnt̪ɔst̪ʰo ɔ/); খণ্ড ত (/kʰɔnɖo tɔ/); ং-অনু্স্বার (/onuʃːɑr/); ঃ-বিসর্গ (/biʃɔrgo/); এবং ঁ-চন্দ্রবিন্দু (/tʃɔnd̪robind̪u/)।
অনেকে আবার ড় থেকে পৃথক করার জন্য র কে ব-এ শূন্য বা বিন্দু র বলে। স্বরের বর্ণাশ্রয়ী চিহ্নগুলোকে কার বলা হয়, যেমন, আ-কার, হ্রস্ব ই-কার, ইত্যাদি। বর্ণপূর্ব বর্ণাশ্রয়ী র-কে রেফ এবং আরও বেশ কিছু উত্তর-বর্ণাশ্রয়ী ব্যঞ্জনের নাম ফলা, যেমন, ন-ফলা, ল-ফলা, ব-ফলা, ইত্যাদি। ক-এ ষ যুক্ত হরফের নাম যুক্ত খ। বঙ্গহরফে সংস্কুত লিখতে গেলে আধা মাত্রার হ-এর মত দেখতে একটি হরফের ব্যবহার করতে হয়, ঽ। হরফটির দেখা মেলে পুরনো সাধু বাংলায়ও, যেমন ততোঽধিক। এর নাম অবগ্রহ, হরফের নিজস্ব কোনও উচ্চারণ নেই, কেবন সন্ধিজাত শব্দাদ্য অ-এর লোপ নির্দেশ করে।
Thursday, July 31, 2008
Monday, July 28, 2008
তেরিজ, আরবির আর বাংলার
কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটির ১৮১৯ সালে ছাপা ‘হার্লের অ্যারিথমেটিক: ফর দ্য ইউস অব বেঙ্গালি স্কুলস’ বা বাংলায় ‘গণিতাঙ্ক, পাঠশালার নিমিত্তে’ বইয়ে বর্তমানে প্রচলিত শব্দের পরিবর্তে কিছু আরবি এবং সংস্কৃত শব্দের দেখা মেলে। বইয়ে আছে,—
‘+ তেরিজের চিহ্ন এই; অর্থাৎ যে স্থানে এই চিহ্ন দেখিবা, সে সকল অঙ্কের তেরিজ করিতে হইবে জানিবা. ... যেমন ৫ + ৫ = ১০
- জমা খরচের চিহ্ন, .. যেমন ৫ - ৪ = ১
× পূরণের চিহ্ন, ... যেমন ৫ × ৫ = ২৫
÷ হরণের চিহ্ন, . . . যেমন ৮ ÷ ২ = ৪
= লব্ধের চিহ্ন, এই চিহ্ন সর্বত্রই ব্যবহার্য্য, যেমন ৫+৫ তেরিজ লব্ধ=১০।’
পূরণ, হরণ, লব্ধ এবং জমা খরচ বেশ বোঝা গেলেও তেরিজ শব্দটি বর্তমানে যথেষ্ট অচেনা। অথচ এক সময় এর বেশ প্রচলন ছিল। আরবি তা'রীজ় (تعريض, বিশেষ্য, বৃদ্ধি হওয় বা ঘটানো, জাহির করা, বিরোধিতা করা, আপত্তি করা, ইত্যাদি) এসেছে ʻআর্জ় (عرض, ক্রিয়াপদ, প্রশস্ত হওয়া বা করা, আর দ্বিতীয় অর্থ দেখানো বা পেশ করা) থেকে। জন টম্সন প্ল্যাট্স এবং জন শেক্সপিয়ারের উর্দু অভিধানে শব্দটির দেখা মেলে। বাংলায় অর্থ পাল্টে গেছে।। তেরিজ কষা অর্থ অঙ্ক করা বা যোগফল বের করা। প্রমথ চৌধুরীতে আছে,— ‘ঠাকুরানি এখন আয়ব্যয়ের হিসাব তাঁর কাছে বুঝিয়ে দিতে চান; সেই জন্যই তাঁর তেরিজ খারিজ শেখা দরকার।’
তবে আরবির একই ধাতুমূল (عرض, আরজ) থেকে আসা আরেকটি শব্দকে বাংলার সম্পদ বলে চিনে নিতে কষ্ট হয় না মোটেও ,— আরজ, সাথে ফারসি গুজার (گذار, যে করছে এমন) অর্থাৎ আরজগুজার অর্থ আবেদনকারী, বা আরজ, সাথে ফারসি প্রত্যয় (ي, ই) অর্থাৎ আরজি ও আর্জি অর্থ আবেদনপত্র। উর্দুতেও আরজি একই অর্থে প্রচলিত।
‘+ তেরিজের চিহ্ন এই; অর্থাৎ যে স্থানে এই চিহ্ন দেখিবা, সে সকল অঙ্কের তেরিজ করিতে হইবে জানিবা. ... যেমন ৫ + ৫ = ১০
- জমা খরচের চিহ্ন, .. যেমন ৫ - ৪ = ১
× পূরণের চিহ্ন, ... যেমন ৫ × ৫ = ২৫
÷ হরণের চিহ্ন, . . . যেমন ৮ ÷ ২ = ৪
= লব্ধের চিহ্ন, এই চিহ্ন সর্বত্রই ব্যবহার্য্য, যেমন ৫+৫ তেরিজ লব্ধ=১০।’
পূরণ, হরণ, লব্ধ এবং জমা খরচ বেশ বোঝা গেলেও তেরিজ শব্দটি বর্তমানে যথেষ্ট অচেনা। অথচ এক সময় এর বেশ প্রচলন ছিল। আরবি তা'রীজ় (تعريض, বিশেষ্য, বৃদ্ধি হওয় বা ঘটানো, জাহির করা, বিরোধিতা করা, আপত্তি করা, ইত্যাদি) এসেছে ʻআর্জ় (عرض, ক্রিয়াপদ, প্রশস্ত হওয়া বা করা, আর দ্বিতীয় অর্থ দেখানো বা পেশ করা) থেকে। জন টম্সন প্ল্যাট্স এবং জন শেক্সপিয়ারের উর্দু অভিধানে শব্দটির দেখা মেলে। বাংলায় অর্থ পাল্টে গেছে।। তেরিজ কষা অর্থ অঙ্ক করা বা যোগফল বের করা। প্রমথ চৌধুরীতে আছে,— ‘ঠাকুরানি এখন আয়ব্যয়ের হিসাব তাঁর কাছে বুঝিয়ে দিতে চান; সেই জন্যই তাঁর তেরিজ খারিজ শেখা দরকার।’
তবে আরবির একই ধাতুমূল (عرض, আরজ) থেকে আসা আরেকটি শব্দকে বাংলার সম্পদ বলে চিনে নিতে কষ্ট হয় না মোটেও ,— আরজ, সাথে ফারসি গুজার (گذار, যে করছে এমন) অর্থাৎ আরজগুজার অর্থ আবেদনকারী, বা আরজ, সাথে ফারসি প্রত্যয় (ي, ই) অর্থাৎ আরজি ও আর্জি অর্থ আবেদনপত্র। উর্দুতেও আরজি একই অর্থে প্রচলিত।
Saturday, July 26, 2008
চিত না পট?
একটি পয়সা উপরে ছুঁড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ার অপেক্ষা। চিত না পট? চিত হলে কারুর জিত, আর পট হলে জিত অন্য কারুর। ইংরেজিতে একটি লোক-ঠকানো কথা আছে, – heads I win, tails you lose (চিত হলে আমার জিত, আর পট হলে তোমার হার)। হিন্দিতেও প্রায় একই রকম, তবে একটু বাড়িয়ে,– चित भी मेरी , पट भी मेरी (চিত ভী মেরী পট ভী মেরী, চিত হলেও আমার, পটও আমার); আর যেহেতু পয়সা কখনও কখনও কোনও দিকে না পড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাই সাথে বলা হয়,— खड़ा मेरे बाप का (খড়া মেরে বাপ কা, আর দাঁড়িয়ে থাকলে আমার বাবার)।
তা যাই হোক, প্রাচীন কাল থেকেই পয়সার একদিকে শাসনকর্তার ছবি আর অন্যদিকে যে কোনও ছবি থাকার চল। হালে অনেক দেশেই নিয়মটা যদিও পাল্টেছে। আগে যে দিকে শাসনকর্তার ছবি থাকত সে দিকে এখন অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতীক। এই শাসনকর্তার মাথার ছবি বা রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতীকের দিককে ইংরেজিতে বলা হয় obverse আর অন্য দিককে reverse; এই obverse-ই heads বা বাংলায় চিত, আর reverse হল tails বা বাংলায় পট। বাংলায় চিৎপটাং শব্দটির অর্থ ঊর্ধমুখে শয়ান এবং চিত-পটের চিতের ছবির মাথা আকাশের দিকে মুখ করে পড়া হলেও ‘চিত না পটে’র আগমন সম্ভবত হিন্দি चित या पट (চিত য়া পট) থেকে। চিত সংস্কৃত চিত্র থেকে, যার অর্থ চিত্র, উজ্জ্বল, স্পষ্ট, এমনকি আকাশ; আর পট সংস্কৃত পট্ থেকে যার অর্থ পড়া, নিচে ছোঁড়া, ইত্যাদি। বাংলায় পট শব্দের একটি অর্থ মূল ছবির পিছনের বা দূরের দৃশ্য।
তা যাই হোক, প্রাচীন কাল থেকেই পয়সার একদিকে শাসনকর্তার ছবি আর অন্যদিকে যে কোনও ছবি থাকার চল। হালে অনেক দেশেই নিয়মটা যদিও পাল্টেছে। আগে যে দিকে শাসনকর্তার ছবি থাকত সে দিকে এখন অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতীক। এই শাসনকর্তার মাথার ছবি বা রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতীকের দিককে ইংরেজিতে বলা হয় obverse আর অন্য দিককে reverse; এই obverse-ই heads বা বাংলায় চিত, আর reverse হল tails বা বাংলায় পট। বাংলায় চিৎপটাং শব্দটির অর্থ ঊর্ধমুখে শয়ান এবং চিত-পটের চিতের ছবির মাথা আকাশের দিকে মুখ করে পড়া হলেও ‘চিত না পটে’র আগমন সম্ভবত হিন্দি चित या पट (চিত য়া পট) থেকে। চিত সংস্কৃত চিত্র থেকে, যার অর্থ চিত্র, উজ্জ্বল, স্পষ্ট, এমনকি আকাশ; আর পট সংস্কৃত পট্ থেকে যার অর্থ পড়া, নিচে ছোঁড়া, ইত্যাদি। বাংলায় পট শব্দের একটি অর্থ মূল ছবির পিছনের বা দূরের দৃশ্য।
Sunday, July 20, 2008
পুরনো বাংলায় শব্দের পুনরুক্তি
পুরনো বাংলায় নিয়ম ছিল শব্দ দ্বিরুক্তির জন্য শব্দ একবার লিখে পরে, অনেক সময় তার প্রায় গায়ে লাগিয়ে, ২ সঙ্খ্যাটি লেখা — অর্থ আগের শব্দটি পুনরুক্ত হচ্ছে। যেমন, — ‘যেহেতুক পৃথিবীর মধ্যে যে২ কর্ম্ম হইয়াছে সে২ কর্ম্মহইতে এ কর্ম্ম বড়।’ শ্রীরামপুর থেকে মিশনারিদের প্রকাশিত মাসিক দিগ্দর্শন প্রথম সংখ্যার (এপ্রিল ১৮১৮) প্রথম পৃষ্ঠা থেকে নেওয়া। গেল শতকের মাঝামাঝির পরেও ছাপানো পুঁথিতে এই ব্যাপারটি চোখে পড়ে। পুরনো লেখায়, পুঁথি বা সাধারণ কাজে, এই নিয়মের প্রচলন ছিল। পুঁথিতে দেখা যায়, ‘কৃষ্ণ২ বলি গোপী ডাকে অচেতনে।’
১৮৯১ সালে অক্সফোর্ড ক্ল্যারেন্ডন প্রেসের ছাপানো সাহিত্যিক ও কথ্য রূপের বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (Grammar of the Bengali Language: Literary and Colloquial)-এ জন বিম্স-এর একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, — যখন কোনও শব্দের পুনরুক্তি হয়, বিশেষত বাংলা যা প্রায়শই ঘটে, তখন শব্দটি একবার লেখার পর যতবার তার পুনরুক্তি ঘটবে তার সঙ্খ্যাটি লেখার নিয়ম। যেমন যে যে লেখা হয় যে২, পুনঃ পুনঃ লেখা হয় পুনঃ২, শ্রী শ্রী শ্রী লেখা হয় শ্রী৩।
আধুনিক মান্য সাহিত্যের বা চলতি বাংলায় নিয়মটি উঠে গেছে।
১৮৯১ সালে অক্সফোর্ড ক্ল্যারেন্ডন প্রেসের ছাপানো সাহিত্যিক ও কথ্য রূপের বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (Grammar of the Bengali Language: Literary and Colloquial)-এ জন বিম্স-এর একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, — যখন কোনও শব্দের পুনরুক্তি হয়, বিশেষত বাংলা যা প্রায়শই ঘটে, তখন শব্দটি একবার লেখার পর যতবার তার পুনরুক্তি ঘটবে তার সঙ্খ্যাটি লেখার নিয়ম। যেমন যে যে লেখা হয় যে২, পুনঃ পুনঃ লেখা হয় পুনঃ২, শ্রী শ্রী শ্রী লেখা হয় শ্রী৩।
আধুনিক মান্য সাহিত্যের বা চলতি বাংলায় নিয়মটি উঠে গেছে।
Wednesday, July 16, 2008
রেস্তোরাঁর চন্দ্রবিন্দু
কেউ খাবার কিনে খেতে পারে এমন জায়গাবিশেষের নাম রেস্তোরাঁ। রেস্তরাঁও লেখা হয়। শব্দটি বহুল প্রচলিত এবং বহুল ব্যবহৃত যদিও বেশিরভাগ বাংলা অভিধানে শব্দটির দেখা মেলে না। আর রাস্তার পাশে রেস্তোরাঁর নামে চন্দ্রবিন্দুটিও প্রায়ই অনুপস্থিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা মধুর ক্যান্টিন নামে পরিচিত সেখানে লেখা — মধুর রেস্তোরা; চন্দ্রবিন্দু নেই।
শব্দটি রাজশেখর বসু, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা যোগেশচন্দ্র রায়ে নেই, নেই কাজী আব্দুল ওদুদেও। বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনও বানান বা উচ্চারণ অভিধানেও নেই। এর দেখা মেলে কেবল বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক অভিধান এবং সাহিত্য সংসদের বাংলা অভিধানে। বাংলা একাডেমির অভিধানে ক্রমটি রেস্তোরাঁ, রেস্তরাঁ; ব্যুৎপত্তি ফারসি (ছাপার ভুল হয়ে থাকতে পারে); আর সংসদ অভিধানে রেস্তরাঁ, রেস্তোরাঁ; ব্যুৎপত্তি ইংরেজি হয়ে, ফরাসি থেকে। এর আরও দেখা মেলে পশ্চিম বঙ্গ আকাদেমির বানান অভিধানে, রেস্তোরাঁ; সাহিত্য সংসদের বানান অভিধানে, রেস্তরাঁ; এবং সাহিত্য সংসদের উচ্চারণ অভিধানে, রেস্তরাঁ।
তবে জন মেন্ডিস, জে সাইক্স, উইলিয়াম কেরি, হেনরি পিট্স ফর্স্টার বা পি, এস, ডি'রোজারিওর পুরনো দিনের কোনও বাংলা অভিধানে শব্দটি পাওয়া যায় না। শব্দটি বাংলায় প্রবেশ ফরাসি থেকে, ইংরেজির হাত ধরে হলে হতেও পারে। ইংরেজিতে শব্দটি এসেছে ফরাসি ক্রিয়া restaurer এর বর্তমান ক্রিয়াবাচক বিশেষণ restaurant থেকে, অর্থ সেই খাদ্য যা সতেজ করে। এই ফরাসি ক্রিয়ার আগমন পুরনো ফরাসি restorer থেকে, আর তার আগমন লাতিন restaurare (re- + -staurare) থেকে, অর্থ আবার তৈরি করা। আর ফরাসিতে কেনার পর বসে খাবার জায়গা অর্থে প্রথম ব্যবহার ১৭৬৫ সালে, আর ইংরেজিতে ১৮২৭ সালে।
গুগলে শব্দটির সাতটি বানান পাওয়া গেছে — রেস্তোরা, রেস্তোরাঁ, রেস্তোঁরা, রেঁস্তোরা, রেস্তরাঁ, রেস্তঁরা, রেঁস্তরা; এর বাইরে আর একটি বানানই কেবল সম্ভব — রেস্তরা; একটু খুঁজলে হয়তও তারও দেখা পাওয়া যাবে। ব্যবহার দেখে মনে হয় একসময় রেস্তোরাঁর চন্দ্রবিন্দুটি লুপ্ত হবে, বিশেষত পূর্ব বঙ্গে।
শব্দটি রাজশেখর বসু, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা যোগেশচন্দ্র রায়ে নেই, নেই কাজী আব্দুল ওদুদেও। বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনও বানান বা উচ্চারণ অভিধানেও নেই। এর দেখা মেলে কেবল বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক অভিধান এবং সাহিত্য সংসদের বাংলা অভিধানে। বাংলা একাডেমির অভিধানে ক্রমটি রেস্তোরাঁ, রেস্তরাঁ; ব্যুৎপত্তি ফারসি (ছাপার ভুল হয়ে থাকতে পারে); আর সংসদ অভিধানে রেস্তরাঁ, রেস্তোরাঁ; ব্যুৎপত্তি ইংরেজি হয়ে, ফরাসি থেকে। এর আরও দেখা মেলে পশ্চিম বঙ্গ আকাদেমির বানান অভিধানে, রেস্তোরাঁ; সাহিত্য সংসদের বানান অভিধানে, রেস্তরাঁ; এবং সাহিত্য সংসদের উচ্চারণ অভিধানে, রেস্তরাঁ।
তবে জন মেন্ডিস, জে সাইক্স, উইলিয়াম কেরি, হেনরি পিট্স ফর্স্টার বা পি, এস, ডি'রোজারিওর পুরনো দিনের কোনও বাংলা অভিধানে শব্দটি পাওয়া যায় না। শব্দটি বাংলায় প্রবেশ ফরাসি থেকে, ইংরেজির হাত ধরে হলে হতেও পারে। ইংরেজিতে শব্দটি এসেছে ফরাসি ক্রিয়া restaurer এর বর্তমান ক্রিয়াবাচক বিশেষণ restaurant থেকে, অর্থ সেই খাদ্য যা সতেজ করে। এই ফরাসি ক্রিয়ার আগমন পুরনো ফরাসি restorer থেকে, আর তার আগমন লাতিন restaurare (re- + -staurare) থেকে, অর্থ আবার তৈরি করা। আর ফরাসিতে কেনার পর বসে খাবার জায়গা অর্থে প্রথম ব্যবহার ১৭৬৫ সালে, আর ইংরেজিতে ১৮২৭ সালে।
গুগলে শব্দটির সাতটি বানান পাওয়া গেছে — রেস্তোরা, রেস্তোরাঁ, রেস্তোঁরা, রেঁস্তোরা, রেস্তরাঁ, রেস্তঁরা, রেঁস্তরা; এর বাইরে আর একটি বানানই কেবল সম্ভব — রেস্তরা; একটু খুঁজলে হয়তও তারও দেখা পাওয়া যাবে। ব্যবহার দেখে মনে হয় একসময় রেস্তোরাঁর চন্দ্রবিন্দুটি লুপ্ত হবে, বিশেষত পূর্ব বঙ্গে।
Tuesday, July 08, 2008
চন্দ্রবিন্দু, আগে না পরে?
চলতি প্রথায় চাঁদের বানান চ-এ চন্দ্রবিন্দু যোগ আ-কার আর দ। অন্তত এভাবেই শিশুদের বর্ণশিক্ষা দেওয়া হয়। কারণটি বোধ করি সীসার সাবেকি ছাঁদের হরফে চন্দ্রবিন্দু ছাপায় সাধারণত মূল ব্যঞ্জনের উপরে বসে। প্রযুক্তিগত কারণে। মূল হরফের সাথে একই ছাঁদে চন্দ্রবিন্দু ঢালাই করা হত যেন ছাপার সময় হরফ ভেঙ্গে না যায়। সেই ধারায় কম্পিউটারে ২৫৬-হরফের নিয়মে যখন বাংলা লেখা হয়, তখনও আগে মূল হরফ, তারপর চন্দ্রবিন্দু এবং তারপর কার বসানো হয়। হালে ইউনিকোড চালু হওয়ায় ক্রমটি পাল্টে গেছে। আগে মূল ব্যঞ্জন, পরে কার এবং শেষে চন্দ্রবিন্দু, কারণ চন্দ্রবিন্দুর কাজটি হল স্বর বা স্বরের চিহ্নকে আনুনাসিক করা, মূল ব্যঞ্জন হরফকে নয়। আবার স্বরের চিহ্ন ছাড়া চন্দ্রবিন্দু বসলে তা মূল হরফের পরেই বসে, তার কারণ চন্দ্রবিন্দু এখানে চ্ ব্যঞ্জনে নিহিত অ-এর উচ্চারণকে আনুনাসিক করে। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকলেও চাঁদ বানানে আ-কারের পরেই চন্দ্রবিন্দু বসা উচিত, চ-এর পরে নয়, আর আ-কার বসলে চ্-এর নিহিত অ-স্বরের কোনও অস্তিত্ব থাকে না।
Monday, June 30, 2008
মন (চিত্ত) এবং মন (ওজনের মাপ)
অনেকেরই ধারণা মন (চিত্ত) এবং মন (ওজনের মাপ বিশেষ), বিকল্প বানানে মণ, শব্দদুটির উচ্চারণ ভিন্ন। মান্য চলিত বাংলায় মনের (চিত্ত) উচ্চারণ, সমস্ত অভিধান মতে, মোন (/mon/), যদিও পুব বাংলায় প্রায়ই মন (/mɔn/) শ্রুত হয়। আবার ওজনের মাপ অর্থে মন, বা মণ, এর উচ্চারণও মোন (/mon/)। ১৮১৯ সালে চুঁচুঁড়া থেকে কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটীর (পুরনো বানান) দ্বারা ছাপানো 'হার্রলের গণিতাঙ্ক: পাঠশালার নিমিত্তে' নামের বইয়ে মন (ওজনের মাপ) এর বানান দেখা যায় মোন, বানানটি একটু চোখে ঠেকলেও, উচ্চারণটি বেশ বোঝা যায়।
Monday, May 26, 2008
বাংলায় সমাক্ষরের যুক্তি
বাংলার সমাক্ষরের যুক্তি, ইংরেজিতে যাকে geminate cluster বলা চলে, তার সঙ্খ্যা নিতান্তই কম নয়: ক্ক, গ্গ, চ্চ, জ্জ, ট্ট, ড্ড, ণ্ণ, ত্ত, দ্দ, ন্ন, প্প, ব্ব, ম্ম, য্য, এবং ল্ল। ঘোষ বা অঘোষ যাই হোক না কেন, সবগুলোই অল্পপ্রাণ। মহাপ্রাণে যে যুক্তি হয় না, তা অবশ্য নয়। ব্যাপারটি হল মহাপ্রাণ-মহাপ্রাণ যুক্তি হলে আগের অক্ষরটি তার মহাপ্রাণত্ব হারায়: চ্ছ, জ্ঝ, ত্থ, দ্ধ, ইত্যাদি। আরও যুক্তি সম্ভব, তবে সেগুলো এখনও সংস্কৃত, পালি বা প্রাকৃতের বৈশিষ্ট্য হিসেবে থেকে গেছে, বাংলার হয়ে ওঠে নি, যেমন অবহট্ঠ (পুরনো বাংলা হরফে ট-এ নিচে ঠ-এর যুক্তি), গর্ব্ভ (পুরনো বাংলা হরফে এবং সংস্কৃতে ব-এর নিচ ভ, উপরে রেফ), ইত্যাদি।
তবে প্রতিবর্ণনের সময় য্য-র দিকে আলাদা দৃষ্টি দিতে হয়। আন্তর্জাতিক মান সংস্থার প্রবর্তিত আমাস ১৫৯১৯: দেবনাগরী এবং সম্পর্কিত ইন্দীয় লেখার লাতিন হরফে প্রতিবর্ণীকরণ পদ্ধতিতে য্য-এর প্রতিবর্ণন ẏẏ। য-ফলা য-এর সাথে ছাড়া আর সব জায়গায় y, প্রতিবর্ণনে।
তবে প্রতিবর্ণনের সময় য্য-র দিকে আলাদা দৃষ্টি দিতে হয়। আন্তর্জাতিক মান সংস্থার প্রবর্তিত আমাস ১৫৯১৯: দেবনাগরী এবং সম্পর্কিত ইন্দীয় লেখার লাতিন হরফে প্রতিবর্ণীকরণ পদ্ধতিতে য্য-এর প্রতিবর্ণন ẏẏ। য-ফলা য-এর সাথে ছাড়া আর সব জায়গায় y, প্রতিবর্ণনে।
Friday, May 23, 2008
প্যাঁচের জিলাপি, তার দেশ ভ্রমণ
ময়রার দোকানে যা, পয়সা ফেলে দে, যত চাস জিলিপি পাবি। সুকুমার রায়ের দাশুর কীর্তি। জিলিপি কথ্য ভাষা, মান্য বাংলায় জিলাপি। জিলেপি, জিলেবি, জিলাবি ইত্যাদি রূপেও পাওয়া দুষ্কর নয়। শব্দটি বাংলায় ঢুকেছে হিন্দি जलेबी (জলেবী) বা जिलेबी (জিলেবী) থেকে। উর্দুতে বানান جلبى। ধারণা করা হয় হিন্দি শব্দটি আরবির زلابية (জ়ালাবিয়া) বা ফারসির زلیبیا (জ়োলেবিয়া) থেকে আগত। ভারতীয় ভাষায় শব্দটি পাওয়া যায় ১৫ শতকের দিকে, তার আগে নয়। হবসন-জবসনে বানান jelaubee, আর ব্যুৎপত্তিতে বলা আছে সম্ভবত আরবির জালাবিয়া বা ফারসির জলিবিয়া থেকে আগত। মিষ্টান্নটির হিস্পানি নাম zalabia, (আফ্রিকার) ফরাসিতেও তাই।
Sunday, May 18, 2008
চিকিৎসার্থ সাহায্যের আবেদন
নবকুমার পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমায় কোথায় লইয়া যাইতেছেন?” / কাপালিক কহিল, “পূজার স্থানে।” / নবকুমার কহিলেন, “কেন?” / কাপালিক কহিল, “বধার্থ।” — বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা। বধার্থ অর্থ বধের হেতু, নিমিত্ত বা জন্য। অর্থ শব্দের একটি অর্থ। এক্ষেত্রে এ-বিভক্তির প্রয়োজন পড়ে না। যেমন, পরার্থ কর্ম, জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থ আইন, চিকিৎসার্থ সাহায্যের আবেদন, ইত্যাদি। জ্যেষ্ঠ এক সহকর্মীর আক্ষেপ নিমিত্ত অর্থে প্রায়ই পত্রিকার পাতায় চিকিৎসার্থে সাহায্যের আবেদন করা হয়, অর্থাৎ এ-বিভক্তির বাহুল্য।
Wednesday, April 23, 2008
যুক্তাক্ষর: ল-এ থ
দেশ পত্রিকায় অনেক আগে ছাপা একটি বিজ্ঞাপনে একটি নতুন যুক্তহরফের দেখা মিলেছিল — হেল্থ। আবারও ল-এ থ। তবে যুক্তাক্ষরটি যে বাক্যে ব্যবহৃত হয়েছিল তা হাতে লেখা; কোনও ফন্টের অংশ নয়। তবুও তা যুক্তাক্ষরই এবং বিধিবহির্ভূত। বিদেশি শব্দ লিখতে গিয়ে হসন্ত বা হলন্তের একটু চিন্তিত ব্যবহার করলেই নতুন যুক্তাক্ষর তৈরি করতে হয় না। হেল্থ কেয়ার না লিখে হেল্থ বা হেল্থ্ (দুটি হসন্ত একটু কেমন যেন দেখায়) কেয়ার লিখলেও স্বাস্থ্য সেবা বা পরিষেবাতে কোন দোষ হয় না।
Monday, April 21, 2008
লিখিবার আলমারি
মেজ বা লেখার জন্য ব্যবহার্য ছোট চৌকিকে নাকি বাংলায় 'লিখিবার আলমারি' বলা হয়। হত হয়ত। এখন তো চোখে পড়ে না। মনসিনিওর সেবাস্তিআঁউ রোদোল্ফো দালগাদো'র ইনফ্লুয়েন্সিয়া দো ভোকাবুলারিউ পোর্তুগেস এম লিঙ্গুয়াস আসিয়াতিকাস (Influência do vocabulario português em linguas asiáticas) এর ১৯৩৬ সালে ছাপানো আন্তনি হাভিয়ের সোআরেস-এর ইংরেজি অনুবাদ এশীয় ভাষায় পর্তুগিজ শব্দের প্রভাব (Portuguese vocables in Asiatic Languages)-এ তেমনটিই বলা আছে। বইটিতে হিন্দি থেকেও একই রকম উদাহরণ দেওয়া আছে: লিখনে কী আলমারী (लिखने की आलमारी)। যদিও আলমারি বলতে সাধারণত ইংরেজির almirah, cupboard বা closet-কেই বোঝায়। কোনও বাংলা অভিধানেই আলমারির চৌকি অর্থের দেখা মেলে না। বাংলার আলমারি এবং ইংরেজির almirah দুটি শব্দর উৎস এক: পর্তুগিজ armário।
Sunday, April 20, 2008
যুক্তাক্ষর: ল-এ স
দিনাজপুরে রেল স্টেশন থেকে একটু পশ্চিমে এগিয়ে রাস্তার দক্ষিণে ছোট একটা কাপড় ধোলাইয়ের দোকান। তার দরজার কাঠে লেখা 'এখানে ফল্স লাগানো হয়' — ল্ + স। অর্থাৎ আলগা কাপড়। যাই হোক, যুক্তাক্ষরটি নতুন, চোখে পড়ার মত আবার বাংলায় প্রচলিত যুক্ত হরফের তালিকার বাইরে। এই সময়ে বাংলা ইউনিকোড ফন্টের কারণে অনেক ধরণের যুক্তাক্ষরই লেখা যায়, যাওয়া উচিত কিনা তা যদিও বিতর্কের বিষয়। ফল্স বা ফল্স্ লিখলেই হত, যুক্তহরফের ঝামেলা না বাড়িয়ে।
Monday, April 07, 2008
জন মেন্ডিসের হরফ পরিবর্ধন

বুদ্ধদেব বসু পরে জ-এর নিচে দুই ফুটকি দিয়ে, জ̤, এর ব্যবহার শুরু করে ফরাসি je (জ্য̤, আমি) বা রুশ жизнь (জি̤জ়ন্, জীবন) এর প্রথম ব্যঞ্জনধ্বনি বোঝাতে। যদিও এই ক্ষেত্রে জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং সুনীতিকুমারের বিধান ঝ় বা ঝ.। কিন্তু এরও বেশ আগে, আগের শতকের মাঝামাঝিতে, ১৮৫১ সালে কলকাতায় ছাপানো জন মেন্ডিসের কম্প্যানিঅন টু জনসন্'স ডিকশনারি: বেঙ্গলি অ্যান্ড ইংলিশ-এ এই হরফ পরিবর্ধনের একটি উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়। মেন্ডিসের অভিধানের একটি উল্লেখ করার মত বিষয় হল আরবি-ফারসি থেকে আসা শব্দে জ এবং জ় ধ্বনির বানানে পার্থক্য নির্দেশ, জ̤-এর নিচে দুই ফুটকি দিয়ে। ছবিতে উপরে আজি এবং আজিকার শব্দ দুটি বাংলার নিজের, আর নিচের আজি̤জ̤ এবং আজি̤ম শব্দ দুটি আরবি-ফারসির, জ-এর নিচে দুটি করে ফুটকি।
Tuesday, April 01, 2008
আরবি-ফারসির র, বাংলায় ড়
আরবি বা ফারসির র বাংলায় ড় হয়ে যায়। সবক্ষেত্রে অবশ্যই নয়। তবে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে তার পুরোটা এখনও হয়ত জানা যায় নি। আপাতত দুটো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আজুড়ে বা আজাড়ে প্যাঁচাল, অর্থাৎ বেহুদা বা অত্যধিক বক্তৃতা — বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান মতে আজুড়ে শব্দটার মূল ফারসি আজার (آزار, অর্থ অসুবিধা, বিরক্তি, উচ্ছৃঙ্খলা, ঝগড়া, অত্যাচার ইত্যাদি), সাথে বাংলা ইয়া প্রত্যয় যোগে আজাড়িয়া (ঢাকার ভাষায় প্রায়ই শোনা যায় আজাইরা, অপিনিহিতির উদাহরণ) এবং সেখান থেকে আজাড়ে, অভিশ্রুতি, এবং সেখান থেকে আজুড়ে। অনেক অভিধানে শব্দটি নেই আবার বাংলা একাডেমির বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে শব্দটি ব্যুৎপত্তি অন্যভাবে দেখানো হয়েছে; চলন্তিকা মতে যার জাড় (জড়) বা মূল নাই, অমূলক, যেমন আজাড়িয়া গল্প।
তেমনি ভাবে গোমড়া মুখ, অপ্রসন্ন, গুমট, মেঘাছন্ন অর্থে। ফারসিতে গুমরাহ্ (گمراه, অর্থ পথ-ভ্রষ্ট, বঞ্চিত, হতবুদ্ধি ইত্যাদি), অন্তত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান মতে। বাঙ্গালা ভাষার অভিধান মত শব্দটি ফারসি গুমান (گمان, অর্থ মত, ধারণা, পছন্দ, চিন্তা, সন্দেহ, অবিশ্বাস ইত্যাদি, যা পহ্লবি গুমান gumān থেকে আগত) > হিন্দি গুমর (गुमर, অর্থ অভিমান, অহঙ্কার) থেকে ব্যুৎপন্ন।
বাংলার ফেঁকড়া বা ফ্যাঁকড়াও, মূল বিষয়ের আনুষাঙ্গিক বিঘ্ন অর্থে, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান মতে আরবির ফিক়রাহ (فقرة, অর্থ চিহ্ন, উদ্দেশ্য ইত্যাদি) থেকে আগত। যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটির উৎপত্তি হিসেবে তিনটি ভাষার শব্দ দেওয়া আছে, ওড়িয়া ফাঁকড়া (ଫାଁକଡ଼ା), সংস্কৃত ফর্ফরীক (फर्फरीक) আর অসমিয়া ফেরকেটা (ফেৰকেটা) । বাংলা একাডেমির অভিধানে আরবি শব্দের সাথে ওড়িয়া এবং সংস্কৃত শব্দদুটি দেওয়া আছে। আরবি থেকে এসে থাকলে শব্দটিতে র > ড় হতে পারে, কিন্তু চন্দ্রবিন্দুর কোন জায়গা দেখতে পাওয়া যায় না। হয়ত ওড়িয়া ফাঁকড়ার প্রভাব পড়ে থাকতে পারে।
যদি আরবি-ফারসির ব্যুৎপত্তিগুলো ঠিক হয় তাহলে বলা যায় যে ফারসি বা আরবির র বাংলায় ড় হিসেবে দেখা যায়, ঠিক কতগুলো শব্দে তা বলা মুশকিল। তবে অভিধানগুলো ঘেঁটে দেখলে আরেকটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যায় যে শব্দ ব্যুৎপত্তি নির্ধারণে বাংলায় অনেক কাজ করা বাকি।
তেমনি ভাবে গোমড়া মুখ, অপ্রসন্ন, গুমট, মেঘাছন্ন অর্থে। ফারসিতে গুমরাহ্ (گمراه, অর্থ পথ-ভ্রষ্ট, বঞ্চিত, হতবুদ্ধি ইত্যাদি), অন্তত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান মতে। বাঙ্গালা ভাষার অভিধান মত শব্দটি ফারসি গুমান (گمان, অর্থ মত, ধারণা, পছন্দ, চিন্তা, সন্দেহ, অবিশ্বাস ইত্যাদি, যা পহ্লবি গুমান gumān থেকে আগত) > হিন্দি গুমর (गुमर, অর্থ অভিমান, অহঙ্কার) থেকে ব্যুৎপন্ন।
বাংলার ফেঁকড়া বা ফ্যাঁকড়াও, মূল বিষয়ের আনুষাঙ্গিক বিঘ্ন অর্থে, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান মতে আরবির ফিক়রাহ (فقرة, অর্থ চিহ্ন, উদ্দেশ্য ইত্যাদি) থেকে আগত। যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটির উৎপত্তি হিসেবে তিনটি ভাষার শব্দ দেওয়া আছে, ওড়িয়া ফাঁকড়া (ଫାଁକଡ଼ା), সংস্কৃত ফর্ফরীক (फर्फरीक) আর অসমিয়া ফেরকেটা (ফেৰকেটা) । বাংলা একাডেমির অভিধানে আরবি শব্দের সাথে ওড়িয়া এবং সংস্কৃত শব্দদুটি দেওয়া আছে। আরবি থেকে এসে থাকলে শব্দটিতে র > ড় হতে পারে, কিন্তু চন্দ্রবিন্দুর কোন জায়গা দেখতে পাওয়া যায় না। হয়ত ওড়িয়া ফাঁকড়ার প্রভাব পড়ে থাকতে পারে।
যদি আরবি-ফারসির ব্যুৎপত্তিগুলো ঠিক হয় তাহলে বলা যায় যে ফারসি বা আরবির র বাংলায় ড় হিসেবে দেখা যায়, ঠিক কতগুলো শব্দে তা বলা মুশকিল। তবে অভিধানগুলো ঘেঁটে দেখলে আরেকটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যায় যে শব্দ ব্যুৎপত্তি নির্ধারণে বাংলায় অনেক কাজ করা বাকি।
Thursday, March 13, 2008
রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেবের হরফযোজনা

বুদ্ধদেব বসুর লেখায়ও তেমন দুয়েকটি ব্যাপার দেখা যায়। তার প্রচেষ্টা ছিল হ-এ য-ফলার দু'রকম ব্যবহারের: য-ফলা খানিকটা ছোট হয়ে হ-এর গায়ে লাগানো রূপটি ব্যবহৃত হত সংস্কৃত শব্দ যেখানে জ-ঝ-এর উচ্চারণ সেখানে, যেমন সহ্য শব্দে; আবার তদ্ভব বা বিদেশি শব্দ যেখানে য-ফলা অ্যা-কারের ভূমিকা পালন করে সেখানে য-ফলা একটু বড় হয়ে হ-এর থেকে একটু দূরত্বে বসত, যেমন হ্যাঁ, হ্যাপা বা হ্যালসিঅন শব্দে। তার আরও একটি ব্যবহার বেশ কাজের এবং চোখে পড়বার মত। যেহেতু বইয়ে প্রতি পাতায় উপরের সাদা প্রান্তের পরিমাপ একই, তাই সাধারণভাবে দুই স্তবকের মাঝে ফাঁক থাকলেও কখনও স্তবক নতুন পাতায় শুরু হলে তার প্রথম চরণটি ইন্ডেন্ট (একটু ডানে সরিয়ে) করে ছাপানো হত, যেন স্তবকের শুরু বুঝতে অসুবিধা না হয়।
বুদ্ধদেবের ইলেক চিহ্নের ব্যবহার এখন অনেকাংশে উঠে গেলেও, ব্যবহার অন্য জায়গায়ও দেখা গেছে। রবীন্দ্রনাথের দুই এ-কারের ব্যবহার বা বুদ্ধদেবের হ-এ য-ফলার ব্যবহার তাদের লেখার ছাপাতেই সীমাবদ্ধ। নতুন গজিয়ে ওঠা অনেক প্রকাশনা সংস্থার অনেকেই, বিশেষত কম্পিউটারের ভিড়ে ছাপাখানার অনেক ছোটখাট নিয়ম হারিয়ে যাওয়ার যুগে, হয়ত জানে না এরকম হরফের এরকম ব্যবহার কখনও ছিল।
Tuesday, March 11, 2008
হরফের রেখা আর চতুষ্কোণ

বাংলা হরফও তেমনি একটি অদৃশ্য নকশার উপর বসানো যায়। মাত্রার সাথে যে রেখাটি চলে যাবে তার নাম হতে পারে মাত্রারেখা (১) বা headline। আর মাত্রা থেকে ঝুলে নিচে বেশির ভাগ হরফের নিচ যেখানে ঠেকে যাবে তার নাম হতে পারে ভূমিরেখা (২) বা baseline। এই মাত্রারেখা থেকে ভূমিরেখার দূরত্বকে ধরা হবে হরফের মূল উচ্চতা বা base height। মাত্রারেখার উপর আরও একটি রেখা টানা যেতে পারে যা ছুঁয়ে থাকবে ই-কারের উড়াল বা রেফের মাথা আর এই রেখাটির নাম হতে পারে শিরোরেখা (৩) বা topline। ঠিক তেমনিভাবে সবচেয়ে নিচে একটি রেখা টানা হবে, উ-কারের নিচ ছুঁয়ে, যার নাম হতে পারে পাদরেখা (৪) বা dropline। ক বা ত এর মূল রূপ যেখান থেকে শুরু সেখানে আরও একটি রেখা টানা যেতে পারে যার নাম হতে পারে মধ্যরেখা (৫) বা meanline। ভূমিরেখা থেকে মাত্রারেখার উচ্চতাকে হরফরের সাধারণ উচ্চতা (height) বলে ধরা হবে। পাদরেখা থেকে শিরোরেখার দূরত্বকে সাধারণভাবে হরফের উচ্চতা (letter height বা corps size) বলে ধরা যেতে পারে। রোমক হরফ ভূমিরেখার উপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে; বাংলায় কিন্তু হরফগুলো মাত্রারেখা থেকে ঝুলে থাকে; এবং অনেকক্ষেত্রেই হরফের নিম্নাংশ ভূমিরেখা ছোঁয় না। এ কারণে বোধহয় ফিওনা জি ই রস (Fiona GE Ross) তার মুদ্রিত বাংলা হরফ ও তার বিবর্তন (The Printed Bengali Character and its Evolution) বইয়ে একে বেসলাইন না বলে নোশ্যনাল (notional) বেসলাইন বা ধারণাগত বা ধরে-নেওয়া ভূমিরেখা বলেছে।
হরফ সাধারণত একটি অদৃশ্য চতুষ্কোণের মধ্যে বসানো থাকে। এবং এই চতুষ্কোণের দু'পাশে খানিকটা জায়গা ছেড়ে তারপর হরফটি বসে। এই চতুষ্কোণটি ছবিতে লাল রঙে আঁকা হয়েছে। আর হরফটি বসানো আছে সবুজ দু'টি দাগের মাঝে। এই লাল দাগ থেকে সবুজ দাগের ইংরেজি নাম সাইডবেয়ারিং (sidebearing), বাংলায় হতে পারে পার্শ্বস্থান। দু'পাশের পার্শস্থান বাদ দিলে বাকি জায়গা যেখানে হরফ বসানো থাকে তাকে হরফের মূল প্রস্থ বলা যায়। পাশাপাশি দু'টি হরফের পার্শ্বস্থান মিলে ধরা হয় দু'টি হরফের মাঝে ফাঁক।
Monday, March 10, 2008
স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব নাকি স্বরাঘাত?
সাধারণভাবে বলা হয় স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব-হ্রস্বত্ব বা স্বরাঘাতে বাংলায় অর্থের পার্থক্য হয় না। একাক্ষর শব্দে স্বরধ্বনি সাধারণত কিঞ্চিৎ দীর্ঘ। যেমন, দিন বা দীন /diˑn/ বা /diːn/, কিন্তু দিনাবসান /dinɑboʃɑn/, এখানে হ্রস্ব। ১৯২০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যায়লয়ের ছাপানো বিজয়চন্দ্র মজুমদারের ইংরেজিতে লেখা বাংলা ভাষার ইতিহাস (The History of the Bengali Language) নামের বইয়ে তিন ধরণের স্বরাঘাতের উল্লেখ পাওয়া যায় — উচ্চ, মধ্যম এবং নীচ। বিজয়চন্দ্রের ভাষায়: যদি রাজপুত্রের রা-তে উচ্চ স্বরাঘাত দেওয়া হয় [/ˈrɑdʒputːro/], তবে তা হবে বহুব্রীহি এবং অর্থ পুত্র রাজা যার; আর যদি স্বরাঘাত পড়ে শেষ অক্ষর ত্র-তে [/rɑdʒputːˈro/], তবে তা হবে তৎপুরুষ এবং অর্থ রাজার পুত্র। এই পার্থক্য কেউ করে কি? জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটির অর্থ কিন্তু একটিই, রাজার পুত্র। একই রকমভাবে কলম /ˈkɔlom/ অর্থ লেখনী, আর কলম /kɔˈlom/ অর্থ গাছের জোড়। বইটিতে এরপর আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া আছে যেখানে স্বরাঘাতে অর্থ বদল হয়। যেমন, আটা /ˈɑʈɑ/ (গমচূর্ণ) ও আটা /ɑˈʈɑ/ (আঠা); কড়ি /ˈkoɽi/ (বরগা কাঠ) ও কড়ি /koˈɽi/ (টাকা); কানা /ˈkɑnɑ/ (অন্ধ) ও কানা /kɑˈnɑ/ (প্রান্ত); খোলা /ˈkʱolɑ/ (খুলে ফেলা) ও খোলা /kʱoˈlɑ/ (টালি); ছোঁড়া /ˈtʃoɽɑ/ (বালক) ও ছোঁড়া /tʃoˈɽɑ/ (ছুঁড়ে ফেলা); গেরো /ˈgero/ (বন্ধন) ও গেরো /geˈro/ (গ্রহ, মন্দভাগ্য), চান /ˈtʃɑn/ (গোসল) ও চান /tʃɑn/ (তিনি চান); ঘাট /ˈɡʱɑʈ/ (গোসলের চায়গা) ও ঘাট /ɡʱɑʈ/ (দায়িত্বে স্খলন)। বইতে আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালায় উচ্চারণগুলো দেখানো নেই। বিজয়চন্দ্রের ভাষায়, সুগন্ধ হলে স্বরাঘাত থাকে গন্ধের প্রথম অক্ষরে /ˈɡɔndʱo/, আর দুর্গন্ধ হলে থাকে পরের অক্ষরে /ɡɔnˈdʱo/। বিজয়চন্দ্রের উদাহরণে ব্যাপারটা কি স্বরাঘাতের নাকি স্বরধ্বনির দীর্ঘত্বের, বিশেষত যখন শব্দটি একাক্ষর, যেমন, চান এবং চান? বইতে শেষের গন্ধের উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে গন্ধ-অ-অ। নির্দেশ কিন্তু দীর্ঘত্বের দিকে।
বাংলায় চায়ের উচ্চারণ চা /tʃɑˑ/ বা /tʃɑː/, এবং একাক্ষর বলে খানিকটা দীর্ঘ। সাথে -টা যোগে 'চা টা নিয়ে এস' হলে চা-র উচ্চারণ খানিকটা দীর্ঘই থাকে, টা-এর উচ্চারণ হ্রস্ব হয়, /tʃɑˑ ʈɑ/। কিন্তু যদি চা এর সাথে টা-এর ব্যাপার থাকে, যেমন চা-টা, চা-পানি অর্থে, তাহলে টা-এ উচ্চারণ আবার দীর্ঘ হয়ে যায়, /tʃɑˑ ʈɑˑ/। আবার চেটে নেওয়া অর্থে চাটা হলে কোনও স্বরই দীর্ঘ অনুমিত হয় না, যেমন /tʃɑʈɑ/, নাকি /ˈtʃɑʈɑ/, প্রথম স্বরে আঘাত বলে মনে হচ্ছে। বাংলায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুটি অক্ষরের প্রথমটিতে খানিকটা স্বরাঘাত থাকে। এই স্বরাঘাত 'চা টা,' 'চা-টা,' এবং 'চাটা' সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে এই স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব বা হ্রস্বত্ব এবং স্বরাঘাত কোনওটিই বাংলার ধ্বনিমূলক (phonemic) বৈশিষ্ট্য নয়, উচ্চারণগত (phonological) বৈশিষ্ট্য।
বাংলায় চায়ের উচ্চারণ চা /tʃɑˑ/ বা /tʃɑː/, এবং একাক্ষর বলে খানিকটা দীর্ঘ। সাথে -টা যোগে 'চা টা নিয়ে এস' হলে চা-র উচ্চারণ খানিকটা দীর্ঘই থাকে, টা-এর উচ্চারণ হ্রস্ব হয়, /tʃɑˑ ʈɑ/। কিন্তু যদি চা এর সাথে টা-এর ব্যাপার থাকে, যেমন চা-টা, চা-পানি অর্থে, তাহলে টা-এ উচ্চারণ আবার দীর্ঘ হয়ে যায়, /tʃɑˑ ʈɑˑ/। আবার চেটে নেওয়া অর্থে চাটা হলে কোনও স্বরই দীর্ঘ অনুমিত হয় না, যেমন /tʃɑʈɑ/, নাকি /ˈtʃɑʈɑ/, প্রথম স্বরে আঘাত বলে মনে হচ্ছে। বাংলায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুটি অক্ষরের প্রথমটিতে খানিকটা স্বরাঘাত থাকে। এই স্বরাঘাত 'চা টা,' 'চা-টা,' এবং 'চাটা' সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে এই স্বরধ্বনির দীর্ঘত্ব বা হ্রস্বত্ব এবং স্বরাঘাত কোনওটিই বাংলার ধ্বনিমূলক (phonemic) বৈশিষ্ট্য নয়, উচ্চারণগত (phonological) বৈশিষ্ট্য।
Friday, February 29, 2008
বাংলায় বহুবচনের আরবি-ফারসি প্রত্যয়
বাংলায় আইনের ভাষায় আরবির -আত প্রয়োগে বহুবচনের প্রচলন দেখা যায়, দুয়েকটি হলেও, বহুবচন হিসেবে হয়ত নয়, পুরো নতুন শব্দ হিসেবেই। অভিধানে দেখা মেলে কাগজাত, বা কাগজাদ-এর, অর্থ দলিলপত্র, বা কাগজপত্র। আরবি স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দের শেষে -আত যোগে গঠিত বহুবচনের রূপ, যা ফারসিতেও প্রচলিত: কাগজ (ফারসি كاغذ) + আত (আরবি/ফারসি ات), অর্থাৎ কাগজের বহুবচন, অনেকগুলো কাগজ। বাংলায় কাগজ বলতে তেমন জোরালোভাবে দলিল না বোঝালেও ফারসিতে একটি অর্থ দলিল। আবার খবরের কাগজ সংজ্ঞার্থটি ফারসিতেও আছে, বাংলাতেও। এই ফারসি কাগজ শব্দটি এসেছে পুরনো আরবি শব্দ কাগ়দ (كاغد) থেকে। আরবির কাগজ অর্থে আর একটি পুরনো শব্দ হল ক়ির্ত়াস্ (قرطاس), যা গ্রিক খ়ারতেস (χαρτές প্যাপিরাসের পাতা অর্থে) থেকে আগত। আরবির কাগজ অর্থে বর্তমানে প্রচলিত শব্দটি হল ব়ারাক়্ (ورق), অর্থ পর্ণরাজি বা পত্র, ব়ারাক়ু ক়ির্ত়াস্ (ورق قرطاس) এর সঙ্ক্ষেপ। ব়ারাক়া (ورقة) অর্থ কাগজের তা। পুরনো আরবিতে পাওয়া যায় আস়হাব আল-কাগ়দ (কাগজ বিক্রেতা) বা ত়ায়্য আল-কাগ়দ (কাগজের পাতার ভাঁজ)। যাই হোক, এই আরবি কাগ়দ শব্দটি সোগদীয় ভাষা থেকে আসা, যার মূল চিনা শব্দ গু-জি (榖紙, gǔ-zhǐ, গু অর্থ কাগজ-তুঁত আর জি অর্থ কাগজ), কাগজ-তুঁত গাছের বাকলের তৈরি কাগজ। হিন্দিতে কাগজ় (कागज़) ও মরাঠিতে কাগদ (कागद)। বর্তমান তুর্কিতে শব্দটি কায়িত (kağıt)। এরকম আরও বেশ কিছু শব্দের দেখা মেলে: বাগাত/ৎ (বাগানগুলো), দলিলাত/ৎ (দলিলগুলো), ইত্যাদি।
আরও দু'টি ফারসি বহুবচন প্রত্যয়ের দেখা মেলে বাংলায়, আদালতের ভাষাতেই: -হা (ها), যা খানিকটা বঙ্গীকরণের মাধ্যমে বাংলায় আমলাহায় (আমলারা) বা প্রজাহায় (প্রজারা); এবং -আন (ان), সাহেবান (সাহেবরা), বাবুয়ান (বাবুরা), বোজর্গান (বোজর্গেরা), ইত্যাদি।
আরও দু'টি ফারসি বহুবচন প্রত্যয়ের দেখা মেলে বাংলায়, আদালতের ভাষাতেই: -হা (ها), যা খানিকটা বঙ্গীকরণের মাধ্যমে বাংলায় আমলাহায় (আমলারা) বা প্রজাহায় (প্রজারা); এবং -আন (ان), সাহেবান (সাহেবরা), বাবুয়ান (বাবুরা), বোজর্গান (বোজর্গেরা), ইত্যাদি।
Friday, February 22, 2008
বাংলায় আরবির আসর
বাংলার তিন আসর — গল্পের আসর, জিনের আসর আর আসরের নামাজ। শেষের দুটোকে (বাংলা একাডেমির) ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে আছর বানানে দ্বিতীয় ভুক্তি হিসেবে পাওয়া গেলেও, সেগুলো নিতান্তই আঞ্চলিক উচ্চারণ-সংবাদী বানান, কারণ সেই অভিধানেই এগুলোর আলাদা উচ্চারণ দেওয়া নেই: আঞ্চলিক বাংলায় অনেকেই স-কে, যদি উচ্চারণ ইংরেজি s-এর মত হয়, ছ হিসেবে লেখে। তিনটি শব্দই আরবি থেকে আগত। আরও একটি আসর বাংলায় পাওয়া যায়, অন্তত (জ্ঞানেন্দ্রমোহনের) বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে, সংস্কৃত, রাক্ষস অর্থে; পুরনো শব্দ, বর্তমানে অপ্রচলিত।
১৮২৭ সালে ছাপানো উইলিয়াম কেরি বা ১৮৫১-তে ছাপানো জন মেন্ডিসের বাংলা অভিধানে কেবল একটি আসর (বৈঠক) পাওয়া যায়; ১৮০২ সালে ছাপানো হেনরি পিট্স্ ফর্স্টারের অভিধানে শব্দটি নেই। আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রণীত ওগ্যুস্ত্যাঁ ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দকোষ বা তারও পরে প্রনীত হ্যালহেডের পূর্ববঙ্গীয় মুনশি বাংলা-ফারসি শব্দকোষে আসর শব্দটি অনুপস্থিত। তিনটির মধ্যে বৈঠক অর্থে আসর শব্দটি বাংলার বোধ করি প্রথম মেহমান এবং বাংলায় তার প্রবেশ হয়ত আঠার শতকের একেবারে শেষের দিকে। বাংলা একাডেমির অভিধান ছাড়া আর মাত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহনেই নামাজের সময় অর্থটি মেলে। বাকি সব অভিধানেই বৈঠক বা সভা।
প্রথম আসরটি আদতে আরবির আশর (عشر, অর্থ দশ, যা থেকে আশুরা, আরবি মাস মুহররমের দশ তারিখ)। দশ জনের সভা; গৌরবার্থক দশ, তার বেশিও হতে পারে। হরফ পাল্টেও উচ্চারণ একই থেকে গেছে, আশোর্ /ɑʃor/, বাংলার প্রায় সব উচ্চারণ অভিধান মতে। এবং এই অর্থেই শব্দটি প্রায় সব অভিধানে পাওয়া যায়। প্রথম দিকের বাংলা গদ্যে বানান দেখা যায়, আসোর: (ঘোড়া) ‘বাতকর্ম্ম করে আসোর জমকিয়ে দিলে,’ হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে উচ্চারণ দেওয়া আছে আশর্ /ɑʃɔr/, হয়ত পুরনো বা সচেষ্ট উচ্চারণ।
দ্বিতীয় আসরটি (প্রভাব অর্থে) আরবির আস়র্ (اثر, আরবিতে অন্যান্য অর্থ পদচিহ্ন, চিহ্ন, ফলাফল, ক্রিয়া, ইত্যাদি) থেকে, কেবল ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে পাওয়া যায়, বিকল্প বানানে আছর, উচ্চারণ দেওয়া আছে আসোর /ɑsor/। বোধ করি আছর বানান এবং আছোর্ /ɑtʃʰor/ উচ্চারণটি অনেক বেশি প্রচলিত এক্ষেত্রে। প্রথম আলো পত্রিকার ঈদ সঙ্খ্যায় ছাপানো মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি লেখা থেকে উদাহরণ: ‘আজকালকার দিনে লোকজনের ওপর জিন-ভুতের সেই রকম আছর হয় না।’ (বাংলা একাডেমির) বাংলা ভাষায় আরবী ফার্সী তুর্কী হিন্দী উর্দু শব্দের অভিধানেও এর দেখা মেলে।
তৃতীয় আসরটি আরবির আ়স়র্ (عصر, অর্থ সময়, কাল, অপরাহ্ণ, অপরাহ্ণের নামাজ বিশেষ)। ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ছাড়া কেবল জ্ঞানেন্দ্রমোহনে এই অর্থ মেলে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে উদাহরণ: ‘আসরের সময় বিবাহ হইয়াছিল।’ বাংলা একাডেমির অভিধানে উচ্চারণ আসর্ /ɑsɔr/, যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহনে আশর্, /ɑʃɔr/। অনেকর মুখেই আদতে শব্দটি আশোর্ /ɑʃor/, আরবির উচ্চারণ না জানা গ্রামবাংলায় তো বটেই। বানানেও আছর, উচ্চারণে নয়, বেশ চোখে পড়ে: বাদ আছর জানাজার অনুষ্ঠান হয়, অর্থাৎ আসরের নামাজের পর জানাজার নামাজ পড়া হয।
১৮২৭ সালে ছাপানো উইলিয়াম কেরি বা ১৮৫১-তে ছাপানো জন মেন্ডিসের বাংলা অভিধানে কেবল একটি আসর (বৈঠক) পাওয়া যায়; ১৮০২ সালে ছাপানো হেনরি পিট্স্ ফর্স্টারের অভিধানে শব্দটি নেই। আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রণীত ওগ্যুস্ত্যাঁ ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দকোষ বা তারও পরে প্রনীত হ্যালহেডের পূর্ববঙ্গীয় মুনশি বাংলা-ফারসি শব্দকোষে আসর শব্দটি অনুপস্থিত। তিনটির মধ্যে বৈঠক অর্থে আসর শব্দটি বাংলার বোধ করি প্রথম মেহমান এবং বাংলায় তার প্রবেশ হয়ত আঠার শতকের একেবারে শেষের দিকে। বাংলা একাডেমির অভিধান ছাড়া আর মাত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহনেই নামাজের সময় অর্থটি মেলে। বাকি সব অভিধানেই বৈঠক বা সভা।
প্রথম আসরটি আদতে আরবির আশর (عشر, অর্থ দশ, যা থেকে আশুরা, আরবি মাস মুহররমের দশ তারিখ)। দশ জনের সভা; গৌরবার্থক দশ, তার বেশিও হতে পারে। হরফ পাল্টেও উচ্চারণ একই থেকে গেছে, আশোর্ /ɑʃor/, বাংলার প্রায় সব উচ্চারণ অভিধান মতে। এবং এই অর্থেই শব্দটি প্রায় সব অভিধানে পাওয়া যায়। প্রথম দিকের বাংলা গদ্যে বানান দেখা যায়, আসোর: (ঘোড়া) ‘বাতকর্ম্ম করে আসোর জমকিয়ে দিলে,’ হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে উচ্চারণ দেওয়া আছে আশর্ /ɑʃɔr/, হয়ত পুরনো বা সচেষ্ট উচ্চারণ।
দ্বিতীয় আসরটি (প্রভাব অর্থে) আরবির আস়র্ (اثر, আরবিতে অন্যান্য অর্থ পদচিহ্ন, চিহ্ন, ফলাফল, ক্রিয়া, ইত্যাদি) থেকে, কেবল ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে পাওয়া যায়, বিকল্প বানানে আছর, উচ্চারণ দেওয়া আছে আসোর /ɑsor/। বোধ করি আছর বানান এবং আছোর্ /ɑtʃʰor/ উচ্চারণটি অনেক বেশি প্রচলিত এক্ষেত্রে। প্রথম আলো পত্রিকার ঈদ সঙ্খ্যায় ছাপানো মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি লেখা থেকে উদাহরণ: ‘আজকালকার দিনে লোকজনের ওপর জিন-ভুতের সেই রকম আছর হয় না।’ (বাংলা একাডেমির) বাংলা ভাষায় আরবী ফার্সী তুর্কী হিন্দী উর্দু শব্দের অভিধানেও এর দেখা মেলে।
তৃতীয় আসরটি আরবির আ়স়র্ (عصر, অর্থ সময়, কাল, অপরাহ্ণ, অপরাহ্ণের নামাজ বিশেষ)। ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ছাড়া কেবল জ্ঞানেন্দ্রমোহনে এই অর্থ মেলে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনে উদাহরণ: ‘আসরের সময় বিবাহ হইয়াছিল।’ বাংলা একাডেমির অভিধানে উচ্চারণ আসর্ /ɑsɔr/, যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহনে আশর্, /ɑʃɔr/। অনেকর মুখেই আদতে শব্দটি আশোর্ /ɑʃor/, আরবির উচ্চারণ না জানা গ্রামবাংলায় তো বটেই। বানানেও আছর, উচ্চারণে নয়, বেশ চোখে পড়ে: বাদ আছর জানাজার অনুষ্ঠান হয়, অর্থাৎ আসরের নামাজের পর জানাজার নামাজ পড়া হয।
Subscribe to:
Posts (Atom)